Image description

বাংলাদেশের রাজস্ব আহরণ পরিস্থিতি ও বাজেট ঘাটতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) উদ্বেগ রয়েছে। সংস্থাটির মিশনের সঙ্গে রোববার বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তবে সার্বিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দৃষ্টিতে স্থিতিশীল এবং সঠিক পথে রয়েছে বলে জানিয়েছে অর্থ উপদেষ্টা। 

রোববার অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করে আইএমএফের প্রতিনিধিদল। বৈঠক শেষে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। সচিবালয়ের অর্থ উপদেষ্টার কার্যালয়ে এই বৈঠক হয়। আইএমএফের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন মিশন প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও।

অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জুন মাসে দুই কিস্তির অর্থ ছাড়ের জন্য এই মিশন অর্থনীতির বিভিন্ন পর্যালোচনা করবে। মে-জুন মাসে তারা বাংলাদেশের অর্থনীতি পর্যালোচনা প্রতিবেদন নিয়ে বৈঠক করে ঋণের দুই কিস্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, রাজস্ব সংগ্রহ করা, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা এবং মুদ্রা বিনিময় হার বাজার উপরে ছেড়ে দেওয়াসহ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের সর্বোচ্চ প্রয়াস চলমান রয়েছে। আমাদের যা যা করার তা করেছি। এখনো করছি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা আমাদের গুড ইনটেনশন (ইতিবাচক মানসিকতা) দেখিয়েছি।

সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, শুল্ক-কর নিয়ে আইএমএফ জানতে চেয়েছে, কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াব কীভাবে? কর আদায় বাড়াব কীভাবে? এ ছাড়া করনীতি ও কর আদায়- এ দুটি বিভাগ আলাদা করার বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। সার্বিকভাবে বাজেট ঘাটতি কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, সেই বিষয়েও আইএমএফ জানতে চেয়েছে।

সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্ব আদায় না হওয়া প্রসঙ্গে আইএমএফ বলেছে, বাংলাদেশে কর জাল অনেক কম। এখানে লাখ লাখ শূন্য রিটার্ন দিয়ে থাকে। ভ্যাটের একক হার দেখতে চায় আইএমএফ। কিন্তু আমরা একেবারে একক ভ্যাট হারে যেতে পারব না।’

ঋণখেলাপি ও ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, খারাপ ঋণ কীভাবে কমাব, আইন সংশোধন- এসব নিয়ে কথা বলেছে আইএমএফ। তিনি বলেন, ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ও রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়েছে।

সালেহউদ্দিন আহমেদ জানান, দুই কিস্তির অর্থ ছাড়ে এবারের মিশন রাজস্ব পরিস্থিতি, কর-জিডিপি অনুপাত, বিদেশি মুদ্রার মজুত, বাজেট ঘাটতি- এসব বিষয় পর্যালোচনা করবে। সংস্কারের বিষয়ে বাংলাদেশ ভালো মনোভাব দেখিয়েছে বলে অর্থ উপদেষ্টা জানান।

ড. সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, আইএমএফ রাজস্ব সংগ্রহের বিষয়টি গুরুত্ব সহাকারে (কনসার্ন) দেখভাল করেছে। তারা জনায় যে, লাখ লাখ মানুষ জিরো রিটার্ন দেয়। বাংলাদেশের কর জিডিপি রেশিও সাড়ে ৭ শতাংশ। অন্যদিকে নেপালের ১২-১৩ শতাংশ। ভারতে ১৭-১৮ শতাংশ। আমরা তাদের এসব বিষয়ে গৃহীত পদক্ষেপ ও অগ্রগতি তাদেররকে অবহিত করেছি। এছাড়া খেলাপি ঋণ আদায়, একক বিনিময় হার নিয়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার (কনসার্ন) দেখিয়েছেন তারা। আমরা তাদেরকে সবকিছু জানিয়েছি।

একইদিনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে গত ডিসেম্বর করা প্রতিশ্রুতির অগ্রগতি বিষয়ে জানতে চায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঢাকায় সফররত মিশনের সদস্যরা। সংস্থাটির পক্ষ থেকে ঋণের শর্ত হিসাবে জুড়ে দেওয়া শর্তগুলো বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংক কি কি পদক্ষেপ নিয়েছে তা হালনাগাদ তথ্য তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিনিধি দলটি।

এদিকে মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) পলিসি রেট বা নীতি সুদহার কমানোর পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। তবে মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী না কমা পর্যন্ত পলিসি রেট বা নীতি সুদহারে হাত দিবে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গতকাল রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আইএমএফের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে উদ্বোধনী বৈঠক এমনটাই জানিয়েছেন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। বৈঠকে আইএমএফের ১৩ জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে চার ডেপুটি গভর্নর, সংশ্লিষ্ট বিভাগের ইডি, পরিচালক ও অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। 

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, পলিসি রেট, মূল্যস্ফীতি, ব্যাংক খাতের সংস্কার এবং দুর্বল ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

বৈঠকে উপস্থিত একজন কর্মকর্তা বলেন, আইএমএফ বিভিন্ন আর্থিক সূচক নিয়ে আলোচনা করেন। এর মধ্যে ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও যেই টার্গেট দিয়েছিল সেটা অর্জন হয়নি তারা জানিয়েছেন। পলিসি রেট বা নীতি সুদহার কমানোর কথা বলেছে আইএমএফ। তবে গভর্নর জানিয়েছেন মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা পর্যন্ত না কমা পর্যন্ত পলিসি রেট কমানো হবে না। তারা বলেছে, আগামী জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ২ শতাংশে নেমে আসবে। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেক কর্মকর্তা বলেন, আইএমএফ বলেছে, মূল্যস্ফীতি যেহেতু কমতে শুরু করেছে এবং সেটা যদি সাড়ে ৮ শতাংশে নেমে আসে তবে পলিসি রেট কমানোর বিষয়ে ভাবতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই সঙ্গে বৈদেশিক বিনিময় হার নির্ধারণের বিদ্যমান পদ্ধতি তুলে দিয়ে তা পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করার পরামর্শ দেয় সংস্থাটি। এর জবাবে গভর্নর বলেছেন, কোন অনুমানের ভিত্তিতে নয়, মূল্যস্ফীতি কমার প্রকৃত ডাটা পাওয়ার পরই পলিসি রেটের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আর মূল্যস্ফীতি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না আসা পর্যন্ত বিনিময় হারের বিষয়ে নতুন কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না। ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্ত পরিপালন নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের দিক থেকে যেসব সংস্কারগুলো রয়েছে, সেগুলোর অগ্রগতি নিয়েও দাতা সংস্থাটি সন্তোষ প্রকাশ করেছে বলে জানান তিনি।

এদিকে বিকেলের একটি বৈঠকে দুর্বল ব্যাংকগুলোর তারল্য পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে তারা জানতে চেয়েছে, নতুন করে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে কি-না। আবার ব্যাংকগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি ও এসব ব্যাংক নতুন করে ঋণ দেয় কি-না তাও জানতে চেয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, একটি ব্যাংকে তারল্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে। নতুন করে আর কাউকে তারল্য সহায়তা দেওয়া হয় না।