সমাজের অস্তিত্বের নিয়ামক ও কেন্দ্রীয় প্রত্যয় হলো সামাজিকীকরণ। মানবসমাজে উন্নতমানের সংস্কৃতি গঠন, সাংস্কৃতিক স্থিতিশীলতা আনয়ন এবং এর মধ্য দিয়ে স্থিতিশীল সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণের জন্য সামাজিকীকরণের ভূমিকা অপরিসীম। সামাজিকীকরণ এমন এক প্রক্রিয়া যার মধ্য দিয়ে একজন ব্যক্তি তার সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন ও সে অনুযায়ী আচরণ করে। সমাজ জীবনে ব্যক্তির আচরণ ও কর্মকাণ্ড বহুলাংশে এই সামাজিকীকরণের ধারণার উপরই নির্ভর করে। এর মধ্য দিয়ে ব্যক্তির মধ্যে সমাজের সংস্কৃতি প্রবেশ করে সংরক্ষিত ও পরিবর্তিত হয়।
জšে§র পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া চলমান থাকে। এটি একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া। মানবশিশু জšে§র পর প্রথমে মায়ের এবং পরবর্তী সময়ে বাবা ও অন্যান্য সদস্যের সংস্পর্শে আসে। পরিবারের সকল সদস্যদের আচরণ শিশুর আচরণকে প্রভাবিত করে। এরপর শিশু পরিবারের বাইরের পরিবেশ যেমনÑ খেলার সাথী, পাড়া-প্রতিবেশী, বিদ্যালয়, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করে। শিশু যে সমাজে বেড়ে উঠে সে সমাজের প্রথা, মূল্যবোধ, রীতিনীতি, আচার-আচরণ প্রভৃতি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করে সমাজের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে শিখে এবং সামাজিক মানুষে পরিণত হয়। এভাবেই সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া চলতে থাকে। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি সামাজিক মানুষে পরিণত হয়ে উঠে। মানুষকে সামাজিকীকরণে অভ্যস্ত করতে বিভিন্ন উপাদান ভূমিকা পালন করে থাকে। পরিবর্তনশীল সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ যেমনÑ গণমাধ্যম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, ক্লাব, সংঘ ইত্যাদি ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু আধুনিককালে সামাজিক মানুষ একজন বৈশ্বিক ব্যক্তিত্বকেও ধারণ করে থাকেন। কেননা প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধন বর্তমানে সমাজে পরিবর্তন ঘটিয়েছে। সময়ের সাথে সাথে বদলে গেছে পুরো বিশ্ব। সারা বিশ্ব আজ মানুষের হাতের মুঠোয়। এই পরিবর্তনের পেছনে মূল ভূমিকা পালন করছে বিশ্বায়ন এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম প্রধান আলোচিত একটি বিষয় হলো বিশ্বায়ন। কানাডার বিখ্যাত টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ও প্রখ্যাত দার্শনিক গধৎংযধষ গধপষঁযধহ সর্বপ্রথম ‘বৈশ্বিক গ্রাম’ কথাটি ব্যবহার করেন। বিশ্বায়ন হলো বিশ্বের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার একত্রীকরণ। প্রত্যয়টি সমগ্র বিশ্বকে একটি বৈশ্বিক গ্রাম হিসেবে বিবেচনা করেছে। যা এখন উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু এবং নিজের চোখে অন্যকে, অন্যের চোখে নিজেকে উপস্থাপনের প্লাটফর্ম ধরা হয়। বিশ্বায়নের মাধ্যমে কোনো কিছু স্থানিক থেকে বৈশ্বিক রূপ লাভ করে।
অন্যদিকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বলতে কম্পিউটারভিত্তিক আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তিকে বোঝানো হয়, যার মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যেই সারা বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের সাথে যোগাযোগ করা যায়। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিশ্বায়নকে বাস্তব রূপ দিয়েছে। যা আধুনিক মানুষের সামাজিক জীবনের নানা ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণভাবে প্রভাব ফেলেছে। বিশ্বায়ন এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ফলে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের মানুষের সাথে ঘরে বসে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে। মোবাইল ফোন, স্যাটেলাইট চ্যানেল, অনলাইন সংবাদপত্র, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন বিনোদন সাইট এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে মানুষ দ্রুত ও কম সময়ে সারাবিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের সাথে পারস্পরিক যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও নানা কাজ সম্পাদনা করে সক্ষম হচ্ছে। এতে তাদের চিন্তাধারা, সংস্কৃতি, পরিবেশ, জীবনধারা, সমাজ, অর্থনীতি, ধর্ম ইত্যাদি সম্পর্কে জানার সুযোগ হচ্ছে। পারস্পরিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে মানুষ নিজের অজান্তেই বিভিন্ন বিষয়ে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। জীবনযাত্রা, খাবার-দাবার, পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদির ওপর এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে। এভাবে ব্যক্তি মানুষ পরিণত হচ্ছে বৈশ্বিক ব্যক্তিত্বে, ধারণ করছে বহুজাতিক বৈশিষ্ট্য। যা আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি নয়, তাও বৈশ্বিক সংস্কৃতি দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হচ্ছে।
এছাড়া বিশ্বায়নের আরো বহু দিক বা মাত্রা আছে। যেমন- অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, উৎপাদন ব্যবস্থায়, শিক্ষা ক্ষেত্রে, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি। এসব উপাদানও সামাজিকীকরণকে প্রভাবিত করে থাকে। বিশ্বায়ন এবং তথ্য ও প্রযুক্তির প্রভাবে এসব উপাদান বিভিন্নভাবে প্রভাবিত ও পরিবর্তিত হচ্ছে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
মানবকণ্ঠ/এসআরএস
Comments