Image description

এবারের ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনের একটি আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। গুরুত্বের কারণ হলো বৈশ্বিক রাজনৈতিক এবং সামগ্রিক পরিস্থিতি। অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বিশ্বে বেশি রাজনৈতিক টানাপড়েন চলছে বলেই মনে করা হচ্ছে। যুুদ্ধ চলছে এবং যুদ্ধ যুদ্ধ মনোভাবও প্রকট হচ্ছে। এই সময় নিজেদের সক্ষমতা জানান দিতে এবং প্রতিপক্ষকে সতর্ক করতে ও কিছু সিদ্ধান্ত নিতে এ সম্মেলন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি আলোচনা, ইউক্রেনকে সাহায্য করা, ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্তির ভবিষ্যৎ। কারণ যুদ্ধে ইউক্রেনের আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। বরং রাশিয়া এখন সুবিধাজনক অবস্থানে। ওদিকে যুক্তরাজ্যে নির্বাচনে ক্ষমতায় এসেছে লেবার পার্টি। ফ্রান্সেও পরিবর্তনের সুর। আর যুক্তরাষ্ট্র তো আছেই। প্রথম বিতর্কেই ট্রাম্পের কাছে হেরেছেন বাইডেন। মঙ্গলবার সামরিক জোট ন্যাটোর ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ৯-১২ জুলাই ওয়াশিংটনে বসতে যাচ্ছে শীর্ষ সম্মেলন। ন্যাটো নিশ্চিতভাবেই এই মুহূর্তে বিশ্বের সবথেকে শক্তিশালী সামরিক জোট। এই জোট আরও প্রসারিত করার চেষ্টাই করছে সদস্য রাষ্ট্রগুলো। ইতোমধ্যেই সেই লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। ন্যাটো প্রসারিত হয়েছে। সামনেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন। এখানে যদি বাইডেন না এসে ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার ক্ষমতায় আসেন তাহলে ইউক্রেন যুদ্ধের গতি প্রকৃতি কী হবে বা আমেরিকা আগের অবস্থানেই যে থাকবে এমন নিশ্চয়তা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব রয়েছে। কারণ ট্রাম্প এ নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন। যুক্তরাজ্যেরও আগাম নির্বাচন হচ্ছে এবং সেখানেও রাজনীতিতে পরিবর্তন আসতে পারে। ইউক্রেনের জন্য সামরিক সহায়তা অটুট রাখতে নানা ধরনের আইনি নিশ্চয়তার উদ্যোগ চলছে। ইতালিতে জি-সেভেন শীর্ষ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেন দশ বছরের নিরাপত্তা চুক্তি সই করেছে। এর আওতায় ভবিষ্যতে ইউক্রেনে আবার হামলা হলে যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। রাশিয়া-ইউক্রেনযুদ্ধ শুরুর পর থেকেই ন্যাটোর বিস্তার নিয়ে রাশিয়ার আপত্তি এবং ন্যাটোর এই যুদ্ধে জড়ানো বা না জড়ানো নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে এখনও যুদ্ধে জড়ায়নি এবং দ্রুত সেই সম্ভাবনা নেই। যদি কোনো কারণে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সহায়তা কমিয়ে দেয় বা বন্ধ করে দেয় সেক্ষেত্রে ন্যাটোর পক্ষ থেকে তা বৃদ্ধি করতে হবে। ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাখা ন্যাটোরও একটি কৌশল। ন্যাটো এবং রাশিয়া বিপরীত। তবে সরাসরি যুদ্ধে জড়াবে না। কারণ প্রত্যক্ষভাবে ন্যাটোর যুদ্ধে জড়ানো অর্থ হলো একটি ব্যাপকার যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হওয়া। সেই ঝুঁকি এখনই নেবে না ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রগুলো। সেই আলোচনা-সমালোচনা এখনও চলছে। যুদ্ধ দুইভাবে হয়। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে। ইউক্রেন যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধ করছে ইউক্রেন এবং পরোক্ষাভাবে যুদ্ধ করছে তার মিত্রদেশসমূহ। এই যুদ্ধ এখন আরও বিস্তৃত হচ্ছে। সম্প্রতি তা নতুন মাত্রাও পেয়েছে। ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনের ন্যাটো জোটে যোগ দেয়ার প্রচেষ্টা করছে আগে থেকেই। উদ্দেশ্য মূলত ইউক্রেন যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে সেরকম হলে এই সামরিক জোটের সহযোগিতা পাওয়া। কারণ ন্যাটো জোটভুক্ত কোনো দেশ আক্রান্ত হলেই তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। ফলে ন্যাটো জোটভুক্ত কোনো দেশকে সহজেই আক্রমণ করা সহজ কথা নয়। ইউক্রেন এখনো ন্যাটো জোটে যোগ দিতে পারেনি কিন্তু ন্যাটোতে যোগ দেয়ার প্রচেষ্টা করছে যা রাশিয়ার ইচ্ছে নয়। কিন্তু এই বিষয়টি রাশিয়ার মাথা ব্যথার কারণ হবে। সম্মেলন চলাকালীন রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ বলেছেন, ইউক্রেনকে পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক সহায়তা শুধু রাশিয়ার সঙ্গেই যুদ্ধের পরিধি বাড়াবে না বরং এটি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকিও তৈরি করবে। ইউক্রেন ন্যাটোভুক্ত হবে এমন আশা করা হলেও সেটা হয়তো এই মুহূর্তেই হচ্ছে না। এটাও একটি কৌশলগত অবস্থান বলা যেতে পারে। ন্যাটোর মহাসচিব স্টলটেনবার্গের কথায় এর অনুমান করা যায়। তিনি বলেছেন যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালে কিয়েভের জোটে যোগ দেয়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ কিয়েভকে ন্যাটো সহায়তা অব্যাহত রাখতেই পারে তবে পূর্ণ সদস্যের মর্যাদা দিতে যুদ্ধ শেষের অপেক্ষা করতে হতে পারে। যদিও এই সিদ্ধান্ত কখন কোন দিকে মোড় নেয় সেটি এখনই বলা যাচ্ছে না। সেই ২০০৮ সালে জোটটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করা হবে। এখনও সেই কথাই বলা হচ্ছে। সেসময় হয়তো আরও দীর্ঘায়িত হবে। এবারের সম্মেলনে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ঘটছে। ন্যাটো সম্মেলনের আগে একজন ইউরোপীয় কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, সম্মুখযুদ্ধে ইউক্রেন একটি ভঙ্গুর অবস্থায় আটকে পড়ায় একধরনের অস্বস্তির মধ্যেই এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এবারের সম্মেলনে ন্যাটোকে একটি বৃহৎ ও শক্তিশালী জোট হিসেবে দেখানোই উদ্দেশ্য। একদিকে যেমন ন্যাটোর বিস্তার বাড়ছে অন্যদিকে রাশিয়ার সাথে স্নায়ুবিক প্রতিযোগিতাও বাড়ছে। ১৯৪৯ সালের ৪ এপ্রিল ন্যাটো নামের এই সামরিক জোট প্রতিষ্ঠিত হয়। এর বর্তমান সদস্য দেশ ৩০টি। নতুন সদস্য হলো সুইডেন এবং ফিনল্যান্ড। জোটটির প্রতিষ্ঠার সময় সদস্য ছিল ১২টি রাষ্ট্র এবং সময়ের সাথে সাথে জোটের সদস্য দেশের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ন্যাটোর বিস্তৃতি ঘটছে। উল্লেখ্য ন্যাটোর সদস্যভুক্ত অধিকাংশই ইউরোপের দেশ (২৮টি)। বাকি দুটি দেশ উত্তর আমেরিকার। এটি এমন একটি জোট যেখানে সদস্য দেশগুলোকে সম্মিলিতভাবে নিরাপত্তা দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ন্যাটো গঠিত হয়েছিল এমন একটি সময় যখন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে স্নায়ু যুদ্ধ চলছিল। বর্তমানে স্নায়ু যুদ্ধের সেই মাত্রা না থাকলেও প্রতিযোগিতা রয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে সামষ্টিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থার অংশ হিসেবে ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠা হয় ন্যাটো সামরিক জোটের। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন আক্রমণ করে রাশিয়া। এরপর কিয়েভের পক্ষে দাঁড়ায় ন্যাটোর মিত্ররা। এর মাধ্যমে ন্যাটো মূলত জোটটির প্রতিষ্ঠাকালীন লক্ষ্যেই ফিরে গেছে। রাশিয়ার ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের পেছনে এটা একটি অন্যতম বড় কারণ বলে মনে করা হয়। ভøাদিমির পুতিন দাবি করেন যে, ১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্র তৎকালীন সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভের কাছে একটা নিশ্চয়তা দিয়েছিল যে ন্যাটো জোটকে পূর্ব দিকে আর সম্প্রসারণ করা হবে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এই অঙ্গীকার রক্ষা করেনি। সেসময় থেকে এ পর্যন্ত সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন বা তার প্রভাব বলয়ের অংশ ছিল এমন অনেক পূর্ব ইউরোপিয়ান দেশ ন্যাটোর সদস্য হয়েছে। ন্যাটো জোটের এই সম্প্রসারণ যা রাশিয়া মেনে নিতে পারছে না। এই যুদ্ধ হচ্ছে ইউক্রেনের মাটিতেই, যুদ্ধ করছে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী কিন্তু অস্ত্র, অর্থ এবং অন্যান্য জিনিসের যোগান দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র দেশগুলো। যুদ্ধে কোনো ধরনের মীমাংসা হওয়ার আগ পর্যন্ত যে পশ্চিমা দেশ ও ন্যাটো থেকে সহায়তা পাবে ইউক্রেন সেটা ধারণা করা যায়। ন্যাটোর সদস্য না হলেও ইউক্রেনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবেই দেখছে ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্র। মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর প্রক্সিযুদ্ধ মনে করছেন বিশ্লেষকরা। গণমাধ্যমের বিভিন্ন বিশ্লেষণে এমনটাই উঠে এসেছে। ন্যাটোর সাথে রাশিয়ার উত্তেজনা যদি বৃদ্ধি পায় তা হবে পৃথিবীর জন্য আরও খারাপ পরিস্থিতির। কারণ একটি বৃহৎ সামরিক জোট এবং পৃথিবীর বৃহৎ পরাশক্তির ভেতরের দ্বন্দ্ব মারাত্মক ধ্বংস ডেকে আনবে।  

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট