Image description

২০১৮ সালে বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন সারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। দেশের সর্বস্তরের ছাত্র-ছাত্রীরা রাজপথে নিজেদের অধিকারের জন্য আন্দোলনে নেমে পড়ে। এর ফলে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকার ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলনের কারণে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরি থেকে কোটা পদ্ধতি বাতিল করে। গত ৫ জুন মহামান্য হাইকোর্ট সেই কোটা পদ্ধতি বাতিলে জারিকৃত পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে। পরিপত্র বাতিলের কারণে সারা বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রীরা আবারো রাজপথে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনে নেমেছে। ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বৈষম্যের বিরুদ্ধে হাজারো বীর মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করে বৈষম্য দূর করেছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাই ছিল মৌলিক অধিকার, আইনের শাসন, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা। কোটা সংস্কার আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আন্দোলন। বৈষম্য দূর করার আন্দোলন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বহু মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, কেউ হাত-পা হারান, কেউ পঙ্গু হয়ে পড়েন। যুদ্ধে যাওয়ার কারণে রাজাকার এবং পাকিস্তানি বাহিনী তাদের ঘরবাড়ি লুটপাট করে। তাই সামাজিক নিরাপত্তার জন্য ১৯৭২ সালে অনগ্রসর জাতির জন্য অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসাবে কোটা পদ্ধতির প্রবর্তন করেছিল। যুদ্ধের পর তাদের সঠিক পুনর্বাসন সম্ভব হয়নি সেজন্য যেন মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের সন্তান-সন্ততিদের কথা মাথায় রেখে মুক্তিযোদ্ধা কোটা রাখা হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর তারা কি এখনো অনগ্রসর? এ প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে তাদের ভাতাসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা করা হয়েছে তাদের এই সম্মান প্রাপ্য। যারা জীবিত আছেন তাদের জন্য রাষ্ট্র থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাবা-মার সম্পদ তার ছেলেমেয়েরা ওয়ারিশ হিসাবে পায় কিন্তু তার নাতি-নাতনি তো কোনো সম্পদ পায় না। তাহলে মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনি কেন অনৈতিক কোটার সুবিধা পাবে? তারা কি স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও অনগ্রসর? স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাজীবনে তারা এই কোটার সুবিধা ব্যবহার করে। শিক্ষাজীবনে ব্যবহার করার পরেও চাকরিতে কেন আবার কোটা সুবিধা পাবে? তারা কি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদেরকে মেধাবী হিসাবে গড়ে তুলতে পারেনি? এ প্রশ্নগুলো থেকেই যায়। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান-সন্তানাদি নাতি-নাতনি বীরের বংশধর। তাদের উচিত অনৈতিক সুবিধা ভোগ না করে মেধাবীদের সাথে বীরের মতো লড়াই করা। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানার্থে তাদের চেতনা বৈষম্য মুক্ত সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখা। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে ন্যায়, সাম্য এবং মেধার ভিত্তিতে বিনির্মাণ হবে এটিই সকলের কাম্য। কিন্তু বর্তমান ১ম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে ৫৬% কোটা বিদ্যামান। এর মধ্যে ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটা, ১০% জেলা কোটা, ১০ শতাংশ নারী কোটা, ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠী এবং ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা বিদ্যমান। মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির আমলে রাজনৈতিক পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করতে হাজার হাজার মানুষ মুক্তিযোদ্ধার সনদ পেয়েছেন। কোটা সুবিধা থাকার কারণে রাজনৈতিক সুবিধা নিয়ে হাজার হাজার মানুষ মুক্তিযোদ্ধা সেজে বসে আছেন। বিভিন্ন সময় সরকারের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ভুয়া সনদ নেয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ের ৫ শিক্ষকের বিরুদ্ধেও এই অভিযোগ ছিল। মেধাবীদের নিয়োগ না দিয়ে এসব অযোগ্যরা দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে আছে। কোটা সুবিধা থাকার ফলে প্রকৃত মেধাবী শিক্ষার্থীরা দেশে সরকারি চাকরি পাচ্ছে না। পড়াশোনা শেষ করার পর মেধাবীরা হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে। গণমাধ্যমের তথ্যমতে প্রতি বিসিএস সাধারণ ক্যাডারে গড়ে মোট ৫০০ জন কর্মকর্তা নিয়োগ পান। ৩৮তম বিসিএসে পরীক্ষার্থী ছিলেন সাড়ে তিন লাখ। নিয়োগ পরীক্ষায় ২২৫-তে নিয়োগ হয় বাকিগুলো কোটার মাধ্যমে। মেধায় কোনো প্রার্থী ২২৬তম হলেও তার চাকরি না-ও হতে পারে কিন্তু কোটা সুবিধা থাকলে ৭০০০তম হয়েও পেতে পারেন বিসিএস নামক সোনার হরিণ। এর ফলে প্রকৃত মেধাবীরা বঞ্চিত হচ্ছে। তারা দেশ ত্যাগের মতো বড় সিদ্ধান্ত বেছে নিচ্ছে। ফলে আমাদের দেশ মেধাশূন্য হয়ে যাচ্ছে। ফলে আমাদের তৈরি ফসলের ফল ভোগ করছে অন্য দেশ আমরা পাচ্ছি আগাছা। কোটা পদ্ধতি সংস্কার করে সকল কোটা একত্রে ১০% এর মধ্যে নিয়ে আসা যেতে পারে। মুক্তিযোদ্ধা কোটা নাতি-নাতনি পর্যন্ত বংশ পরম্পরায় না দিয়ে শুধু সন্তানদের জন্য কিছু রাখা যেতে পারে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীরা যেহেতু এগিয়ে সেজন্য নারী কোটা বাতিল করা যেতে পারে। আন্দোলনে আসা নারী শিক্ষার্থীরা কিন্তু নারী কোটার বিপক্ষে। তারা স্বীকার করেন নারীরা সমাজে পুরুষের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এমন কি আমাদের দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও একজন নারী। যেদেশের প্রধানমন্ত্রী নারী সেদেশে আমরা নারী জাতিকে অনগ্রসর বলতে পারি না। ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠীর সাথে বাংলাদেশের সকল জনগণের সংখ্যার পরিমাণ বিবেচনা করে তাদের জন্য সামান্য কিছু কোটা রাখা যেতে পারে। সরকারি সকল চাকরির ক্ষেত্রে সকল কোটা একত্রে ১০% এর মধ্যে নিয়ে আসা যেতে পারে। কোটা সংস্কারের মাধ্যমে একটি জাতিকে পরিচালনার জন্য বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আমরা মেধাবী শিক্ষার্থীদের সুযোগ তৈরি করে দিতে পারি। মেধার মূল্যায়নের মধ্যে দিয়ে সোনার বাংলা গড়তে পারি।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট