Image description

ইরানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন সংস্কারপন্থি মাসুদ পেজেশকিয়ান। তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির আশীর্বাদপুষ্ট রক্ষণশীল সাঈদ জালিলিকে বিশাল ব্যবধানে হারিয়ে ইরানের ১৪তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।

মাসুদ পেজেশকিয়ান দেশটির পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশের বাসিন্দা। তিনি ১৯৫৪ সালে মাহাবাদ শহরে জন্ম নেন। তার বাবা ইরানি-আজেরি ও মা ইরানি-কুর্দি। পেজেশকিয়ান জেনারেল মেডিসিনে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি যখন মেডিকেলের তরুণ ছাত্র, তখন পাহলভি শাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লবীদের দলে ভিড়েছিলেন। ১৯৮০’র দশকে ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় তিনি যোদ্ধা হিসেবে চিকিৎসকের দায়িত্ব পালন করেন। পেজেশকিয়ান ২০০১ সালে ইরানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হন।

তিনি পূর্ব আজারবাইজানের ২০০৮ থেকে টানা সংসদ সদস্য ছিলেন। ইরানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের বিজয়ে দেশ, অঞ্চল ও বিশ্ব রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। একদিকে তিনি নিজ দেশের সবপক্ষের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ার ঘোষণা দিয়েছেন অন্যদিকে পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের নীতি বাস্তবায়নেরও প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। ইরানি জনগণের সমর্থন ছাড়া তার চলার পথ মসৃণ হবে না। ফলে পেজেশকিয়ানকে ঘরে-বাইরে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। ইরানের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সংস্কারপন্থি মাসুদ কট্টর রক্ষণশীল সাঈদ জালিলির বিরুদ্ধে জয়লাভ করেছেন।

সরকারি এক হিসাব অনুযায়ী, জালিলির ১ কোটি ৩৫ লাখের বিপরীতে ১ কোটি ৬৩ লাখ ভোট পেয়ে মাসুদ বিজয়ী হয়েছেন। দ্বিতীয় রাউন্ডে ভোট পড়েছে ৪৯.৮ শতাংশ। নির্বাচনটি মূলত ২০২৫ সালে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মে মাসে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুর পর এটি এগিয়ে আনা হয়েছে। গত ২৮ জুন অনুষ্ঠিত প্রথম দফায় চারজন প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর মধ্যে একমাত্র সংস্কারপন্থি প্রার্থী ছিলেন পেজেশকিয়ান। তবে নিয়মানুযায়ী, প্রথম দফায় কোনো প্রার্থী পঞ্চাশ শতাংশের বেশি ভোট না পাওয়ায় দ্বিতীয় দফায় ভোট হয়।

প্রথম দফায় প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা মাসুদ পেজেশকিয়ান ও অতি রক্ষণশীল সাঈদ জালিলির মধ্যে দ্বিতীয় দফায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। ইরানের নবম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর পেজেশকিয়ান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এক পোস্টে সবার প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। পোস্টে প্রবীণ আইনপ্রণেতা ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ইরানের জনগণের সাহচর্য, সহানুভূতি এবং বিশ্বাস ছাড়া সামনের পথটি তার জন্য মসৃণ হবে না। জনগণকে লক্ষ্য করে তিনি বলেছেন, আমি আপনাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি। আমাকে একা ছেড়ে দেবেন না। ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে চীন, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন ইরানের ওপর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার বিনিময়ে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির সীমা নির্ধারণ করে। ২০১৫ সালে জেসিপিওএ যখন স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তখন মনে হয়েছিল, ইরানের বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটছে। কিন্তু ২০১৮ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চুক্তি থেকে একতরফা নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন এবং ইরানের অর্থনীতির ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন, যা এখনও বহাল। জেসিপিওএ অচলাবস্থায় থাকার কারণে ইরান নিষেধাজ্ঞার জবাবে এবং নাশকতামূলক হামলার জন্য ইসরাইলকে দায়ী করার প্রতিক্রিয়া হিসেবে একটি পারমাণবিক প্রান্তিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সব দিক থেকে কট্টরপন্থিরা রয়েছে, যারা চুক্তিটি বাতিল চায়।

নিষেধাজ্ঞা ও বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ে পেজেশকিয়ানের অবস্থান কী? এমন প্রশ্নের উত্তরে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বলেছেন, তিনি উন্নত বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপন ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রয়োজনীয় আর্থিক স্বচ্ছতা বিধিমালা গ্রহণের মাধ্যমে ইরানের অর্থনীতি বাধাগ্রস্ত হয়েছে এমন নিষেধাজ্ঞাগুলো বাতিল করতে চান। ভোটের আগে পেজেশকিয়ান এক বিতর্কে বলেছিলেন, ‘আমরা যদি অর্থনৈতিক ইস্যুতে উন্নতি করতে চাই এবং সমৃদ্ধির জন্য বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে চাই তবে আমাদের অবশ্যই বিভিন্ন উপায়ে নিষ্ঠুর নিষেধাজ্ঞাগুলোর সমাধান করতে হবে।’ এর মধ্যে যুক্ত হবে জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ), বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ২০১৫ সালের চুক্তি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে চুক্তি থেকে ২০১৮ সালে একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নিয়েছে।

বহু বছর ধরে বহুপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে এটিকে পুনরুজ্জীবিত করতে ব্যর্থ হওয়ায় চুক্তিটি অচল অবস্থায় রয়েছে। পেজেশকিয়ানও জোর দিয়ে বলেন, এ প্রতিশ্রুতি দেন না যে, তিনি সব নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে পারবেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই তার সব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে হবে। তাহলে আমরাও চুক্তিতে ফিরে যাব। সমাধান খুঁজতে আমাদের অবশ্যই অন্যান্য অংশীদারভুক্ত রাষ্ট্রের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে হবে। নতুন রাষ্ট্রপতিকে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। ইরান নিজেদের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে বিষয়গুলো চালিয়ে যেতে বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। দেশটির অর্থনীতি প্রায় ৪০ শতাংশের উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে আটকে রয়েছে। কর্তৃপক্ষ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, এ অবস্থা স্বল্পকালীন। কারণ ইরান কেবল শিখরে যাওয়ার পথে কিছু বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। এমনকি মাসুদ পেজেশকিয়ানের সামনে কিছু জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলার বিষয় রয়েছে। তাকে ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ নিয়ে সৃষ্ট উত্তেজনা সামাল দিতে হবে। ইরানের অগ্রসরমান পারমাণবিক কর্মসূচি এগিয়ে নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে মার্কিন তথা পশ্চিমাদের সঙ্গে যে কোনো ধরনের বিরোধের ঝুঁকি তাকে এড়িয়ে যেতে হবে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তেহরান চীন এবং অন্যদের কাছে তার অপরিশোধিত তেল বিক্রি করে চলেছে। তবে দেশটি বৈশ্বিক অর্থনীতি থেকে মূলত বিচ্ছিন্ন। দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচি পশ্চিম ও আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার সঙ্গে একটি সংঘর্ষের বিন্দুকে নির্দেশ করে। ইরান ও তার প্রতিরোধের সহযোগীরা সমন্বিত রাজনৈতিক ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে সরাসরি ইসরাইল এবং তার মিত্রদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। প্রথম রাউন্ডের তুলনায় ভোটদানের উচ্চহার পেজেশকিয়ানের পক্ষে কাজ করেছে এবং তাকে একটি উল্লেখযোগ্য বিজয় এনে দিয়েছে। প্রায় দুই দশকের মধ্যে দ্বিতীয় সংস্কারপন্থি প্রেসিডেন্ট এখন ইরানে নির্বাচিত হয়েছেন এবং শিগগিরই সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন। এবারের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ৫০ শতাংশের সামান্য কম ছিল। আমরা জানি, এখনও ৫০ শতাংশ ইরানি ব্যালট বাক্সে যাননি। এর কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল, নির্বাচনে বিজয়ী রক্ষণশীল বা সংস্কারবাদী হোক না কেন; কোনো পরিবর্তন আনবে না। অনেক ইরানি নির্বাচন বয়কট করেছে। এটিও এক নীরব প্রতিবাদ। পেজেশকিয়ান অবশ্যই একটি নিষ্পত্তিমূলক বিজয় লাভ করেছিলেন। তবে এটি উল্লেখ করা উচিত, কমপক্ষে ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ জালিলির পক্ষে ভোট দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এসব সমস্যা সত্ত্বেও সিস্টেমের প্রতি তারা অনুগত। পেজেশকিয়ানের সামনে চ্যালেঞ্জ।

তাছাড়াও তিনি একটি দলেও না থাকার জন্য সমালোচিত হয়েছেন এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তিনি হাসান রুহানির আগের সরকার থেকে তার মন্ত্রীদের বেছে নেবেন বলে আশা করা হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ প্রভাব বাদ দিলে, ইরানের বিদেশনীতির সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়ায় কিছু কৌশলগত সামঞ্জস্য দেখা গেলেও ইরানের বৈদেশিক নীতির নির্দেশক মৌলিক নীতিগুলোতে অদূর ভবিষ্যতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কৌশলগত সিদ্ধান্ত সুপ্রিম লিডার ও জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ দ্বারা নির্ধারিত হয়, প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে নয়। ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ইসরাইলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রত প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলো, বিশেষ করে হামাস এবং হিজবুল্লাহকে সম্পূর্ণ সমর্থন অব্যাহত রাখবে। এর অর্থ হলো এই যে, দেশটির আঞ্চলিক নীতি, এই অঞ্চলে সহযোগী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন করা এবং পারমাণবিক কর্মসূচির কৌশলগুলো এমনকি নতুন প্রেসিডেন্টের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন না-ও আনতে পারে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ইসরাইল দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান শত্রুতাকে ততই তীব্রতর করতে পারে, সম্ভাব্যভাবে আরও প্রকাশ্য সংঘর্ষের দিকে নিয়ে যেতে পারে। এই পরিস্থিতি বিস্তৃত মধ্যপ্রাচ্যের জটিল ও অস্থির সমীকরণকেই দর্শায়, যেখানে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং নিরাপত্তার উদ্বেগ প্রায়শই গোপন কাজকর্ম ও প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। নেতানিয়াহু প্রশাসন এখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার আশা করলেও মনে হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তেহরানের সঙ্গে সরাসরি সংঘাত চাইছে না। প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যু হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও মার্কিন সরকার ইরানের প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে আনুষ্ঠানিকভাবে শোক প্রকাশ করেছে। প্রেসিডেন্ট এবং বিদেশমন্ত্রী ইরানের বিদেশনীতির প্রধান সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী না হলেও এই পরিস্থিতিতে একটি শূন্যস্থান গাজাকে ঘিরে তেহরানের আঞ্চলিক কূটনৈতিক কার্যকলাপের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে এবং মার্কিন নির্বাচনের প্রেক্ষিতে বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ হারাতে পারে। প্রতিকূলভাবেই এটি মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নীতিকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর ক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।

তাছাড়া ধর্মীয় নেতা ও প্রজাতান্ত্রিক শাসন- এমন দ্বৈত ব্যবস্থায় পরিচালিত হয় মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরান। পরমাণু কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের তীব্র টানাপড়েন চলছে। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে তেহরান সমর্থিত মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। পেজেশকিয়ান নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর প্রশ্ন উঠেছে এমন অবস্থায় এসব ইস্যুতে কোনপথে হাঁটবে ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট। সময়ই বলে দেবে কোনদিকে এগোবে ইরানের ভবিষ্যৎ।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

মানবকণ্ঠ/এসআরএস