Image description

প্রায় দেড় মাস ধরে হামাস নির্মূলের নামে সর্বশেষ আশ্রয়স্থল রাফায় নজিরবিহীন হামলা চালাচ্ছে ইসরাইল। এই অঞ্চলে আক্রমণের আগে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলের চাপ থাকলেও তা উপেক্ষা করে বর্বরোচিত হামলা চালাচ্ছে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ।

গাজা উপত্যকা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে এবার রাফা অঞ্চলে হায়েনারা মেতেছে মানুষ বলি দেয়ার নতুন উদ্যমে। তাদেরকে বলার যেন কেউ নেই। পৃথিবীর সমস্ত আইন যেন তাদের কাছে সে ফ লিখিত কোনো অনুলিপি। কী তাদের অদৃশ্য শক্তি? কেন তারা এতো বেপরোয়া? এরকম হাজারো প্রশ্ন ওঠে আসে মনের কুঠুরিতে। শুরুটা হয়েছিল ৭ অক্টোবরে ইসরাইলের অভ্যন্তরে হামাসের অতর্কিত হামলায়। বিভিন্ন তথ্যমতে, এই হামলায় এক হাজারের অধিক মৃত্যু হয় এবং ২৪২ জনকে জিম্মি করা হয়। এই হামলার প্রতিশোধ ও জিম্মি উদ্ধারে ইসরাইল যে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে, তা বিশ্ব শান্তির জন্য হুমকি স্বরূপ। এতে কয়েক হাজার বেসামরিক মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। শুধু মানুষ হত্যা করেই বসে থাকেনি, বরং বেঁচে থাকার সকল নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য প্রবেশেও বাধা দিচ্ছে। এক সংবাদে বলা হয়, জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলে সংস্থাটির এক জ্যেষ্ঠ ত্রাণ কর্মকর্তা জানান, “গাজার অন্তত ৫ লাখ ৭৬ হাজার বা মোট জনগোষ্ঠীর এক চতুর্থাংশ মানুষ দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন। এই কর্মকর্তা হুঁশিয়ারি দেন যে, জরুরি উদ্যোগ না নেয়া হলে গাজার সব এলাকায় বড় আকারে দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়বে।”

১৯ জুন ২০২৪ গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত ৭ অক্টোবর থেকে ইসরাইলি হামলায় ৩৭ হাজার ৩৯৬ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন সাড়ে ৮৫ হাজারের বেশি। দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলের নানা নিপীড়ন সহ্য করে আসছে। তারই ভিত্তিতে হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলা যা ইসরাইলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দাম্ভিকতা পর্যুদস্ত করেছে। এই বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেন যে, ৭ অক্টোবর হামাস ইসরাইলে যে হামলা চালিয়েছিল, তা শূন্য থেকে হয়নি। তিনি এই বক্তব্যের মাধ্যমে ইসরাইলকে দায়ী করেন। আর ইসরাইলের অমানবিক আচরণই যে এই যুদ্ধের ইন্ধন জুগিয়েছে, তার বক্তব্যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়। ফিলিস্তিনিরা যখনই আত্মরক্ষার প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে, তখনই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইসরাইলের পক্ষ নিয়েছে। অপরদিকে আরব বিশ্ব আজ নিশ্চুপ দর্শকে পরিণত হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের এই চরম দুর্দশার মুহূর্তে আরব বিশ্ব নামমাত্র বিবৃতি দিয়ে আসছে।

১৫ অক্টোবর ২০২৩ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, “বিশ্লেষকরা বলছেন, মুসলিম বিশ্বের জনগণ ফিলিস্তিনের পক্ষে একাট্টা হলেও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কাঠামোর দুর্বলতার কারণে সরকারগুলোর পক্ষে শক্ত অবস্থান নেয়া অসম্ভব।” সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলছিলেন, মুসলিম বিশ্বে প্রভাবশালী আরব দেশগুলোর কেউ কেউ ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে আবার কেউ কেউ স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়ায় আছে। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “নিজেদের ক্ষমতাকে তারা চিরস্থায়ী করে রাখতে চায়। সঙ্গত কারণেই তারা হয়তো মনে করে পপুলার সেন্টিমেন্ট যাই হোক ইসরাইলকে ঘাঁটানো তাদের ঠিক হবে না। এ কারণেই তাদের কণ্ঠ উচ্চকিত দেখা যায় না।”

এছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক জটিল সমীকরণ, ভয়, প্রভুত্ব ইত্যাদি কারণে আরব বিশ্ব ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতে শক্তভাবে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারছে না। ওআইসি ও আরব লিগ আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দিলেও তা কাগজে-কলমে থেকে যায়। এক্ষেত্রে সংগঠনগুলোর উদ্দেশ্য ও কার্যকরিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। একমাত্র ইরান সবসময় সম্মুখ থেকে বিভিন্নভাবে এই সহিংসতার প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আসছে। অন্যদিকে তুরস্ক বিভিন্ন প্রতিবাদ জানালেও ন্যাটোসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কারণে কৌশলী অবস্থান নিয়েছে। অন্যান্য আরব দেশগুলোর তৎপরতা খুবই হতাশাজনক। ইসরাইল-হামাস যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের দ্বিমুখী আচরণ খুবই উদ্বেগজনক। নিজেদের মানবতার ফেরিওয়ালা হিসেবে আখ্যা দেয়া তাদের এই আচরণের নিরপেক্ষতার ব্যত্যয় ঘটে ইসরাইল-হামাস যুদ্ধে। বিষয়টি বর্তমানে আলোচিত দুটি ঘটনার সাথে তুলনা করা যাক।

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রুশ আক্রমণের পর থেকে ব্যাপকভাবে নিন্দার মুখে পড়ে রাশিয়া। সেই সাথে আন্তর্জাতিক নানা নিষেধাজ্ঞার কবলেও পড়তে হয়। আর রাশিয়ার অর্থনীতিকে ভেঙে দিতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। এমনকি এই আগ্রাসনের কারণে বিভিন্ন অভিযোগ দায়ের করে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। অপরদিকে, হামাস নির্মূলের নামে ইসরাইল যে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে তাতে ইসরাইলের কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় না। ইসরাইল অনেক আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে। সর্বশেষ ইসরাইলের ঘোষিত রাফাসহ বেশকিছু অঞ্চল নিরাপদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞাকে উপেক্ষা করে সেখানেও হামলা চালানো হয়। এতে মানুষের শেষ নিরাপদ আশ্রয়স্থল আর বাকি থাকল না। এছাড়াও সাধারণ ফিলিস্তিনিদের খাদ্য, চিকিৎসা, পানি, বিদ্যুৎ ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় সকল কিছু থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুসহ কিছু উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে যুক্তরাষ্ট্র সেই সংগঠনের কর্মকর্তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ার কথা বলে। এক্ষেত্রে যুদ্ধের সকল আইন লঙ্ঘন করলেও ইসরাইলের কোনো অপরাধ হয় না।

এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া সমর্থন হিসেবে বিলিয়ন বিলিয়ন অস্ত্র সহায়তা তো রয়েছেই। তাদের কথা হলো, নিজেদের প্রভাব বলয় টিকিয়ে রাখতে যেভাবেই হোক ইসরাইলকে নগ্ন সমর্থন অব্যাহত রাখা। তারা সবসময়ই বলে আমরা যুদ্ধ চাই না; কিন্তু নিজেদের প্রভাব বলয় টিকিয়ে রাখতে সকল অপকর্ম তারা করে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সকল আইন যেন তাদের কাছে অসহায়। ২০ জুন ২০২৪ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, ফিলিস্তিনের গাজায় চলমান হামলায় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছে ইসরাইল। একই সঙ্গে গত ৭ অক্টোবর ইসরাইলে চালানো হামলায় যুদ্ধাপরাধ করেছে হামাসসহ ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠনগুলোও। জাতিসংঘের মানবাধিকার পর্ষদের এক তদন্ত প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। এ-সংক্রান্ত তদন্তে বলা হয়েছে, গাজায় যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ দায়ী। অধিবেশনে পর্ষদের চেয়ারপারসন নাভি পিল্লাই বলেন, “ইসরাইল জোর করে গাজার প্রায় পুরো জনগোষ্ঠীকে ছোট আবদ্ধ এলাকায় ঠেলে দিয়েছে, যা অনিরাপদ এবং বসবাসের অযোগ্য।” তিনি আরও বলেন, “ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ব্যাপক ধ্বংস ক্ষমতার অস্ত্রের উদ্দেশ্যমূলক ব্যবহার দৃশ্যত বেসামরিক জনগোষ্ঠীর ওপর ইচ্ছাকৃত ও সরাসরি হামলাই ছিল।” জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী, সম্প্রতি ইসরাইলের হামলায় কমপক্ষে ২ লাখ ৫০ হাজার ফিলিস্তিনি খান ইউনিসের শরণার্থী শিবির এবং তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। এতে গাজায় বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৯ লাখ। বলা যায়, গাজার প্রায় সব বাসিন্দাই কোনো না কোনোভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) জানায়, ইসরাইলের হামলা শুরুর পর থেকে গাজায় নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা ৩৭ হাজার ৯৫৩। আর আহত হয়েছেন অন্তত ৮৭ হাজার ২৬৬ জন। সংবাদমাধ্যম ট্র–থআউটকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বিশ্বখ্যাত ভাষাবিদ, রাজনীতি বিশ্লেষক ও ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলোজি, এমআইটির ইমেরিটাস অধ্যাপক নোয়াম চমস্কি ফিলিস্তিন ইস্যুতে বলেন, “বছরের পর বছর ধরে ফিলিস্তিনিদের জেরুজালেমের পবিত্র শহর থেকে উচ্ছেদের চেষ্টা করে আসছে ইসরাইল সরকার।

গাজায় ইসরাইলের সর্বশেষ হামলাও এই পরিকল্পনারই অংশ। তবে ইসরাইলের সাম্প্রতিক এসব হামলার মূল উদ্দেশ্য বুঝতে হলে তাদের যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত এই ‘আগ্রাসন ও উচ্ছেদের’ কৌশলটি আমাদের বুঝতে হবে। কীভাবে ফিলিস্তিনিদের ওপর একের পর এক হামলা চালিয়ে তাদের আতঙ্কিত করে বাস্তুচ্যুত করার চেষ্টা করা হচ্ছে, সেটিও জানতে হবে।” নানাভাবে ইসরাইলে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা সমর্থন পেয়েই এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। শিশু, নারীসহ সকল নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা, আবাসন, স্কুল, হাসপাতাল ধ্বংস ও চিকিৎসা সুবিধাসহ নানাদিক থেকে মৌলিক অধিকারটুকু কেড়ে নিয়েছে। সকল মানবাধিকার লঙ্ঘন করা সত্ত্বেও  যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের চোখে ইসরাইল নিষ্পাপ। ইসরাইল হামাস নির্মূলের দোহাই দিয়ে যে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে তা সম্পূর্ণ অজুহাত মাত্র। তারা এই হামলার কারণ হিসেবে ৭ অক্টোবর ২০২৩ সালে হামাসের হামলাকে দায়ী করছে। কিন্তু ইসরাইল প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে যুগ যুগ ধরে নানাভাবে যে নিপীড়ন করে আসছে তা তথাকথিত মানবতার ফেরিওয়ালা হিসেবে চিহ্নিত যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা উপেক্ষা করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে মুসলিম দেশগুলোকে নিজস্ব স্বার্থকে উপেক্ষা করে ধর্মীয় ও মানবিক দিককে প্রাধান্য দিতে হবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের রক্তচক্ষুকে ভয় না করে একজোট হতে হবে। এতেই ইসরাইল-ফিলিস্তিন ইস্যু স্থায়ী সমাধানের মুখ দেখবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

মানবকণ্ঠ/এসআরএস