Image description

একটি ক্লাসরুমের সৌন্দর্য হলো শিক্ষার্থীরা। সেখানে তারা আজ রাজপথে। বিষয়টি দৃষ্টিকটু হলেও সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিরুপায়, কারণ তাদের ন্যায্য দাবি আদায় করতে হবে। সম্প্রতি দেশ উত্তাল কোটা প্রথার বিরুদ্ধে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা চায় বৈষম্যযুক্ত কোটা সংস্কার করে চাকরিতে নিয়োগ হোক মেধার ভিত্তিতে।

এই কোটা আসলে কি? কোটা হলো একটি ব্যবস্থা যা সমাজের অনগ্রসর এবং সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের বিশেষ সুবিধা প্রদান করে। এর উদ্দেশ্য হলো রাষ্ট্রে সমতা বজায় রাখা এবং নাগরিক হিসেবে কেউ যেন বৈষম্যের শিকার না হয়। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের উপহার স্বরূপ কোটা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। তবে সেটি ছিল বিশেষ সময়ের জন্য। স্থায়ী উদ্দেশ্যে নয়। সংবিধানের তৃতীয় ভাগের ২৯ নাম্বার অনুচ্ছেদের (৩) এর (ক) তে বলা হয়েছে, নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করিতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে তাহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান-প্রণয়ন করা হতে, রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না। সেক্ষেত্রে তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা কোটা যৌক্তিক ছিল কারণ মুক্তিযোদ্ধারা দেশের বীর সন্তান। তাদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশ স্বাধীনতার সূর্য দেখার সুযোগ পেয়েছে। নিজের জীবনবাজি রেখে তারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন এবং এ জীবনযুদ্ধে তাদের উপর ক্ষয়ক্ষতির প্রভাব পড়েছে সেক্ষেত্রে তাদের মুক্তিযোদ্ধা কোটা প্রাপ্য। অস্থায়ী উদ্দেশ্যে প্রবর্তিত হলেও এ কোটা পরবর্তীতে স্থায়ী করা হয়।

২০১০ সালে কোটা সংস্কার করে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০%, নারী কোটা ১০%, জেলা কোটা ১০%, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ৫% এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য ১% সহ মোট ৫৬ শতাংশ কোটার ভিত্তিতে নিয়োগের সুবিধা প্রদান করা হয়। সাধারণ শিক্ষার্থীর তুলনায় কোটাধারী শিক্ষার্থীর অনুপাত বেশি হওয়ায় নিয়োগ ক্ষেত্রে ঘটছে বৈষম্য এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামে এবং সেসময় সরকার ১ম ও ২য় শ্রেণিতে সমস্ত কোটা বাতিল করেন। কিন্তু ২০২৪ সালে এসে হাইকোর্ট আবারও সমস্ত শ্রেণিতে কোটা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত জানানোতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আজ নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত এবং চরম দ্বিধাগ্রস্ত। কারণ যেখানে ৫৬ শতাংশ কোটায় নিয়োগ এবং অবশিষ্ট ৪৪ শতাংশ সিট বরাদ্দ সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য।

মুক্তিযোদ্ধা কোটা রয়েছে ৩০%। যেখানে কোটা বরাদ্দ রাখা হয়েছে অনগ্রসর অংশের জন্য সেখানে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর এসে মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিদের অনগ্রসর ভাবা কতোটা যৌক্তিক এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে জনমনে। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পর্যন্ত এ কোটা রাখা খুব বেশি অযৌক্তিক নয় কারণ পিতার অনুপস্থিতির প্রভাব সন্তানের উপর পড়তে পারে সেক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের সুন্দর জীবনের জন্য সন্তান প্রজš§ পর্যন্ত কোটা যৌক্তিক ছিল। এছাড়াও নারী কোটা বরাদ্দ ১০% কিন্তু স্বাধীনতার অর্ধশতাধিক বছর পর আজ নারীদের অবস্থান লক্ষণীয় হারে পাল্টেছে। প্রতিটি পদে নারীরা নিজ যোগ্যতায় যেভাবে এগোচ্ছে সেখানে নারীদের অনগ্রসর অংশ হিসেবে বিবেচনার অবকাশ নেই। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী এবং প্রতিবন্ধীরা অনগ্রসর অংশ হিসেবে কোটার আওতায় থাকা যৌক্তিক কারণ তারা অনেকটাই পিছিয়ে। কিন্তু অন্যান্য বৃহদাংশ কোটার আওতায় থাকার ফলে বঞ্চনার শিকার হচ্ছে সাধারণ মেধাবী শিক্ষার্থীরা। চাকরি ক্ষেত্রে নিয়োগে অনেক সময় মেধাবী শিক্ষার্থীরা কোটাধারীদের চেয়ে বেশি নাম্বার প্রাপ্ত হয়েও কোনো চাকরি পায় না। এছাড়া তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে কোটার পরিমাণ আরও বেশি। এমনিতেই বেকারত্বের বোঝা তার উপর এমন বৈষম্যের জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। সম্প্রতি আবার বিসিএস এর প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ছাত্রদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এদেশের সিংহভাগ শিক্ষার্থীরা নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করে দুচোখ ভরা স্বপ্ন দেখে কর্মসংস্থান করে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সেবা করার, পরিবারের হাল ধরার। দিনমজুর পিতা রক্ত ঝরানো ঘামের উপার্জনে সন্তানকে পড়াশোনা করাচ্ছেন। অসহায় মা যার কাছে শেষ সম্বল বলতে সামান্য একটা সোনার গহনা সেটিই বিক্রি করে সন্তানকে চাকরির পরীক্ষায় বসাতে পেরেছে এমন করুণ সংগ্রামের নজির কিন্তু অহরহ। সেই সাধারণ শিক্ষার্থীরা আশায় বুক বাঁধে একদিন চাকরি পেয়ে বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটানোর। রাতের পর রাত জেগে সময় যায় পড়ার টেবিলে কিন্তু চাকরির নিয়োগে আর মেলে না ঠাঁই। অক্লান্ত পরিশ্রমের পরেও যখন মেধাবী শিক্ষার্থীরা তাদের কাক্সিক্ষত পদ-লাভের সুযোগ পাচ্ছে না তাদের হতাশা বুঝবে কে?

আজকের তরুণরাই আগামীর ভবিষ্যৎ। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সকলের উচিত কয়েক বছর পর পর তদন্তমূলক অনগ্রসর অংশের জরিপ করা যাতে সত্যিকারের সুবিধাবঞ্চিত মানুষরা সুযোগ পায় এবং দেশে যেন মেধার মূল্যায়ন অব্যাহত থাকে। তবেই সম্ভব বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গঠন করা।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

মানবকণ্ঠ/এসআরএস