প্রতিটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রেরই নিজস্ব আইন রয়েছে। সে অনুযায়ী সব বিচার প্রক্রিয়া সম্পাদিত হয়। আর এটার ব্যত্যয় ঘটলে বিচারকার্য বিঘ্নিত হয়, সৃষ্টি হয় অপ্রত্যাশিত বিশৃঙ্খলা বা মব জাস্টিস। ‘২৪ এর জুলাই’ গণঅভ্যুত্থানে পতন হয়, দীর্ঘ ১৫ বছরের আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদী আচরণ, দুর্নীতি আর অবর্ণনীয় দমন-পীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে উঠে দেশের মানুষ। যার চূড়ান্ত বিস্ফোরণ ঘটে ৫ আগস্ট। পতন ঘটে দেড় দশকের দুঃশাসনের। জনরোষ থেকে বাঁচতে শেখ হাসিনা পালিয়ে যান প্রতিবেশী দেশ ভারতে। একইসঙ্গে পালিয়ে যান আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী, সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা। তবে এরইমধ্যে পালাতে গিয়ে সীমান্তে ধরাও পড়েছেন কেউ কেউ। সীমান্ত পার হতে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। তবে যারা পালাতে পারেননি তারা পড়েছেন তীব্র জনরোষে। যার ফলশ্রুতিতে অনেকেই গণপিটুনির স্বীকার হয়। এমন সব ঘটনাগুলোকে গণমাধ্যমগুলোতে বলা হচ্ছে ‘মব জাস্টিস’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের কিছু শিক্ষার্থীরা মানসিক বিকারগস্ত তোফাজ্জল নামে এক যুবককে চোর বলে পিটিয়ে হত্যা করেছে যা দেশের মানুষকে শঙ্কিত করেছে আমাদের মেধাবীদের নিয়ে তারা মনুষ্যত্ব বিপর্যস্ত আচরণ করলো কিভাবে! তারা দেশের ভবিষ্যতের কর্ণধর। এর আগে বুয়েটের আবরার হত্যা কাঁদিয়েছে দেশের মানুষকে। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়েও এমন হত্যা হয়েছে। আমরা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেধাবীদের মানুষ হওয়ার শিক্ষা প্রত্যাশা করি সবার আগে।
মব জাস্টিস সংগঠিত হওয়ার পেছনে মোটাদাগে দশটি কারণ উল্লেখ করা যায়। এসব কারণের মধ্যে রয়েছে। আইন-প্রণয়নের অভাব যদি জনগণ মনে করে যে, আইন প্রণয়ন বা তার প্রয়োগ সঠিকভাবে হচ্ছে না, তখন তারা নিজস্ব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। অব্যবস্থাপনা, প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থা যদি দুর্বল বা অকার্যকর হয়, তখন মানুষ নিজের হাতে ব্যবস্থা নিতে পারে। জনগণ যদি একটি ঘটনায় গভীর ক্ষোভ বা অসন্তোষ অনুভব করে, তারা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে মব জাস্টিসের আশ্রয় নিতে পারে। কখনও কখনও সামাজিক বা রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে জনগণ আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলতে পারে এবং নিজস্ব বিচার ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকতে পারে। স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া কিছু ক্ষেত্রে, অসন্তোষ বা ক্ষোভের কারণেই লোকেরা তৎক্ষণাৎ প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং মব জাস্টিসের দিকে চলে যায়। রাজনৈতিক প্রভাবে রাজনীতিবিদরা প্রায়শই বিচারব্যবস্থাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে, নিজেদের বা তাদের সমর্থকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য। অর্থনৈতিক প্রভাব ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা প্রায়ই বিচারব্যবস্থাকে কিনে নিতে পারে, নিজেদের অপরাধ থেকে মুক্তি পেতে। সামাজিক বৈষম্যে নিম্নবর্গের মানুষের জন্য ন্যায়বিচার পাওয়া অনেক কঠিন হতে পারে, কারণ তাদের কাছে ভালো আইনজীবী নিয়োগ করার মতো সামর্থ্য না-ও থাকতে পারে। যদি বিচার বিভাগ দুর্বল হয়, তাহলে তা সহজেই রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক চাপে নতি স্বীকার করতে পারে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো যদি দুর্বল হয়, তাহলে তারা অপরাধীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারে না এবং মিথ্যা মামলা চালু করতে পারে। তখন নানা অপ্রকাশিত ঘটনার জš§ হয় যার সমাধান হয় না কখনো। মব জাস্টিস বন্ধ ও প্রতিরোধ করার জন্য আমাদেরকে একটি শক্তিশালী ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সরকারকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো শক্তিশালী করতে হবে এবং দুর্নীতি দমনে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, জনগণকে সচেতন হতে হবে তাদের অধিকার সম্পর্কে এবং মব জাস্টিসের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। বিভিন্ন প্রচারণা ও ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে জনগণকে সর্বোচ্চ সচেতন করতে হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
মানবকণ্ঠ/এসআরএস
Comments