শিক্ষাকে বলা হয়ে থাকে জাতির মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ড ছাড়া যেমন মানুষ দাঁড়াতে পারে না, তেমনি শিক্ষা ছাড়াও একটি জাতি উন্নতি ও সমৃদ্ধির শিখরে দাঁড়াতে পারে না। বিশ্বের বুকে যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সে জাতি তত বেশি উন্নত ও সমৃদ্ধ। শিক্ষা ছাড়া একটি রাষ্ট্রের সুষম উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। একটি জাতিকে ধ্বংস করে দিতে চাইলে শুধু এর শিক্ষাব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিলেই চলে।
ইতিহাসের পাতা উল্টালে আমরা দেখবো, একটি জাতিকে ধূলিসাৎ প্রকল্পে শিক্ষার ওপরই আক্রমণ হয়েছে সবার আগে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অনেক বড় বড় যুদ্ধে বিজয়ীশক্তি পরাজিত জাতির লাইব্রেরি ধ্বংস করে দিয়েছে যেন সে জাতির শিক্ষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য সম্পর্কে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে না হতে পারে।
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বলতে হয় বাংলাদেশে বর্তমানে কোনো শিক্ষানীতির কার্জকর নেই, বহুবিধ ধারায় শিক্ষাব্যবস্থা চলছে, শিক্ষা এখন পণ্যে পরিণত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক ভাবধারায় সিলেবাস ভারাক্রান্ত, শিক্ষার নামে অবাধে চলছে সার্টিফিকেট-বাণিজ্য, শিক্ষার মান আশঙ্কাজনকভাবে নিচে নেমে এসেছে। আমাদের পাসের হার এবং জিপিএ-৫ পাওয়ার সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে, কিন্তু অর্জিত হচ্ছে না ‘কাক্সিক্ষত মান’। যার নজির আমাদের বর্তমান শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেখা যায়। ফলে কোয়ালিটি শিক্ষাব্যবস্থা থেকে আমরা দূরে সরে আছি। আমাদের শিক্ষার মান বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার মান কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালে বোঝা যায়।
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ দিন দিন বিলীন হয়ে যাচ্ছে। অপরাজনীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর অপশাসনে ভারাক্রান্ত দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ। বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্ব হলো শিক্ষার্থী। মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা বড়ো বড়ো স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে এসে এখানে অনিয়ম, অপশাসন, অব্যবস্থাপনার বেড়াজালে আটকা পড়েন। এসব বেড়াজালে অনেককেই জীবন বলি দিতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ হলো গবেষণা। অথচ এখানে নেই গবেষণা, নেই গবেষণার গুরুত্ব, অন্যের থিসিস চুরি করে ডিগ্রি নেয়া হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন পরিণত হয়েছে শুধু ‘আমলা-কেরানি’ তৈরির কারখানায়।
এখানে মুক্তচিন্তার চর্চা নেই, মুক্তমতের স্বাধীনতা নেই, নেই সাংস্কৃতিক চর্চা। দাসত্ব, তেলবাজি, চাটুকারিতা, মেরুদণ্ডহীনতায় ভর দিয়ে চলছে এখন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ। গুণগত শিক্ষা সংকট, আবাসন সংকট, সুষম খাদ্যের অপ্রতুলতা, চিকিৎসা সেবা, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, এসব মৌলিক সংকট ও সমস্যায় জর্জরিত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ।
আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন আর প্রকৃত অর্থে বিশ্ববিদ্যালয় নেই। দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে, কিন্তু সেখানে শিক্ষার মান কতটুকু বাড়ছে, সে প্রশ্ন না ওঠে পারে না। আমরা জেলায় জেলায় বা মোড়ে মোড়ে বিশ্ববিদ্যালয় চাই না, যেগুলো আছে সেগুলোর মানোন্নয়ন চাই, সেগুলোতে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ চাই, সেগুলোকে প্রকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেখতে চাই।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসনের নামে দাসবৃত্তি করছে। ফলে তারা তাদের নিজেদের শক্তি সামর্থ্য নিজেরা কাজে লাগাতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আগের মতো সুস্থ্য ধারার রাজনীতি নেই, নেই গণতান্ত্রিক পরিবেশ, মুক্তবুদ্ধির চর্চা। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগে দেখা যায় অস্বচ্ছতা; অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও অনিয়মে ভারাক্রান্ত বিশ্ববিদ্যালয়সূহ। রাজনৈতিক লবিং-এ ছেয়ে গেছে উচ্চশিক্ষার উচ্চ পদসমূহ। ফলে শিক্ষা তার প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হচ্ছে। আর তাই বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আমাদের অবস্থান দিন দিন তলানিতে গিয়ে ঠেকছে। এখনই এসবের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে আমাদের উচ্চশিক্ষার পথ অচিরেই অন্ধকারের অতলে তলিয়ে যাবে। শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য, শিক্ষায় বৈষম্য দূর না করতে পারলে, একটি যুগোপযোগী কার্যকরী শিক্ষা কমিশন গঠন এবং এর বাস্তবায়ন না করতে পারলে শিক্ষার সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব হবে না।
সার্বিকভাবে শিক্ষা খাত পুনর্গঠনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা খাত, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানোন্নয়নে বিশেষ নজর দিতে হবে। তাছাড়া বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর আরোপিত ট্যাক্স প্রত্যাহার করতে হবে, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ করতে হবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গণতান্ত্রিক পরিবেশ, মূল্যবোধ ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিক সহিংসতামুক্ত করতে হবে। সর্বোপরি, একটি মানসম্মত, যুগোপযোগী ও কল্যাণকর শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠুক- এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
মানবকণ্ঠ/আরএইচটি
Comments