Image description

বাংলাদেশে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ফেসবুক। বিশ্ব কাঁপছে ফেসবুকজ্বরে, তবে বাংলাদেশের মতো অতটা বাড়াবাড়ি রকমে নয়। ফেসবুককে বলা হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। কথাটা কতটুকু সত্য তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। এর জনপ্রিয়তার পেছনে অন্যতম কারণ সহজ ব্যবহার। প্রচুর মন্দের বিপরীতে ফেসবুকের ভালো কিছু দিক অবশ্যই আছে। 

নইলে মানুষ এত আকৃষ্ট হবে কেন, কেনই বা ঝুঁকবে! সব মিলিয়ে ফেসবুক তরণী তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে। আগামীতে আরও বড় জয় আনবে- এটাই স্বাভাবিক। অবস্থাটা এমন- অনেকেই কম্পিউটার বোঝে না, ইন্টারনেটও না কিন্তু ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট আছে! পিছিয়ে থাকবে কেন অন্যদের কাছ থেকে, কীভাবে উপেক্ষিবে সময়ের আহ্বান! 

আগুনের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে যেমন অসাধ্য সাধন করা যায়, একই আগুন ব্যবহার করে সবকিছু পুড়িয়ে ভস্মও করে দেয়া যায়। নির্ভর করে ব্যবহারের ওপর। কীভাবে কাজে লাগাচ্ছি সেটা। ইতিবাচক দিকের কথা চিন্তা করলে, মোটা দাগে ভালো দিকটা আগে আসে। হারিয়ে যাওয়া বন্ধু কিংবা প্রিয়জনকে খুঁজে দিতে ফেসবুক অদ্বিতীয়। জীবনপথের নানা বাঁকের বিভিন্ন মানুষকে কাছে এনে জড়ো করে দেয় ফেসবুক। 

পরস্পরের সাথে যোগাযোগ রাখতে, ভাবনাটুকু শেয়ার করতে, কে কী করছে না করছে জানতে সাহায্য করছে ফেসবুক। এখন দুনিয়া ঘুরে কাউকে খুঁজতে হয় না। বন্ধুর মুখ শুধু দেখাই যায় না, তার সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবগত হওয়ার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ছবিও ভাসে চোখের সামনে। এজন্য শুধু কম্পিউটারের মাউসের একটি ক্লিক, স্মার্টফোনে একটি চাপই যথেষ্ট। 

নেতিবাচক দিকের কথা বললে, অনেককেই অসামাজিক করে তুলছে সামাজিক সাইটটি। ফেসবুকের বন্ধু সংখ্যা নিয়ে সন্তুষ্ট না, অনেক বন্ধু লাগবে, সুতরাং যাকে তাকে- অচেনা-অজানা ব্যক্তিকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানো শুরু করে অনেকেই। এতে যদিও নেটওয়ার্ক জ্যাম খেয়ে যায়, ফেসবুক থেকে সতর্কবার্তা দেয়া হয় কিন্তু কীর্তিমানের কাজ কি থেমে থাকে! ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে বা অ্যাকসেপ্ট করে প্রতিনিয়ত বন্ধুসংখ্যা বাড়িয়ে চলছি আমরা। কী সহজ সূত্র, হাত বাড়ালেই বন্ধু! রিকোয়েস্ট পাঠালে বন্ধু, না পাঠালেও বন্ধু! যদিও এসব বন্ধুর অধিকাংশ একটা সংখ্যা মাত্র, তাও বায়বীয়। 

এমনতর বন্ধু সংস্কৃতির ভালো দিক নিশ্চয়ই আছে কিন্তু এতে করে যে পাশের বাড়ির মানুষটি, ঘরের আপন লোকটি উপেক্ষিত হচ্ছে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করার সময়ইবা কই আমাদের? রাতদিন ফেসবুক নিয়েই যত ধ্যান-জ্ঞান! খাবার সময় হয়েছে- ভাই-বোন বা স্বয়ং মা এসে ফেসবুকে নিমগ্নকে আহ্বান করলেন। শুনতে হয় উল্টো ঝাড়ি- দেখছ না কাজে ব্যস্ত আছি! 

এভাবে ফেসবুক কাছের মানুষ, পাশের মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। ফেসবুকের বন্ধু, যাদের আমরা চিনি না, জানি না- জীবনে তাদের অনেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। এই অধরা লোকরা কতটুকু বন্ধু সে প্রশ্ন থেকেই যায়। অথচ এদের জন্যই কেন প্রতিবেশী মানুষটাকে বঞ্চিত করছি? পথে-ঘাটে দেখা হলে কেন কুশলাদি জিজ্ঞেস করব না? বিশেষ কোনো আয়োজনে বা উৎসবের দিনে দাওয়াত দেব না! ভার্চুয়াল জগৎ যে মোহ সৃষ্টি করে দেয় চোখে, সে চোখ কি আর সাদাকে সাদা, কালোকে কালো দেখে? চোখের তো রংধনু, যেদিকেই তাকায় সব রঙিন, স্বপ্নময়।

ফেসবুক বিতর্কের প্লাটফর্ম হিসেবেও উপস্থিত হচ্ছে। কোনো একটা বিষয়ে তর্কবিতর্ক, মন্তব্য-পাল্টা মন্তব্যের ভেতর দিয়েই বেরিয়ে আসছে সমাধান। সমাধান না এলেও বিষয়টার ওপর যথার্থভাবে আলোকপাত করা যাচ্ছে। বহু বছর আগে লেখক মাইনুল এইচ সিরাজী স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন- নোয়াখালীর লোকজন নিজেদের নোয়াখাইল্যা হিসেবে পরিচয় দিতে সংকোচ বোধ করে কেন?

এ স্ট্যাটাসের পক্ষে-বিপক্ষে অনেক মন্তব্য এসেছে। প্রশ্নের যথার্থ জবাব খুঁজে পাওয়া না যাক, মূলে যাওয়ার চেষ্টাটুকু তো হয়েছে! বন্ধুর জন্মদিন কজনই বা মনে রাখতে পারি, কজনের জন্ম-তারিখ মনে রাখা সম্ভব? কিন্তু অসম্ভবকে সম্ভব করেছে ফেসবুক। সকালে ঘুম ভাঙলেই দেখা যায়, আজ কোন কোন বন্ধুর জন্মদিন। সে অনুযায়ী বন্ধুকে শুভেচ্ছা জানাই। বন্ধু খুশি শুভেচ্ছা পেয়ে, নিজেরা সন্তুষ্ট পাশে থাকতে পেরে। ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গ যোগাযোগ নির্বিঘ্ন করতেই প্রতিষ্ঠা করেছেন সাইটটি। প্রতিষ্ঠাকালে নিশ্চয়ই তিনি আঁচ করতে পারেননি কী রকম বৈপ্লবিক কাণ্ড ঘটাতে যাচ্ছেন! ইতিহাসে স্থায়ী আসন পেয়ে গেছেন ইতোমধ্যে। কিছু অপব্যবহার রোধ করতে পারলে ফেসবুক হয়ে উঠবে আরও গ্রহণযোগ্য। 

বড় একটি অপব্যবহার হচ্ছে ফেক আইডি। বিকৃত রুচির মানুষ কম নেই। কুরুচিসম্পন্ন মানুষ তারকা তথা সেলিব্রেটিদের নাম ব্যবহার করে ফেক আইডি খোলে। নিজেদের বিকৃত আনন্দ চরিতার্থ করতে পরিচালনা করে ‘সেলিব্রেটি অ্যাকাউন্ট’। আর্থিক প্রতারণা বা কেলেঙ্কারিতেও জড়ায় এসবের মাধ্যমে। নাটক ও চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় নায়ক-নায়িকার নামে আইডি খুলতে পছন্দ করে এরা। লেখকদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, হুমায়ূন আহমেদ, ধ্রুব এষ প্রমুখের ফেক আইডি আছে। 

হুমায়ূন আহমেদের জীবদ্দশায় তার নামে কেউ কেউ অ্যাকাউন্ট খুলেছে, সেটা না হয় মানা গেল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, জীবনানন্দ’র নামে যে অ্যাকাউন্ট খুলেছে কী উদ্দেশ্যে, কী স্বার্থ নিহিত এখানে! কেউ যদি ফেসবুকে ভারতীয় জনপ্রিয় অভিনেত্রী রানি মুখার্জির নাম লিখে সার্চ দেয় কমসে কম পাঁচশ’টা অ্যাকাউন্ট পাবে! এসবের মধ্যে কোনটা রানির, ব্লু ব্যাজ থাকলে বের করা সহজ। 

নইলে অন্ধ চোরাবালিতে পড়ে হোঁচট না খেয়ে উপায় নেই। বাংলাদেশের শোবিজ অঙ্গনের সেলিব্রেটিরাও প্রতিনিয়ত এমন সমস্যা মোকাবিলা করছেন। ভক্তরা (!) ভক্তিবশত এমন কাজ করে থাকে! মেয়েদের নামে অ্যাকাউন্ট খুলেও তারা মজা পায়। কলি, ঘোর কলি! ভয়াবহ একটি তথ্য জেনেছি কিছুদিন আগে। অনেক ছেলেরই নাকি দুটি করে অ্যাকাউন্ট আছে। 

এবার সেটা একটি মেয়ে-নামে হোক বা দুটিই ছেলে-নামে হোক। মোদ্দা কথা, একটি ভদ্র অ্যাকাউন্ট অন্যটি সেই অ্যাকাউন্ট যেটাতে সব সম্ভব, সব ধরনের কার্যক্রম চালাবে। মন চাইলে অকথ্য ভাষায় গালি দেবে, যাচ্ছেতাই লিখবে, যেমন-তেমন ছবি আপলোড করবে...। ভদ্রতার মুখোশটুকু ধরে রাখার কষ্ট নেই। মানুষের দ্বৈতসত্তা পরিস্ফুটিত করার নির্ভরযোগ্য জায়গা হয়ে উঠেছে ফেসবুক!

ধানের মধ্যে চিটা থাকে, চিটাটা ধানের মতো হলেও কেউ সেটাকে ধান বলে না। চিটা ফেলে দেয়ার জিনিস; হালকা বাতাসে উড়ে যায়। সুতরাং চিটাকে হিসাবে না রাখলেই চলে। আজকাল কোনো কোনো ময়-মুরুব্বি হাপিত্যেশ করে বলেন, ফেসবুক করে করে প্রজন্ম উচ্ছন্নে গেল! চরিত্র গেল, চোখ গেল, মূল্যবোধ গেল। খেদোক্তি শুনে চিটার কথা মনে হয়। একশ্রেণির উন্দ্ধন্ত নেশারুর জন্য ইতিবাচক একটা জিনিসকে প্রশ্নবিদ্ধ করা অনুচিত। ধানের চেয়ে চিটার হার বেশি হতেই পারে, তাই বলে চিটার উপর রাগ করে কেউ কি সোনার ধান ফেলে দেয়!

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক