একটা জাপানি প্রবাদ আছে ‘অধ্যবসায়ের সাথে হাজার দিন অধ্যয়ন করার চেয়ে একজন মহান শিক্ষকের সান্নিধ্যে একদিন থাকা আরও উত্তম।’ কারণ একজন মহান শিক্ষক ছাত্রদের ব্যক্তিত্বকে শাণিত করে এবং অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার স্পৃহাকে জাগ্রত করে দেন। একজন প্রকৃত শিক্ষক তার শিষ্যের জীবনতরীর অরিত্র হিসেবে কাজ করেন। শিক্ষকগণই পারেন প্রতিটি মানুষকে সমাজিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে। শিক্ষকগণ প্রতিটি ছাত্রের শৈশবে তাদের অন্তরে যে ভ্রাতৃত্ব, সাম্য, শৃঙ্খলা ও মহানুভবতার বীজ বপন করে দেন, তা দিয়েই সামাজিক মূল্যবোধের ভিত রচিত হয়। নইলে সামাজিক বিশৃঙ্খলা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়তো। তাই একজন শিক্ষকের কর্মকে শুধু তার কর্মঘণ্টার প্রেক্ষিতে হিসাব করলে হবে না।
আমাদের দেশে অর্থনীতিতে বা জিডিপিতে শিক্ষকদের ভূমিকা কতটুকু তার কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও এক্ষেত্রে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। একজন শিক্ষকের মেধা, মননশীলতা ও কর্মের বহুমুখী প্রয়োগ রয়েছে। মানুষ দ্বারাই একটি সমাজ, দেশ ও জাতির কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। মানুষের এই কর্মকাণ্ড যত বেশি ইতিবাচক ও পরিশুদ্ধ হবে, একটি দেশ তত বেশি উন্নত হবে। মানুষের এই কর্মকাণ্ডকে ইতিবাচক করে তোলার জন্য শিক্ষকগণ প্রতিটি মানুষকে তাদের ছাত্রাবস্থায় হাতে-কলমে শিক্ষা দিয়ে থাকেন। আবার যে জাতি যত বেশি মেধাবী সে জাতি তত বেশি উন্নত। মানুষের শৈশব-কৈশোরে এই মেধা বিকাশের বীজ বপন ও পরিচর্যার মতো স্পর্শকাতর কাজটি করে থাকেন শিক্ষকগণই।
শিক্ষকগণ আনুষ্ঠানিক শিক্ষাদানের পাশাপাশি অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা দান ও গবেষণার কাজে মেধা, শ্রম ও সময় ব্যয় করে থাকেন। ফলে শিক্ষকগণ শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি কোনো জাতির ক্রান্তিকাল নিরসনকল্পে বা উন্নত দেশ গঠনে কখনো গুরু দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন কখনো বা জাতিকে দিক-নির্দেশনামূলক পরামর্শ প্রদান করে থাকেন। কোনো জাতির সম্মানজনক অস্তিত্ব বজায় রাখতে হলে নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চার গুরুত্ব অপরিসীম। নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়েই জাতীয়তাবাদের চেতনা বিকশিত হয়। কিন্তু এই বিশ্বায়নের যুগে আকাশ সংস্কৃতি আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আকাশ সংস্কৃতির এই অশুভ থাবা থেকে জাতিকে রক্ষা করতে শিক্ষকদের ভূমিকা অপরিসীম। কারণ শিক্ষার্থীকে জাতীয় সংস্কৃতি মনোভাবাপন্ন করে গড়ে তোলার কারখানা হলো বিদ্যাপীঠ। প্রশান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠায় মানবিক চৈতন্যবোধ সম্পন্ন মানুষের বড়ই প্রয়োজন।
আর মানবিক চৈতন্যবোধ সম্পন্ন মানুষ গড়ে তুলতে হলে শিশু এবং কৈশোর বয়সেই এর বীজ বপন করতে হয়। এই অত্যাবশ্যকীয় জটিল কাজে শিক্ষকগণই অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেন। মানুষের নৈতিক স্খলনজনিত কারণে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তর অশান্তির বিষবাষ্পে আক্রান্ত হয়। মানুষের সমস্ত পঙ্কিলতাকে বিনাশ করে নৈতিকবোধ সম্পন্ন মানুষ গড়ার কারিগর হলেন একজন মহান শিক্ষক।
সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণে শিক্ষকদের বহুমুখী ভূমিকা থাকলেও এদেশে এই সময়ে তাদের এই ভূমিকা অকিঞ্চিৎকর। কারণ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের পাশাপাশি শিক্ষকদের নিজেদের আর্থিক নিরাপত্তা অর্জনের জন্য তাদেরকে সংগ্রামী পথ বেছে নিতে হয়েছে। শুধু আর্থিক নিরাপত্তা অর্জনের দাবি আদায়ে তাদেরকে হরহামেশাই শিক্ষাঙ্গন ছেড়ে রাজপথে নামতে হয়। এতে পাঠদান ও গবেষণার কাজে তারা পুরোপুরি মনোনিবেশ করতে পারছেন না। অথচ শিক্ষকদের শুধু কাঙ্ক্ষিত আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে তাদের সামাজিক মর্যাদা কতটুকু প্রতিষ্ঠিত হবে সেটিও প্রশ্নবিদ্ধ। আর্থিক নিরাপত্তার পাশাপাশি সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত না হলে শিক্ষকগণ তাদের মহান দায়িত্ব পালনে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করতে পারবেন না। সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে হলে শিক্ষাঙ্গন ও শিক্ষাঙ্গনের বাইরে শিক্ষকদের ভূমিকাকে আরো গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে হবে।
আমাদের দেশে শিক্ষার্থী মূল্যায়নের মানসম্মত পদ্ধতির অভাব, পাঠ্যপুস্তকে অবাস্তব বিষয়বস্তু, শিক্ষণ ও শিখনের মধ্যে অসামঞ্জস্যতা ইত্যাদি শিক্ষাঙ্গনে একজন শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তাকে ম্লান করে দেয়। শিক্ষকদের নিয়োগ পদ্ধতি, শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, আধুনিক প্রযুক্তিজ্ঞানের অভাব, Pedagogy সম্পর্কে শিক্ষকদের যথেষ্ট জ্ঞানের অভাব, উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাব, প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পদ্ধতি, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে বহুমুখী শিক্ষার প্রচলন, অপরিকল্পিতভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আধুনিক অবকাঠামোর অভাব প্রভৃতি সমস্যা একজন শিক্ষকের মর্যাদাকে ম্লান করে রেখেছে।
বৈষম্যহীন বাংলাদেশ বিনির্মাণে স্মার্ট নাগরিক দরকার। আজকের শিশু-কিশোরদের স্মার্ট করে তুলতে পারলে দেশ ও জাতি স্মার্ট হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষকদেরই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। অতএব শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষকদের সকল সমস্যা দূরীকরণে সুদূরপ্রসারি পরিকল্পনা প্রণয়ন করে শিক্ষকদের আগে স্মার্ট করে তুলতে হবে এবং স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার কাজে তাদের আত্মনিয়োগ করাতে হবে। নইলে শিক্ষা, শিক্ষক, দেশ, জাতি কোনো কিছুরই অগ্রগতি সম্ভব হবে না। শিক্ষদের সামাজিক মর্যাদাও প্রতিষ্ঠিত হবে না।
লেখক: কলামিস্ট
Comments