Image description

অনেকটা নীরবেই চলে গেল পর্যটন দিবস। আগে সরকারপক্ষ আর যাই হোক, ক্রোড়পত্র বা বক্তৃতার মাধ্যমে হলেও বৃহৎ পরিকল্পনা প্রকাশ ও প্রচার করা হতো। বাংলাদেশের পর্যটন কোন কোন খাতে সম্ভাবনাময়- এসবও থাকত আলোচনায়।

জন্মগতভাবেই মানুষ ভ্রমণপিপাসু। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই ভ্রমণের নেশা মানুষকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। ভ্রমণের সুযোগ সবার হয় না। সেটা দৈহিক অসামর্থ্য, আর্থিক দৈন্য, অনাগ্রহ বা অন্য যে কোনো কারণেই হোক। সৌভাগ্যবান পর্যটকরা সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকেই দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। যে ধারা আজতক অব্যাহত। পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, মানুষ নানা কারণে ভ্রমণে উদ্যোগী হতো। 

মুসলমান সম্প্রদায়ের পবিত্র ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে বিদ্যার্জনে সুদূর চীন দেশে যদি যাওয়ার দরকার হয়, সেখানেও যেতে হবে। ধর্মীয় ভ্রমণও ভ্রমণের বড় একটা জায়গা দখল করে আছে। আগেকার দিনে মুসাফির নামে পরিচিত ভূপর্যটকরা দেশ থেকে দেশে ঘুরে বেড়াতেন। রাতের বেলা পথিপার্শ্বে কারও বাড়িতে আশ্রয় নিতেন কিংবা কোনো সরাইখানায়। মুসাফিরদের জন্য তৎকালে সরাইখানার ব্যবস্থা ছিল। 

সাধারণ মানুষও মুসাফিরদের সাহায্য করত আনন্দিত চিত্তে। বলাবাহুল্য, এসব সত্ত্বেও মুসাফিরদের বেশ বিপত্তিকর পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হতো। নিরাপত্তা, ক্ষুধা, অসুখ-বিসুখ ও পথ হারানোর আশঙ্কা তো থাকতই। সাংস্কৃতিক ভিন্নতা ও ভাষার পার্থক্যও ছিল বড় প্রতিবন্ধকতা। তখন বোধকরি সর্বজনীন কোনো ভাষা ছিল না। শিক্ষাদীক্ষার হারও ছিল নেহায়েত অপ্রতুল ও অনুল্লেখযোগ্য।

দিন পাল্টেছে। বর্তমানে ভ্রমণ অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় সহজ, অনায়াসসাধ্য। পৃথিবী আদতেই দিন-দিন হাতের মুঠোয় চলে আসছে। এখন আর ‘দিল্লি দূর অস্ত’ নয়। পুরো পৃথিবী পরিচিতি পাচ্ছে গ্লোবাল ভিলেজ নামে; আলাদা করে কাছে আর দূরে বলে কিছু থাকছে না। দেশ-বিদেশ ভ্রমণ এখন দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেশকিছু কারণে মানুষ ভ্রমণ করে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য- পড়াশোনা, ধর্মীয় কারণ, চিকিৎসাজনিত, পেশাজনিত। 

যারা যে কারণেই দেশ-বিদেশ গমন করেন না কেন, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এরা কিন্তু এক অর্থে পর্যটকই। এসবের বাইরে বেশ বড় একটা অংশের মানুষ নিছক ভ্রমণের জন্য দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়ান। ভ্রমণ যেমন আনন্দের অনুষঙ্গ, তেমনি জীবনের পাঠশালার সবচেয়ে বড় শিক্ষামাধ্যমও বটে। ভ্রমণের মাধ্যমে অতীতের গ্লানি যেমন ভোলা যায়, তেমনি জেগে নবস্পৃহায় কর্মউদ্দীপনা। একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পেতে ভ্রমণের বিকল্প নেই। 

বর্তমানে পর্যটন শিল্প পৃথিবীর অন্যতম কর্মসংস্থান শিল্পে রূপ নিয়েছে। পৃথিবীর বহু দেশ তাদের জাতীয় আয়ের বড় একটা অংশ পেতে শুরু করেছে এ খাত থেকে। বেকারত্ব দূরীকরণের পাশাপাশি লাভজনক শিল্প হিসেবে এটি পরিণত হওয়ায় দেশগুলোর অর্থনীতির পালে লেগেছে জোরালো হাওয়া। কেউবা তাদের পর্যটনকে পণ্য হিসেবে পর্যটকদের সামনে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে আবার কারও কারও না চাইতেই হয়ে গেছে। এখানটায় এসে বাংলাদেশ বেশ বড় একটি প্রশ্নচিহ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়। 

বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প এখনো তুলনামূলক পিছিয়ে। অথচ আরও অনেক কম পর্যটন পণ্য নিয়েও বিশ্বের অনেক দেশ লাভজনক অবস্থায় রয়েছে। নয়নাভিরাম ব-দ্বীপ বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থেই সোনার বাংলা। এদেশের রয়েছে বর্ণাঢ্য ইতিহাস-ঐতিহ্য, সেই সাথে যুক্ত হয়েছে নান্দনিক স্থাপনা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। তবু কেন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না বাংলাদেশের পর্যটন? এ প্রশ্নের গভীরে যাওয়ার বিদ্যমান বেশকিছু সমস্যা সামনে এসে দাঁড়ায়। 

স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৪০ বছরেও বাংলাদেশ স্থিতিশীল অবস্থায় পৌঁছাতে পারেনি। শাসকশ্রেণির অক্ষমতা. দূরদর্শিতার অভাব কিংবা যথার্থ প্রজ্ঞার অভাব ইত্যাদি অন্তরায় হিসেবে কাজ করেছে। এসব কারণে সত্যিকারের গণতন্ত্রের বিকশিত হতে পারেনি। এটা তো গেল একটি দিক। অন্যদিকে আলোকপাত করলে দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক অস্থিরতাকে আমলে নিতে হয়। বিদেশিরা বাংলাদেশের অসহিষ্ণু সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত না থাকায় হকচকিয়ে যায়। 

ধর্মও বড় একটা প্রভাব ফেলছে। মুসলমানপ্রধান রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ পর্যটকদের পছন্দ অনুযায়ী পরিবেশ, পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারছে না। অনেক পর্যটক নাইট ক্লাবে যেতে পছন্দ করে। ক্যাসিনো, মদ, নারী সাহচর্য ও উন্মুক্ত পরিবেশ পছন্দ করে এমন পর্যটকের সংখ্যা কম নয়। কিন্তু বাংলাদেশে পর্যটকরা এসব পায় না। তার উপর আছে সাধারণ মানুষের অকারণ কৌতূহল। 

বিদেশি দেখলেই যেভাবে সাধারণ মানুষ কৌতূহলী হয়ে উদ্ভট কাণ্ড করে বসে, আবার ভিক্ষুকরাও নাছোড়বান্দার মতো বাড়িয়ে দেয় ভিক্ষার হাত। এসব একজন পর্যটকের কাছে খুবই বিব্রতকর ব্যাপার হিসেবে পরিগণিত হয়। রাজনৈতিক হানাহানির বাইরেও দেশের আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি খুব একটা ভালো নয়। যতই সাধারণ মানুষ অতিথিপরায়ণ হোক, আন্তরিকতা দেখাক ভিনদেশির প্রতি কিন্তু পর্যটকের মনে যদি নিরাপত্তা ও আস্থার বোধ সৃষ্টি না হয় তাহলে এসব খুব একটা গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে না। 

পর্যটকরা কোথায় বেড়াবেন, সে জায়গাগুলোর বৈশিষ্ট্য কী- এসব জানানোর ভালো কোনো ব্যবস্থা নেই। নেই কোনো রোডম্যাপও; যে নির্দেশনা মোতাবেক পর্যটক পছন্দের জায়গায় বেড়াতে যাবেন। অধিকাংশ আবাসিক হোটেলে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সুবিধা না থাকাটাও পর্যটকদের জন্য বড় প্রতিবন্ধকতা। 

দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের জন্য হোটেলে কম্পিউটার, ইন্টারনেটের উপস্থিতি নিশ্চিত করার পাশাপাশি বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য পর্যটন স্পটের বর্ণনা দিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ ওয়েবসাইট লঞ্চিং করা যায়। এসবের মাধ্যমে যেন পর্যটক জানতে পারেন কতটুকু সময়ে কোথায় বেড়ানো যাবে, সম্ভাব্য খরচই বা কত।

বাংলাদেশের আছে গর্ব করার মতো ধন- সুন্দরবন, কুয়াকটা, কক্সবাজার, সিলেটের চা বাগান, হামহাম ও মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত পার্বত্যাঞ্চলসহ আরও বহু নান্দনিক স্পট। যদিও পার্বত্য অঞ্চলে নানাবিধ সংঘাতের ইতিহাস পুরনো। নতুন করে সেটা আরও বেড়েছে। বিদেশি পর্যটক দূরে থাকুক, দেশি মানুষের পক্ষেও পাহাড় ভ্রমণ এখন তুলনামূলক কঠিন। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবনধারা পর্যটকদের সহজেই মুগ্ধ করে। 

বন-পাহাড়ের অবকাঠামো অক্ষুণœ রেখেই সেখানে গড়ে উঠতে পারত নতুন প্রকল্প। সুপ্রাচীনকালের বহু ঐতিহ্য ও স্থাপনা আজও মানুষকে মোহমুগ্ধ করে রেখেছে। এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করে পর্যটকদের সামনে তুলে ধরা গেলে তারা জানবে এদেশের সমৃদ্ধ অতীত। বাংলাদেশের হাওর-বাঁওড়কে ঘিরে এখনো পর্যটন গড়ে ওঠেনি। এসব হাওর-বাঁওড়ে (এর বাইরেও) শীতকালে অসংখ্য পরিযায়ী পাখি আসে। 

দুয়ের সম্মিলনে আয়োজন করা যায় নতুনধারার পর্যটনের। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি ঠিক, তাই বলে দেশীয় অর্থনীতিতে এ খাতের গুরুত্ব যে কম তা নয়। তবে যে সুউচ্চ স্থানে পর্যটন শিল্পের থাকার কথা ছিল তার ধারে-কাছেও যে পৌঁছাতে পারেনি- বলার অপেক্ষা রাখে না। মুখস্থ বিদ্যার অনুকরণে গতানুগতিকভাবে বলা যায় ‘সব ঢেলে সাজাতে হবে’। কিন্তু ‘ঢালবেন’ কে আর ‘সাজাবেন’ই কে বা কারা- এখানেই বড় একটি ধোঁয়াশাচ্ছন্ন আবহ ঘুরপাক খায়!

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক