Image description

পৃথিবী নামক গ্রহে মানুষ সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী। এমনকি পৃথিবীর একচ্ছত্র রাজত্ব প্রতিষ্ঠাকারী প্রাণিকুল মানুষই। বহু শতাব্দী ধরে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এগিয়ে চলছে মানব সভ্যতা। এরই মধ্যে বিভিন্ন সময়ে মানুষকে টিকে থাকার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি করোনাকালের কথা। 

অল্প কিছুদিন আগেই আমরা দেখলাম মানুষকে নাজেহাল করে ছাড়ল অতি ক্ষুদ্র এই করোনা ভাইরাস। আমরা সরাসরি দেখতে পেয়েছি এই অদৃশ্য করোনার বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম। টিকে থাকার প্রবল অভিপ্রায়। বেঁচে থাকার লড়াই। প্রায় দেড় বছর ধরে চলেছে অস্তিত্ব রক্ষার এই প্রবল যুদ্ধ। এরইমধ্যে মানুষ হারিয়েছিল অবাধ চলাচলের স্বাধীনতা। ধ্বংসের তলানিতে পৌঁছে গিয়েছিল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। শিক্ষা, চিকিৎসা, শ্রমবাজার সবকিছুতেই দেখা দিয়েছিল নাজুক পরিস্থিতি। 

অবশেষে সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে জয় হয়েছে মানুষের। আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে এই বুদ্ধিমান প্রাণী। কালে কালে এভাবেই টিকে আছে মানুষ। ক্রমান্বয়ে উন্নতির দিকে ধাবিত হচ্ছে মানুষের নানামুখী অগ্রযাত্রা। বলা যায়, অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলছে মানবজাতি। প্রতি মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে জীবনমান। কিন্ত বদলেছে কি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি? বেড়েছে কি মানবিক গুণ? নাকি চোখ ধাঁধানো পরিপাটি আর চাকচিক্যের আড়ালে বেড়ে চলেছে মানুষিক কুৎসিত-কপটতা আর আত্মকেন্দ্রিকতা? তা যদি হয়, তবে আমরা কি সত্যিকার মানুষ হতে পেরেছি?  

মানুষের বেঁচে থাকার কর্মকাণ্ডে চিকিৎসাবিজ্ঞান সর্বশক্তি দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। মরণঘাতী রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কার করে আশার আলো দেখাচ্ছেন তারা। দেশে দেশে গবেষণা চলছে। আবিষ্কার হচ্ছে নতুন নতুন ভ্যাকসিন। মানুষের শরীরে তা সফলভাবে প্রয়োগ করাও শুরু হয়েছে। উন্মোচিত হচ্ছে নানাবিধ জীবিকার ক্ষেত্র। পৃথিবীর সকল পেশাজীবী, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী, অভিনেতা-অভিনেত্রী, নির্মাতা, ব্যবসায়ী, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, বাসচালক, ট্রাকচালক, পোশাককর্মী, কুলি, মজুর, ধোপা, নাপিত, কামার, কুমার, তাঁতী, কৃষক, জননেতা, জননেত্রী সবাই যার-যার মতো নিয়োজিত আছেন নিজ নিজ কাজে। 

সবাই এগিয়ে যাওয়ার দৌড়ে ধাবমান। এখানে পৃথিবী ও মানুষকে এগিয়ে নেয়ার জন্য যেমন নিরন্তর চেষ্টা রয়েছে মানুষের, ঠিক তেমনি চারদিকে চলছে এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা। অধিকাংশ মানুষ ছুটছে এই প্রতিযোগিতায়। তাদের ছুটে চলা লোভ ও লাভের দিকে। আর ক্ষমতার দৌড়ে দেশ তথা বিশ্ব রাজনীনিতে চলছে বীভৎস নারকীয়তা। নিজেদের আধিপত্য রক্ষায় যুদ্ধের নামে চলছে মানুষ নিধন। এখানে কোথাও মানবতার স্থান নাই। মানবিক গুণের জায়গা নাই। 

মানবতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে এসব মানুষ। আর তাতে মানবতা, মানবিক গুণ উঠে যাচ্ছে মানুষের মন থেকে। এ দেখে হয়তো স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তবে, কী করণীয় আমাদের? হ্যাঁ, করণীয় তো আছেই। পেশাজীবীকে নিজ নিজ পেশায় সততার সাথে আত্মনিয়োগ করতে হবে। চিকিৎসককে এগিয়ে আসতে হবে সেবার মনোভাব নিয়ে। সাংবাদিকের কাছে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ আশা করে মানুষ। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে সমন্বয়হীনতা কাম্য নয়। কবি-সাহিত্যিকের কলম থাকবে সত্য আর সুন্দরের পক্ষে, অনিয়ম আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে। 

শিল্পী, অভিনেতা-অভিনেত্রী, নির্মাতা ও কলাকুশলীগণও সক্রিয় থাকুক নান্দনিক কাজে। ব্যবসায়ীগণ চালিয়ে যাক তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। সিন্ডিকেট ভেঙে তারা এগিয়ে আসুক সৎ আর ন্যায্য ব্যবসায়। সকল শ্রমজীবীর হাত থাকুক সচল, কর্মক্ষম। সামান্য লোভের কারণে যারা অনৈতিক কাজের সাথে জড়িয়ে পড়েন, তাদেরও প্রয়োজন রয়েছে আত্মশুদ্ধির। আর জননেতা-জননেত্রী তাদের তো দেশ ও জাতির কথা ভাবতেই হবে। রাষ্ট্র পরিচালনায় যারা নিয়োজিত আছেন তাদের অসৎ হলে চলবে না। 

দেশ পরিচালকগণ অসৎ হলে গণমানুষের অধিকার লুণ্ঠিত হয়। যুগে যুগে মানুষ টিকে ছিল। আছে। টিকে থাকতে হবে। টিকে থাকার এই লড়াইয়ে মানুষকে আরও বেশি মানবিক হয়ে উঠতে হবে। এক্ষেত্রে সহনশীলতা, সততা, নৈতিকতার জায়গা থেকে আরও উন্নত স্তরে ওঠার বিকল্প নাই। এখানে স্বার্থপরতা, লোভ, প্রতিহিংসার মতো নিকৃষ্টতা পরিহার আবশ্যক। প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি যত্নশীল হয়ে ওঠাও জরুরি। বুঝতে হবে প্রকৃতি ও পরিবেশের ব্যাঘাত ঘটলে পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি মানুষকে বারবার পড়তে হবে ঝুঁকির মধ্যে। 

আরেকটা কথা বলা যায়, আজকাল মানুষ যেভাবে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে, এ থেকে বের হয়ে আসা দরকার। পিতা-মাতার প্রতি সন্তান, প্রতিবেশীর প্রতি প্রতিবেশী, বন্ধুর প্রতি বন্ধু, স্বজনের প্রতি স্বজন; সর্বোপরি মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য হয়ে ওঠা খুব কঠিন কাজ নয়। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সবখানে এই সহযোগিতা, সহমর্মিতা চর্চার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। নইলে মানুষের উন্নয়নের নামে এতো চাকচিক্য আয়োজন ‘বাইরে সাদা ভেতরে কালো’ বলেই পরিগণিত হবে।

আজ যে জিনিসটা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে, তা হলো দায়িত্বজ্ঞান। যার-যার জায়গা থেকে সচেতনভাবে কর্ম সম্পাদন না-করাই হলো দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দেয়া। এটা খুবই অন্যায় এবং নিজেদের প্রতিই অবিচার করা। কেননা, নিজেদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কারণে অন্যের অনিষ্ট ঘটার সাথে সাথে নিজেদেরই ক্ষতিসাধন হয়ে থাকে। এটা বোঝার মতো জ্ঞানও আবার বেশিরভাগ মানুষের নাই। আর তাই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনিষ্ট থেকে মানুষ বৃহৎ অনিষ্টের দিকে ধাবিত হয়। 

আরেকটা কথা বলা দরকার, তা হলো অজ্ঞতাও মানুষকে বড় বিপদে ফেলে দেয়। অজ্ঞ হওয়া পাপ। ধর্মও অজ্ঞতা অপছন্দ করে। তাই জ্ঞানচর্চা খুবই জরুরি। আবার জ্ঞানচর্চা করা বিষয়ে আরজ আলী মাতুব্বর-এর একটি কথা স্মরণযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে শুধু আপন বিশ্বাসই নয়, সকল মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত। সকল ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করা দরকার প্রতিটি জ্ঞানপিপাসু মানুষের। শুধু সীমাবদ্ধ পরিমণ্ডলে আবদ্ধ হলে চলে না। সীমানাকে অতিক্রম করে যেতে হবে ক্রমান্বয়ে। এর মধ্যেই ক্রমশ অতিক্রম করা যাবে নিজেকে।’

এই জ্ঞানচর্চার মধ্য দিয়েই মানুষ যেমন নিজেকে বুঝতে পারবে তেমনি সচেতনভাবেই মানবিক গুণাবলির সকল শর্ত পূরণ করতে পারবে। তখন তার কথায় ও কাজে সততা থাকবে। সততা ও সচেতনতা হবে নিত্যদিনের অভ্যেস। এখানে আমরা সবর্দা এ কথাও মনে রাখতে পারি, সততার অপরিমেয় শক্তি আছে। গর্ব আছে। মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য যা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। তাই মানুষের দেহে মানুষ নয়, সত্যিকার অর্থেই আমরা মানুষ হয়ে উঠতে চাই। এসো মানুষ হই। অর্জন করি যাবতীয় মানবিক গুণ। আর তা লালন করি এবং ব্যবহার করি মানুষের কল্যাণে। 

লেখক: সাহিত্যিক ও কলামিস্ট