Image description

একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে সেই দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে বিবেচনা করা হয়, এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। শ্রেণি-বিভক্ত সমাজে তাই শিক্ষা ক্ষেত্রে সুযোগের বৈষম্য থেকে যায়, যা বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রেও একই বৈষম্যতা ধারণ করেছে। শুধু শিক্ষা ক্ষেত্রে নয় সংস্কৃত অঙ্গনেও রয়েছে এই বৈষম্য। ‘সবার শিক্ষা পাওয়ার অধিকার আছে’ এটি দৃঢ়ভাবে জাতিসংঘের মানবিক সংস্থার বক্তব্য। 

অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার উপর বরাবরই জোর দেয়ার কথা বলা হয়েছে। স্বাধীনতার পর প্রতিটি সরকারের ব্যর্থতার কথা বরাবর উঠে আসছে। শুধু ব্যর্থ হয়েছে তা বলা যায় না বরং রাষ্ট্রীয় অনুকূলে শিক্ষা একটি লোভনীয় পণ্যে পরিণত হয়েছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ব্যাঙের ছাতার মতো বৃদ্ধি হচ্ছে পেয়ে চলেছে কিন্তু শিক্ষার মান ভাটির টানে ক্রমাগত তলানিতে গিয়ে ঠেকছে। 

এ অবস্থায় কোনো উন্নতি আপাতদৃষ্টিতে আমাদের চোখে পড়ছে না। হতাশা প্রতিনিয়ত আমাদেরকে গ্রাস করছে। দুঃখের বিষয় এই যে স্বাধীনতার পর শিক্ষা ক্ষেত্রে যে ব্যয় বরাদ্দ জিডিপির ২% এর আশপাশেই ঘোরাফেরা করছে। সামরিক শাসনের অবসান ও গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার এতটা বছর পরও কেন শিক্ষার এই দুর্গতি এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। 

আর্থ-সামাজিক অবস্থার সঙ্গে শিক্ষার যেমন যোগ আছে তেমনি আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও শিক্ষার সম্পর্ক আছে, এক্ষেত্রে শিক্ষার ভূমিকা নিষ্ক্রিয় নয়। শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষানীতি নিয়ে যখন আমরা আলোচনা করি তখন আমাদের মনে হয় শিক্ষাব্যবস্থার শিক্ষানীতি পরিবর্তনের মাধ্যমে আমাদের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন প্রয়োজন। মানবাধিকার সনদে শিক্ষা লাভ প্রত্যেক শিশুর অধিকার। 

বাংলাদেশের সংবিধানেও শিশুকে অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষাদানের প্রতিশ্রুতি আছে এবং প্রাথমিক শিক্ষায় যে জাতির শিক্ষাগত ভিত্তি এসব কথা সকলে মানেন কিন্তু সে শিক্ষা দিচ্ছেই বা কে আর নিচ্ছে বা কে? প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার বয়স যাদের হয়েছে তাদের অর্ধেকেই সেখানে যেতে পারে না কেননা শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্যে সেখান থেকে শুরু হয়েছে। 

অধিকাংশ পরিবার দারিদ্র্যসীমা নিচে বাস করার কারণে তারা সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে অপারগ। তারা সন্তানকে আর্থ-সামাজিক কাজে ব্যবহার করে নিজেদের কৃষিকাজ এবং অন্যান্য উৎস থেকে অর্থ উপার্জনের আশায় সন্তানদেরকে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত করছে। দেখা গেছে ৩০ শতাংশ পরিবার এত গরিব যে তারা ঘরের কাছে স্কুল থাকলেও ছেলেমেয়েদের পাঠাতে পারছে না। আর্থিক অসঙ্গতির কথা বলেছে ২১ শতাংশ, জানিয়েছে যে তাদের সন্তানদের উপার্জনে আত্মনিয়োগ করতে হয়। 

গ্রাম অঞ্চলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মনোভাব তা হলো লেখাপড়া শিখে সন্তানেরা যে বেকার হয়ে বসে থাকে তা বাপের ঘাড়ে অনেকটা বোঝা স্বরূপ। লেখাপড়ায় নিরুৎসাহিত করার বা হওয়ার এটাও একটি বড় কারণ। এ অবস্থায় প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের জন্য যে ব্যাপক ও বিপুল আয়োজন আমাদের করা আবশ্যক তা আমরা করতে পারছি না। সরকারের সকল পরিকল্পনায় এই প্রয়োজন স্বীকৃত হয়েছে কিন্তু বাস্তবে সে দিকে অগ্রসর হতে পারেনি। 

যে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা দরিদ্র্যসীমার নিচে সেখানে ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করা এটা জাতির জন্য বোঝা স্বরূপ। সে ক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা প্রসার করা দরকার। যা আমাদের দেশে একেবারেই অপ্রতুল্য। দেখা যায় মোবাইল, টেলিফোন, ইলেকট্রনিকস বিষয়গুলো হাতুড়ি জ্ঞান, গুতাগুতি করে একশ্রেণি এই মূল্যবান জিনিসগুলো পরিচালনা করছে। যদি তাদেরকে কারিগরি শিক্ষা দেয়া হতো তাহলে দেশের অনেক অর্থের অপচয় কমে যেত। 

উচ্চশিক্ষা অর্জন করা দোষের নয় তবে সবার জন্য উচ্চশিক্ষা অর্জন করা অবশ্যই একটি দেশের জন্য বোঝা। কেননা বিশেষ করে আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা বাবা-মা কষ্ট করে তাদেরকে উচ্চশিক্ষিত করে তখন তারা যেকোনো কাজ করতে নিজেদেরকে অসম্মান বোধ করে। এতে করে দেখা যায় বেকারের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। যদি পরিবার থেকে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বুঝে সন্তানদেরকে পরিচালনা করা যেতো, শিক্ষা দান করা হতো তাহলে তারা আত্মমর্যাদা নিয়ে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করতে পারতো। অনেকেই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত নিজেকে কর্মজীবী হিসেবে তৈরি করতে পারেনি। 

কারণ কোথাও চাকরি করতে গেলে তাকে কমবেশি শিক্ষার অর্জন করতেই হয়। শুধু সার্টিফিকেটধারী উচ্চ শিক্ষার কোনো মূল্য থাকে না এমন উচ্চশিক্ষা আমাদের দেশে প্রয়োজন নেই। সে ক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষার দিকে মনোনিবেশ করা একান্ত প্রয়োজন। নিম্নস্তরের শিক্ষার সঙ্গে উচ্চশিক্ষার যে প্রকট বৈষম্যের কথা আমরা আগে বললাম তার সঙ্গে গ্রাম ও শহর অঞ্চলের শিক্ষার বৈষম্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমরা আগে দেখেছি যে যে দেশের অঞ্চলে ১৫ শতাংশ লোক বাস করে সে দেশে শহরাঞ্চলের শিক্ষা খাতে ৭০ শতাংশ ব্যয় হয়।

শিক্ষার্থীর শতকরা কত ভাগ গ্রামাঞ্চল থেকে আসে সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। একটি কথা বলে রাখা দরকার উচ্চশিক্ষা বিস্তারে বিরোধ আমরা করছি না তবে আমরা মনে করি উচ্চ শিক্ষার দুয়ার মেধাবী ছাত্রদের জন্য উন্নত থাকা উচিত এবং সমাজের চাহিদা সঙ্গে উচ্চশিক্ষার একটি সংযোগ থাকা উচিত। অনেকেই মনে করেন উপনিবেশিক শাসন মুক্ত দেশে প্রশাসক ও চিকিৎসক প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিবিদ বিশ্ববিদ্যালয় জরুরি প্রয়োজন দেখা দেয়। ব্যয়বহুল শিক্ষা উচ্চ শিক্ষা লাভ করা। 

একমাত্র প্রাথমিক শিক্ষা পৃথিবীর উন্নত দেশেই কিন্তু এক পর্যায়ে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রেই ব্যয় করা হয় সর্বাধিক তারপর সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের পর প্রাথমিক শিক্ষার কিছু হ্রাস করে তা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে নিয়োগ করা হয়। ওইসব দেশে মোট জাতীয় আয়ের যতখানি শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যয় করা হয় আমাদের দেশের সঙ্গে তার তুলনা হয় না। তাই আমাদের দেশে উচ্চ শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে গেলে নি¤œ পর্যায়ের শিক্ষার প্রসার করে সংযোজন ঘটানো দরকার।

লেখক: কবি ও কলামিস্ট