অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সংস্কার করবে বলে কথা দিয়েছিল। কিন্তু সরকার গঠনের তিন মাস চলে যাওয়ার পরেও সংস্কারে কোনো গতি নেইÑ এমন কী সংস্কারের দৃশ্যমান কোনো চিত্র নেইÑ তবে আশা ছাড়ছে না জনগণ। সম্প্রতি সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। জনগণ আশায় বুক বাঁধলেও গতি ফিরছে না সংস্কারে। কিন্তু সংস্কারের গতি নেই- এমন প্রশ্ন উঠছে, যা সরকারের এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
বিগত সরকারের আমলে সীমাহীন দুর্নীতি, লুটপাট আর প্রশাসন ও সাংবিধানিক সমস্ত প্রতিষ্ঠানে সর্বাত্মক দলীয়করণের জেরে সৃষ্ট অচলাবস্থা নিরসন করতেও বেগ পেতে হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারকে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর শপথ নিয়ে তিন মাস সময় পার করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। রাষ্ট্র-সংস্কারের কাজে মনোযোগী হওয়ার আগেই আসে বড় ধরনের ধাক্কা। বিশেষ করে অসময়ের বন্যার কারণে এ সরকার ‘পরিস্থিতির শিকার হয়েছে’ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তাদের মতে, ‘বন্যাজনিত কারণেও সরকারের জন্য যে সময় যে উদ্যোগগুলো নেয়ার কথা সে উদ্যোগগুলো নেয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও পিছিয়ে যেতে হয়েছে’, যার প্রভাব পড়েছে মূল্যস্ফীতিতেও। এছাড়াও পাহাড় ও গার্মেন্টস খাতে অস্থিরতাসহ নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে এ সরকারকে। বিগত সরকারের আমলে সীমাহীন দুর্নীতি, লুটপাট আর প্রশাসন ও সাংবিধানিক সমস্ত প্রতিষ্ঠানে সর্বাত্মক দলীয়করণের জেরে সৃষ্ট অচলাবস্থা নিরসন করতেও বেগ পেতে হচ্ছে সরকারকে।
প্রশ্ন হচ্ছে- এসব প্রত্যাশা পূরণের কাজটা কি শুরু হয়েছে অথবা শুরুর কোনো নমুনা কি দেখা যাচ্ছে? স্বাভাবিকভাবেই অনেক প্রশ্ন থাকবেÑ এসব প্রশ্নের উত্তর দ্রুত মিলবে না। কিন্তু দীর্ঘদিনের সিস্টেম পরিবর্তন করতে সময় লাগবে। তবে সবকিছু মিলিয়ে স্বাভাবিকভাবেই দেশবাসী গভীর আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করছে সংস্কারের বাস্তব চিত্র দেখতে। রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্দেশ্যে এরই মধ্যে গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রধানরা কাজ শুরু করেছেন। তবে এখনো শৃঙ্খলা ফেরেনি প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে, বেড়েছে নিত্যপণ্যের দামও। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কিংবা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির মতো বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণে আনার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়েই বেশি আলোচনা হচ্ছে। ফলে দায়িত্ব গ্রহণের পর যেসব সংস্কারের কথা বলা হয়েছিল তা বাস্তবায়নে ধীর গতির কারণে সমালোচনার মুখে পড়েছে সরকার।
কিন্তু সরকারের উপদেষ্টা বলছেন ভিন্ন কথা- যেসব চ্যালেঞ্জ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করছে তাতে ‘ধীর গতি বললে অন্যায় হবে’। বিশ্লেষকরা বলছেন- চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ‘গুরুত্ব’ নির্ধারণ করে কাজ এগিয়ে নিতে। এ সংস্কারগুলো কোথায় কীভাবে করা হবে, সরকারের মেয়াদই বা কতদিন- এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন সাধারণ মানুষ। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বার্তাকে প্রতিফলিত করতে সংবিধানসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সংস্কার প্রয়োজন। দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবাধিকার, নির্বাচনব্যবস্থা, আইনিব্যবস্থা প্রভৃতিসহ আরও অনেক ক্ষেত্রে সংস্কার করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সরকার। পূর্ণাঙ্গভাবে গঠিত হওয়ার পর এসব কমিশন প্রধানরা আনুষ্ঠানিকভাবে গত ১ অক্টোবর থেকে কাজ শুরু করে তিন মাসের মধ্যে সম্পন্ন করবেন বলে কথা দিয়েছেন। এ প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সংস্কারে গঠিত ছয় কমিশনের কাজের অগ্রগতি জানাতে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপও করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
দেশের মানুষ সংস্কারের মাধ্যমে শান্তি প্রত্যাশা করছে। কিন্তু সংস্কার কতদূর, কতদূর জাতীয় সংসদ নির্বাচন। একটি বিষয় অস্বীকার করার উপায় নেইÑ বর্তমানে দেশ যে অবস্থায় আছে তা সংস্কার করে পুনর্গঠন করা বড় কঠিন কাজ, কিন্তু জাতি হিসেবে এবার ব্যর্থ হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। ছাত্র-জনতার রক্তের সম্মান জানানোতেই আমাদের সফল হতে হবে। বস্তুত একটি নিরাপদ, মানবিক ও গণতান্ত্রিক সমাজের আকাক্সক্ষা রয়েছে দেশের প্রত্যেক নাগরিকের। এমন একটি সমাজ গড়ে তোলার কাজটি চ্যালেঞ্জিং। প্রধান উপদেষ্টা যদি তার উপদেষ্টামণ্ডলীর সহযোগে এবং দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এ সংলাপের মাধ্যমে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেন, তাহলে দেশ একটি উন্নত স্তরে পৌঁছতে সক্ষম হবে।
অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার এ মুহূর্তে দেশটা এমনভাবে বিনির্মাণ করবেন যাতে মানুষ গণতন্ত্রের সাধ গ্রহণ করতে পারে। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে- অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পূর্বের সরকারের দুর্নীতির খাতগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর সংস্কার করবেন এবং ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতিমুক্ত রাখার জন্য তাদের সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে রাখতে হবে। জনগণের কথা ভেবে সুস্থ, সুন্দর বাংলাদেশ গড়বেন। নীতি কাঠামোর মধ্যেই সংস্কারের পরে একটি নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচনের প্রত্যাশা করছে জনগণ। সর্বোপরি, চতুর্মুখী চাপ সামলাতে সরকারকে কৌশলী হতে হবে। তবেই গতি আসবে সংস্কারে, পূরণ হবে জনগণের প্রত্যাশা।
Comments