জন্মিলে মরিতে হইবে” কথাটি যেমন সত্য, তেমনি জন্মের পর বার্ধক্যে একদিন পৌঁছতে হবে এ কথাটিও সত্য। তাইতো পরিবর্তনশীল সমাজের বিভিন্ন বয়সের জীবনযাত্রা বিভিন্ন রকমের। বিভিন্ন বয়সের জীবনযাত্রার মান বিভিন্ন রকমের হলেও প্রবীণদের জীবনযাত্রা নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রম এবং সাপধারণের চেয়ে আলাদা। মানুষের বয়স যত বাড়ে তার মধ্যে শিশুতোষ প্রবৃত্তিও ততটাই বাড়ে। তারপরে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগব্যাধির উপদ্রব বাড়তেই থাকে। এসময় তাকে যত্ন করা ও দেখে রাখা একান্ত জরুরি। কিন্তু পুঁজির অসম বিকাশের কারণে মানুষ ক্রমশ একা থাকতে চাইছে। বাবা-মা, তাই হচ্ছে সন্তানের বোঝা। ফলে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বাড়ছে। বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বাড়া মানেই সমাজে অমানবিকতা ক্রমশ জায়গা করে নিচ্ছে এটা বুঝেতে হবে। বেশিরভাগ প্রবীণদের দৈনন্দিন জীবনযাপন আমাদের সমাজে খুবই করুণ ও বিচিত্রময়। অবশ্য এটা শুধু আমাদের দেশেই নয় বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেও রয়েছে এই করুন বিষাদময় জীবনযাপন, যা অর্থ-সম্পদ দিয়ে বিচার করা যায় না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত জনশুমারি ও গৃহগণনা অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬। যার মধ্যে ৬৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষ ৯৭ লাখ ২৭ হাজারের কিছু বেশি। আগামী ২০২৫ সাল নাগাদ দেশে প্রবীণদের সংখ্যা হবে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ। আর আগামী ২০৫০ সালে এই সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৪ কোটি এবং ২০৬১ সালে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি প্রবীণ জনগোষ্ঠী হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে পরিবার/খানাপ্রতি লোকসংখ্যা প্রায় ৪.০৩ জন, যার মধ্যে প্রায় ০.২৪ জন প্রবীণ মানুষ আছে। আমরা তাদের ভরণপোষণ করতে পারছি না। ২০৫০ ও ২০৬১ সালে খানাপ্রতি হবে যথাক্রমে ১.১১ জন ও ১.৩৫ জন। তখন কী হবে? এখন অনেকেই যে সমস্যাকে পারিবারিক মনে করছেন, তখন তা হবে রাষ্ট্রীয় মহাদুর্যোগ!
বার্ধক্য আমাদের জাতীয় জীবনের জন্য আজ একটি মারাত্মক চ্যালেঞ্জ। পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, প্রবীণ পুরুষের তুলানায় প্রবীণ নারীরা বেশিদিন বাঁচেন। অধিকাংশই আবার বিধবা হয়ে! আমাদের সমাজে তারা বেশি মাত্রায় অবহেলা, দুর্ব্যবহার এবং বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এমনকি নিজের ভাই, স্বামী, সন্তানদের কাছ থেকেই!
বাংলাদেশের সংবিধানে প্রবীণদের সামাজিক নিরাপত্তার কথা বলা হয়েছে। আমাদের দেশে প্রবীণদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন কল্যাণমূলক কার্যক্রম রয়েছে বটে কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। প্রবীণদের উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রবীণরা বৃদ্ধ নয়, মানসিক দিক দিয়ে অনেক সক্ষম, দেশ গঠনে তাদের সহযোগিতা প্রয়োজন। দেশের সমাজ পরিবর্তনে এবং উন্নয়নে প্রবীণদের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। প্রবীণরা আমাদের শ্রদ্ধার পাত্র, সমাজের পথপ্রদর্শক। প্রবীণদের সম্মান দেয়া ও যত্ন নেয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। কাউকে ফেলে রেখে নয়, বরং সবাকে নিয়ে বিশ্বসমাজের প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির অভিযাত্রা চলমান রাখতে হবে। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা দলিলের মাহাত্ম্য এখানেই। পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রবীণদের অবদান অপরিসীম। পরিবারের গঠন, উন্নয়ন ও সমাজের কল্যাণে কর্মময় জীবন ব্যয় করে একসময় তারা বার্ধক্যে উপনীত হন। তখন প্রবীণদের সার্বিক কল্যাণ ও সুরক্ষা করা সমাজের আবশ্যিক কর্তব্য।
একসময় মনে করা হতো, বার্ধক্য শুধু উন্নত বিশ্বেরই সমস্যা। কিন্তু না, বার্ধক্য উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশেরও সমস্যা বলে সামাজিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিকভাবে মনে করা হয়। বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের প্রবীণেদের দুঃখ দুর্দশা অন্যরকমের। তথাপি, শহরাঞ্চলের প্রবীণেদের শারীরিক পরিশ্রমের চেয়ে মানসিক পরিশ্রমের ভাগ বেশি। কিন্তু গ্রামাঞ্চলের প্রবীণদের শারীরিক ও মানসিক দু-ধরণেরই নির্যাতনের শিকার হতে হয়। শহরে বাহ্যিক চিত্ত বিনোদনের সুযোগ থাকলেও, আন্তঃজগতে (ঘর-সংসারে) এ সুযোগ নেই। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে, চিত্ত বিনোদনের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। সমস্যা সমস্যাই। তবুও শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের প্রবীণদের সমস্যাই বেশি। একটি শিশু যেমন মৌলিক চাহিদা ভোগ করার অধিকার থাকে, তেমনি একজন প্রবীণেরও এই চাহিদাগুলো ভোগ করার অধিকার আছে। কিন্তু আর্থ-সামাজিক কারণে এই প্রবীণেরা অনেক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। একবেলা খাবার জুটলেও বিনোদন বলতে কিছু নেই। আমাদের দেশে প্রবীণদের বেশিরভাগই কর্মহীন থাকায় তারা তাদের সামাজিক মর্যাদাটুকুও পান না। সেটা পরিবার-সমাজ-দেশ যেখানেই হোক। সর্বক্ষেত্রেই এক তাচ্ছিল্যের ভাব। একজন প্রবীণ ব্যাক্তি কর্মহীন হয় তখনই যখন সে তার বয়সের ভার সহ্য করতে না পারে। আর তাই সমাজ-সংসারে তার কোনো মূল্যই থাকে না। আমাদের দেশে প্রবীণেরা নানা সমস্যায় জর্জরিত। অবসর জীবনযাপনে কিছু করতে না পারা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ভূমিকা রাখতে না পারা, চিত্ত-বিনোদনের ব্যবস্থা না থাকা, সংসারে পরাধীনতা বা অন্যের অধীনস্থ হয়ে থাকা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভুক্ত হতে না পারায় তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ভাব সহ্য করতে হয়। এরকম বিভিন্ন সমস্যা ও মৌলিক চাহিদার অপ্রতুলতা নিত্যদিনের।
একসময় যৌথ পরিবার সবাই পছন্দ করতো। সেখানে মা-বাবা, ভাইবোন, দাদা-দাদিসহ সবাই মিলে একত্রে বসবাস করতো। কিন্তু বর্তমানে যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার সৃষ্টি হচ্ছে। যৌথ পরিবারের প্রধান কর্তা বা সিদ্ধান্তদাতা ওই পরিবারের প্রধান বয়োজ্যেষ্ঠ প্রবীণ ব্যক্তিটি। কিন্তু বর্তমানে সেই বয়োজ্যেষ্ঠ প্রবীণ ব্যক্তিটির সিদ্ধান্তের কোনো মূল্য দেয়া হয় না। তিনি অবহেলার শিকার হচ্ছেন। পাশাপাশি যদি তাদের আয়-রোজগারের কোনো পথ না থাকে, সেটা হোক সম্পদ, পেনশন বা গৃহ-কর্মে অবদান, সেক্ষেত্রে তো কোনো কথাই নেই। বরঞ্চ, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে বয়সের ভারে ন্যুব্জ ব্যাক্তিটিও কৃষিকাজে, গৃহকর্মসহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত হতে হয়।
একসময় গ্রাম্য সালিশ দরবার বা সামাজিক সমস্যা সমাধানে স্ব-স্ব এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিদের ভূমিকা ছিল প্রধান ও অগ্রণী। কিন্তু এখন প্রভাবশালী ও লাঠিয়াল গ্রুপ বা বড় নেতাদের লেজুড়বৃত্তি করা লোকেরাই এমন সমাধান দেন যাতে গ্রামবাসিদের থানা-কোর্ট পর্যন্ত যেতে হয়, যার কারণে অর্থনৈতিকভাবে ওই লোকগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
একদিকে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে যে হারে সত্তরোর্ধ প্রবীণদের সংখ্যা বাড়ছে, সে হিসাবে ২০৫০ সালে প্রথমবারের মতো প্রবীণদের সংখ্যা নবীনদের ছাড়িয়ে যাবে বলে পর্যবেক্ষকরা ধারণা করছেন। তখন এটি হবে প্রধানত প্রবীণদেরই পৃথিবী। আমরা যদি প্রবীণদের সমাজ-সংসারে বোঝা মনে করি, তবে ভবিষ্যতে সমাজ আমাদের বোঝা হিসেবে গণ্য করবে নিচের গল্পের মতো-
“এক ছেলে তার বৃদ্ধ বাবাকে সংসারে ঝামেলা মনে করতো। সে একদিন তার বাবাকে একটি ঝুড়িতে করে জঙ্গলে ফেলে দিতে যায়। পেছন থেকে বৃদ্ধের নাতি তার বাবাকে বলল, দাদুকে ফেলে দিয়ে ঝুড়িটা নিয়ে এসো। তুমি যখন বৃদ্ধ হবে তখন এটা আমারও একই কাজে লাগবে।”
তাই আসুন, আমরা সকলে মিলে প্রবীণ ব্যক্তিদের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেই।
লেখক: কবি ও উন্নয়ন কর্মী
মানবকণ্ঠ/এসআরএস
Comments