প্রাথমিক শিক্ষার সাথে শিশুপরিচর্যা শব্দটি অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। যথাযথ প্রাথমিক শিক্ষা একজন শিশুর শিক্ষাভীতি দূরে সরিয়ে বিদ্যালয়মুখী করে তোলে। শৈশব শিক্ষার অপরিসীম গুরুত্ব প্রাথমিক স্তর থেকেই প্রতীয়মান হয়। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দরিদ্র দেশ। আর্থিক সামর্থ্যই কেবল দরিদ্র নয়। মানসিক হীনম্মন্যতাও এক ধরনের দরিদ্র।
এমন অনেক গ্রাম আছে যেখানে ইউনিয়ন পরিষদ অফিসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঝকঝকে চকচকে কিন্তু প্রাথমিক বা মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি একেবারেই অবহেলিত। দেশের প্রতিটি উপজেলার অধিকাংশ সরকারি দপ্তরে সংস্কারের ছোঁয়া লেগেছে। অনেক দপ্তরে রয়েছে শীতাতপ-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। রয়েছে টাইলস লাগানো ফ্লোর। শুধু বিদ্যালয়গুলোতেই নেই দৃশ্যমান উন্নয়ন কিংবা সংস্কার। নেই পাঠদানের জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষক। শ্রেণিকক্ষে যথেষ্ট আলো-বাতাসের ব্যবস্থা নেই। নেই বিদ্যালয় আঙিনা, শ্রেণিকক্ষ, শৌচাগার ইত্যাদি পরিষ্কার রাখার পর্যাপ্ত তহবিল। শিক্ষাদানের জন্য বিজ্ঞানসম্মত প্রযুক্তি নেই। নেই শিক্ষাদান পরিকল্পনা। নেই নিয়মিত শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মশালা। শিক্ষাখাতের এমন দৃষ্টিভঙ্গি প্রকৃতপক্ষে মানসিক দারিদ্র্যের পরিচয়ই প্রকাশ করে।
গবেষণায় দেখা যায়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকসহ পাঁচজন সহকারী শিক্ষক একই ধরনের বেসরকারি স্কুলের থেকে অনেক বেশি ফলপ্রসূ। আমাদের দেশের সরকারি/বেসরকারি মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক ঘাটতি রয়েছে। শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন প্রশিক্ষিত শিক্ষক। প্রয়োজন পরিকাঠামোগত সংস্কার ও উন্নয়ন। প্রয়োজন উন্নত, আধুনিক ও সময়োপযোগী পাঠ্যক্রম। প্রয়োজন শিক্ষার্থীর প্রাতিষ্ঠানিক ও মানসিক সঠিক মূল্যায়ন। এক্ষেত্রে শিক্ষা কাঠামোর ক্রুটিসমূহ শিক্ষার মানোন্নয়নের অন্তরায়।
শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থী মূল্যায়নের স্থায়িত্ব কমানোর চেষ্টা স্বাধীনতার পর থেকেই শুরু হয়েছে। এক সময় বছরে তিনটি মেধা যাচাই পরীক্ষা হতো। পরীক্ষা তিনটি প্রথম সাময়িক, দ্বিতীয় সাময়িক ও বার্ষিক পরীক্ষা নামে বিবেচিত হত। এরপর অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক পরীক্ষার মাধ্যমে বছরে দুইবার মেধা যাচাই শুরু হয়। এখন আবার অর্ধবার্ষিক কিংবা বার্ষিক পরীক্ষার বিকল্প হিসেবে স্বল্পমেয়াদি সিমেস্টার পরীক্ষার কথা ভাবা হচ্ছে। সিমেস্টার ব্যবস্থায় সাধারণত একটা শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যক্রমকে তিনটি কিংবা চারটি সিমেস্টারে ভাগ করা হয়। প্রতিটি সিমেস্টারের অন্তর্বর্তী সময়ে ‘মিড-টার্ম’ সিমেস্টার পরীক্ষার ব্যবস্থাও থাকে। যাতে করে অল্প সময়ের ব্যবধানে শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক মূল্যায়ন করা যায়। মূল্যায়নের স্থায়িত্ব স্বল্প বলেই পাঠ মুখস্থ রাখার চাপ কমে যায়। এজন্য ধারাবাহিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সেমেস্টার প্রথা বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত।
বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি যত শিক্ষাক্রম এসেছে তার কোনোটিই ফলপ্রসূ হয়নি। এখন পর্যন্ত যতবার শিক্ষা কারিকুলাম পরিবর্তন হয়েছে ততবারই কারিকুলামের পক্ষে বিপক্ষে নানাবিধ তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন বা জাতীয় শিক্ষা কমিশন (১৯৭২), জাতীয় কারিকুলাম ও সিলেবাস প্রণয়ন কমিটি (১৯৭৬), জাতীয় শিক্ষা উপদেষ্টা কমিটি (১৯৭৮), মজিদ খান শিক্ষা কমিশন (১৯৮৩), মফিজউদ্দীন আহমদ শিক্ষা কমিশন (১৯৮৭), এমএ বারী শিক্ষা কমিশন (২০০১), কবির চৌধুরী শিক্ষা কমিশন (২০০৯) এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনা, সমালোচনা ও অভিভাবক সমাবেশ হয়েছে শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ নিয়ে।
৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতার পটপরিবর্তনের সাথে সাথে শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ এ আমূল পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশব্যাপী প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা বার্ষিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। পরীক্ষাভীতি ও সংশয় এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি শিক্ষার্থীরা। কারণ বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থা এক গভীর সংকটের মুখোমুখি। নতুন কারিকুলাম প্রণয়ন না করে শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ এর বই থেকেই প্রশ্ন করা হচ্ছে। তবে প্রশ্ন-পদ্ধতিতে এসেছে পরিবর্তন। বছরের পর বছর ধরে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বিভিন্ন সময় গবেষণা হয়েছে। কিন্তু সুফল এখনও পূর্ণাঙ্গ রূপে আসেনি।
প্রাচীনকালে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানার্জনের জন্য ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যেত। আশ্রয় নিত গুরুগৃহে। গুরুর পরিবারের একজন সদস্য হয়ে বিদ্যাচর্চা করতো। শিক্ষার্থীর প্রতি গুরুরও থাকতো বিশেষ নজর। থাকতো। জ্ঞান, বিজ্ঞান, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার শিক্ষা গুরুগৃহ থেকেই অর্জিত হত। গুরু-শিষ্য এখনো আছে কিন্তু ধৈর্য নেই কারোরই। গুরুরূপী শিক্ষক এখন শিক্ষাদান করেন অর্থের বিনিময়ে। আর শিক্ষার্থী শিক্ষার্জনের জন্য নয় বরং পরীক্ষায় পাসমার্কের জন্যই শিক্ষকের দ্বারস্থ হয়। শিক্ষাবিজ্ঞানের নতুন নতুন উদ্ভাবন, নানাবিধ গবেষণার ফল সম্পর্কে শিক্ষকদের অবহিত করার দায়িত্ব কার? অবশ্যই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। নিয়মিত প্রশিক্ষন, কর্মশালা, রিফ্রেশার কোর্স ইত্যাদির মাধ্যমে এই কাজটি চালিয়ে যেতে হয়। আমাদের দেশে এসব হয় কালেভদ্রে। ঘাটতি রয়েছে পাঠদান পদ্ধতিতেও। পৃথিবীর দেশে দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ও পরিমার্জন হচ্ছে। শিক্ষাবিজ্ঞানের ধারাবাহিক গবেষণা ও শিক্ষাদান পদ্ধতিতে এগিয়ে গিয়েছে আমাদের পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোও। অথচ বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখনো চক-ডাস্টার-ব্ল্যাকবোর্ড এবং লেকচার মেথডে আটকে আছে।
শিক্ষা একটি মহান ব্রত। শিক্ষাদান পদ্ধতি নিয়ে বিভিন্ন শিক্ষাবিদদের মধ্যে অনেক সময় মতানৈক্য থাকলেও শিক্ষার লক্ষ্য তো একই। শিক্ষার্থীদের মধ্যে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটানো একজন শিক্ষকের প্রধান কর্তব্য। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় সে সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। স্কুলে নির্দিষ্ট সময়ে পাঠদান সম্পূর্ণ করলেই শিক্ষকের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। কিন্তু বর্তমান শিক্ষা অনেকটাই যান্ত্রিক। ছাত্র কিংবা শিক্ষক উভয়েই অস্থির। সময় পেলেই ছাত্রও যেমন ফেসবুক স্ক্রল করে চলে শিক্ষকের ক্ষেত্রেও একই রকম ঘটনা দৃশ্যমান। আবার বাংলাদেশের অধিকাংশ স্কুলে দেখা যায়, ছাত্রের তুলনায় শিক্ষক কম। স্বাভাবিকভাবেই একজন শিক্ষকের পক্ষে ক্লাসের সব ছাত্রের ব্যক্তিগত ক্ষমতা অনুধাবন করে পাঠদান সম্ভব হচ্ছে না। ফলত ছাত্রছাত্রীরা বিকল্প হিসাবে প্রাইভেট টিউশনের দিকে ঝুঁকছে।
অভিভাবকরা কেন যেন একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমেছে। যে করেই হোক পরীক্ষায় সন্তানের ভালো ফলাফল চায় তারা। ভালো ফলাফলের জন্য স্কুলের উপর ভরসা না রেখে টিউটর দিয়ে প্রাইভেট চলছে তো চলছেই। মোটামুটি যাদের সামর্থ্য আছে তারা চার/পাঁচটি সাবজেক্ট টিচারের কাছে সন্তানকে প্রাইভেট পড়াচ্ছে। যাদের সামর্থ্য নেই তারা হীনম্মন্যতায় ভুগছে। আবার স্কুলের শিক্ষকের উপরও ভরসা করতে পাচ্ছে না। ফলে প্রাইভেট পড়াটাই এখন শিক্ষার্থীদের একটি নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর ‘এ+’ অর্জনকারীরা গর্ব করে বলে তাদের প্রায় সকল বিষয়ে একাধিক গৃহশিক্ষক ছিল। কোভিড মহামারির সময় থেকে অদ্যাবধি শিক্ষাক্ষেত্রে চরম অরাজকতা চলছে। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা কতটুকু হচ্ছে তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কে কয়টা বিষয়ে প্রাইভেট পড়ে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কোচিং ব্যবসা। উৎসাহ পাচ্ছে মুখস্থ-সর্বস্ব কম্পিউটার-নির্ভর শিক্ষাপদ্ধতি।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করতেন মুখস্থ করে পরীক্ষা দেয়া আর নকল করে পরীক্ষা দেয়ার মধ্যে নাকি কোনো পার্থক্য নেই। শুধু মুখস্থ করে পাস করার ফলে কমে যাচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ। অর্থের বিনিময়ে শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা কিনে নিচ্ছে। মেধার প্রয়োজন নেই। অপরপক্ষে মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে উচ্চ শিক্ষা থেকে।
আবার প্রত্যন্ত অঞ্চলে দেখা যায় অপর্যাপ্ত শিক্ষক, পরিকাঠামোর জীর্ণ খাঁচা আর অপুষ্টিতে ভোগা ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে শিক্ষালয়গুলো টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। শেষ সম্বলটুকু উজাড় করে অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখাচ্ছে। সেখানে নির্ধারিত ব্যয় বরাদ্দের অনিয়মিত যোগান, প্রলম্বিত ছুটির আবহ, শিক্ষা উপকরণসমূহ বণ্টনে দুর্নীতির অভিযোগ গণমাধ্যমে মাঝেমাঝেই প্রচারিত হয়। সবচেয়ে বেশি প্রচারিত হয় শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের পাঠদানে অনীহা এবং প্রাইভেট কোচিং চালানো বিষয়ে। বহুল প্রচারিত এই অভিযোগে কিন্তু সকল শিক্ষক অভিযুক্ত না। ক্লাস-মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করে শিক্ষকদের ক্লাসে পাঠদান বিষয়ক ভালো ফল পাওয়া যাবে।
বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় স্কুলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে প্রথমে আমাদেরই আন্তরিকতা, সদিচ্ছা ও সততার পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হতে হবে। পাশাপাশি বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় পরিকাঠামো এবং সার্বিক ব্যবস্থা সরকারি উদ্যোগে গড়ে তুলতে হবে। এতে করে একজন শিক্ষার্থী অবশ্যই তার যাবতীয় চাহিদা শিক্ষাকেন্দ্রেই পাবে। ফলে প্রাইভেট টিউশনের জন্য আর ছোটাছুটি করবে না। সামাজিক ভেদাভেদ মোচনের ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার উপযুক্ত হাতিয়ার হচ্ছে শিক্ষা। জাতীয় সম্প্রীতি এবং সামাজিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সামগ্রিক উন্নয়ন হাতিয়ার হচ্ছে শিক্ষা। মানুষের মাঝে শিক্ষার প্রসার হলে সমাজের সর্বস্তরের চিরাচরিত বিভেদগুলো দূর হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের বিভাগ, জেলা, উপজেলা ও প্রতিটি গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সমাজের উচ্চবর্গীয়দের জন্য বিশেষ স্কুল এবং নিম্নবিত্তের জন্য আলাদা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিশুদের মনে শ্রেণিগত বিভাজন সৃষ্টি করে। সকল ধরনের বিভাজনমুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা সৃষ্টি করা গেলে বাংলাদেশ হবে সুখী ও মানসিক সমৃদ্ধ দেশ।
লেখক: শিক্ষক
মানবকণ্ঠ/আরইচটি
Comments