সমাজ, দেশের ভবিষ্যৎ ও অন্যতম সম্পদ হচ্ছে আজকের তরুণরা। তরুণ প্রজন্মের একটা বিরাট অংশ আমাদের বিস্ময় করে দিয়েছে জুলাই বিপ্লবে। তারা আবারো প্রমাণ করে বুঝিয়ে দিয়েছে বাঙালির দেশপ্রেম রক্তের রঙে রাঙিয়ে তোলার ইতিহাস পুরনো। তাই আমরা এই বীর সন্তানদের সকলকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে উপহার দিতে চাই সর্বক্ষেত্রে। তাই তরুণদের অল্প কিছু সংখ্যা যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অতি চর্চায় বিছিন্ন তাদেরকে মাঠমুখী, সাংগঠনিক ও সামাজিকীকরণ করতে চেষ্টা করতে হবে শতভাগ। তাহলেই আমরা হবো সারা বিশ্বের বিস্ময়!
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজকে কেন্দ্র করে মানুষ পরিচালিত হয়। সমাজ নৈতিকতাসহ সকল ইতিবাচক মানদণ্ডে যত ভালো হবে ততো মানুষ এগিয়ে যাবে। সমাজকে বাদ দিয়ে কোনো কিছু কল্পনা করাও অসম্ভব। সমাজ যত উন্নত হবে সমাজের মানুষও ততো উন্নত হবে। অন্যদিকে সমাজ যত পিছিয়ে পরবে সমাজের মানুষও ততো পিছিয়ে পড়বে। সমাজ এবং মানুষ উভয়ই পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। সমাজকে এগিয়ে নিতে পারে মানুষ। সমাজ কখনো মানুষকে এগিয়ে নিতে পারে না। মানুষকে সংঘবদ্ধ করে সমাজকে এগিয়ে নিতে সেতুবন্ধক হিসেবে কাজ করে সামাজিক ক্লাব। সামাজিক ক্লাবগুলো সমাজকে কীভাবে এগিয়ে নিয়েছে অতীতে আমরা তার প্রমাণ পেয়েছি। সামাজিক ক্লাবগুলো শুধু সামাজিক বন্ধন তৈরি করে না বিনোদনসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড করে থাকে।
সামাজিক ক্লাবগুলো মোটা দাগে কয়েকটি কাজ করে থাকে। প্রথমত, ক্লাবগুলো মানুষকে সামাজিক ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করে। ভিন্ন পেশা ও বয়সের মানুষ একসঙ্গে কাজ করার মধ্য দিয়ে একে অপরকে জানতে পারে। মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সহানুভূতির সম্পর্ক গড়ে উঠে। একজনের সুখে আরেকজন সুখী হয় আবার অন্যজনের দুঃখে আরেকজন ব্যথিত হতো। আজকের এই দিনে ভ্রাতৃত্ববোধের অভাব। আমি নিজে ভালো থাকলে সব ভালো এরকম এক মন মানসিকতা তৈরি হয়েছে আমাদের মাঝে। ভ্রাতৃত্ববোধের অনুপস্থিতির ফলে সমাজে একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে। একাকিত্ব মানুষকে হতাশ করে তুলছে এবং এর প্রভাবে আত্মহত্যার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর কারণে দিন দিন সামাজিক ক্লাবের প্রয়োজনীয়তা আরও প্রকট হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, সামাজিক ক্লাবগুলোর বিনোদনমূলক কার্যক্রম, যেমন খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মানুষের মনে আনন্দের সঞ্চার করে এবং মানসিক চাপ কমায়। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে বহু প্রতিভাবান ব্যক্তি উঠে আসে। যারা আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সুনাম অর্জন করে। কিন্তু বর্তমানে এই ধরনের আয়োজনের অভাবে মানুষ একঘেয়েমিতে ভুগছে এবং সমাজের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য কমে গেছে। তৃতীয়ত, ক্লাবগুলো সমাজের উন্নয়নমূলক কাজেও ভূমিকা রাখে। দারিদ্র্যপীড়িত মানুষকে সাহায্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, এবং সামাজিক সমস্যা মোকাবিলায় ক্লাবগুলোর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। আজ এই ধরনের উদ্যোগের অভাবে সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী আরও বেশি অবহেলিত হচ্ছে। চতুর্থত, ক্লাবগুলো তরুণ প্রজন্মকে সমাজের কাজে যুক্ত করে তাদের মধ্যে নেতৃত্বগুণ এবং দেশপ্রেম তৈরি করে। তরুণদের সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়ার মাধ্যমে সমাজকে এগিয়ে নেয়ার জন্য প্রস্তুত করে।
বর্তমান সময়ে এই অভাবে তরুণদের মধ্যে উদাসীনতা এবং আত্মকেন্দ্রিকতা দেখা দিচ্ছে। সমাজের সাথে সম্পর্ক না থাকায় তাদের হতাশা গ্রাস করছে। এর পরিণাম হচ্ছে ভয়াবহ। সামাজিক ক্লাবগুলো হারিয়ে যাওয়ার ফলে আমাদের সমাজে যে সামাজিক অবক্ষয় সৃষ্টি হচ্ছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সামাজিক ক্লাবগুলো অতীতে শুধু বিনোদনের কেন্দ্রই ছিল না; বরং এগুলো ছিল একটি সমাজবদ্ধতার মঞ্চ। যেখানে মানুষ একত্রিত হয়ে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি ও দায়িত্বশীলতা শেখার সুযোগ পেত। সামাজিক ক্লাবগুলো হারিয়ে যাওয়ার পেছনে পুঁজিবাদী চিন্তাচেতনা, প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার এবং মানুষের সামাজিক দায়িত্ববোধের অভাব উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে।
মানুষ আজকাল মানুষ ভার্চুয়াল জগতে এতটাই মগ্ন যে বাস্তব জীবনের সামাজিক সম্পর্কের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ছে। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আমাদের সামাজিক ক্লাবগুলো পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। সমাজের সকল স্তরের মানুষকে একত্রিত করে তাদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং দায়িত্বশীলতার মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। এর পাশাপাশি ক্লাবগুলোকে তাদের কার্যক্রমের পরিসর বাড়াতে হবে এবং তরুণদের এই উদ্যোগে সম্পৃক্ত করতে হবে। তবেই সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে।
দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি আমাদের উদাসীনতা দূর করে তাদেরকে সারাক্ষণ মোবাইল ও ডিভাইস থেকে বের করে মাঠমুখী করতে হবে। ফিরিয়ে আনতে হবে হারানো সামাজিক সংগঠনগুলো বা তথ্য ও প্রযুক্তির বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে নতুন নতুন সংগঠন তৈরি করতে হবে সরকারি, বেসরকারি, সামাজিক ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এতে করে তরুণরা সৃজনশীল ও দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে বিশ্বের সম্পদে পরিণত হবে। অন্যথায় পরিবার, সমাজ ও দেশের বোঝা হবে। সবাই একসাথে এগিয়ে আসলেই বেঁচে থাকবে আমার সমাজ, দেশ ও দেশের মানুষ।
লেখক: শিক্ষার্থী
মানবকণ্ঠ/আরইচটি
Comments