Image description

বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। এজন্য এখানে এখন অধিকভাবে উচ্চারিত হয় গণতন্ত্রের কথা। যতক্ষণ পর্যন্ত অন্যের অধিকারকে সমুন্নত রাখবো না, ততক্ষণ কিসের গণতন্ত্র? গণতন্ত্র নির্বাচনের একমাত্র শর্ত নয়। গণতন্ত্রের আগে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা গণতন্ত্রের চর্চাকে বেগবান করতে পারে। 

বিশ্ব শান্তি ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের অবদান ও উদ্যোগের পাশাপাশি ধনী ও ক্ষমতাবান রাষ্ট্রসহ সকল দেশকে সমভাবে মানবাধিকার সুরক্ষার জন্য অবদান রাখতে সচেষ্ট হতে হবে। কি কি প্রতিষ্ঠান মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা রক্ষাও বাড়াতে পারে? মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণায় বলা হয়-মানবাধিকারকে আইনের শাসন দিয়ে রক্ষা করতে হবে এবং নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত চুক্তির ৪নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কতিপয় মৌলিক অধিকারকে জরুরি অবস্থার সময়ও স্থগিত রাখা যাবে না। 

আইনের শাসনের মৌলিক দিক হচ্ছে এই যে, সরকারের কর্তৃত্ব হচ্ছে আমজনতার ইচ্ছায়। গণতন্ত্রের অর্থ স্বাধীনতা। যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের মতে, স্বাধীনতা বলতে কেবল দৈহিক ক্ষতি থেকে স্বাধীনতা লাভ বোঝায় না, বরং একজন মুক্ত নাগরিকের সুখী জীবন যাপনের সুবিধা ভোগ বোঝায়। আইনের শাসনের আরেকটি মৌলিক উপাদান হচ্ছে বৈধ পদ্ধতি যা সরকারের অন্যান্য শাখা থেকে স্বাধীন বা স্বতন্ত্রভাবে কাজ করতে পারে। আইন শুধু সমাজের শান্তি ও শৃঙ্খলার জন্য অপরিহার্য নয়, বরং এর স্বাধীনতা রক্ষার জন্যও অপরিহার্য। 

আইনের মাধ্যমেই রাষ্ট্রিক ক্ষমতা থেকে নাগরিক অধিকারকে রক্ষা করা যায়। একটি স্বতন্ত্র, স্বাধীন বিচার ও সাহসী বিচার ব্যবস্থাই নির্ভীক ও নিরপেক্ষভাবে আইন প্রয়োগ করতে পারে এবং মৌলিক অধিকারের কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে পারে। বাংলাদেশ ও তৃতীয় বিশ্বের পেক্ষাপটে ক্ষুধা থেকে মুক্তি হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। জাতীয় অধ্যাপক এর ভাষায়-বাকস্বাধীনতা ও ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা বলা খুব একটা অর্থপূর্ণ নয়, কারণ নিরন্ন ও ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য এটা কোনো ব্যাপার নয়। (Kabir Chowdhury, Reflection on Human rights day 1982 Dhaka 1983, P-40)। 

আর এখন মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রক্রিয়া চালু রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, যদি মুক্তবাজার অর্থনীতি উন্নয়নের সকল সমস্যার সমাধান করে দারিদ্র্য বিমোচন করতে সমর্থ হতো তাহলে ধনশালী দেশে অত্যন্ত পীড়াদায়ক দারিদ্র্যের উপস্থিতি দেখা যেতো না। স্বল্প আয়ের দেশে দারিদ্র্য, নীতি নির্ধারক, সাহায্যদাতা দেশ এমনকি গবেষকদের খণ্ডিত মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছে, ফলে অদূরদর্শী সাময়িক ও অসমন্বিত নিরীক্ষামূলক অনেক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কিন্তু দারিদ্র্যের উপর আধিপত্য ও খবরদারির মানসিকতা থেকেই এ সম্পর্কিত তথ্য প্রবাহ ও প্রশাসন চালু থেকেছে, ফলে সাহায্য ও ক্রিয়াকর্ম ক্ষমতাবানদের স্বার্থ সংরক্ষণেই মূলত ব্যয় হয়েছে। 

এ মানসিকতার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হলো ব্রিটেন আর যুক্তরাষ্ট্রের আফ্রো এশিয়ানদের প্রতি আচরণ। স্বার্থ সংরক্ষণকে সাহায্য দিয়ে ভারসাম্য রাখা হয়েছে মাত্র। স্মর্তব্য, দারিদ্র্যকে নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিন্যাস থেকে বিযুক্ত করে বিবেচনা করা যায় না, কারণ ঐগুলোই দারিদ্র্য সৃষ্টি, ধারণ ও প্রসারণের মূলে রয়েছে। দারিদ্র্য হলো এক বিশেষ অবস্থায় ক্ষমতাধর মানুষের স্বেচ্ছাচারমূলক পীড়ন যার দরুন ক্ষমতাহীনরা নিজেদের সমৃদ্ধ করার সুযোগ ও সম্ভাবনা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। 

দারিদ্র্য বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের দু-তৃতীয়ংশ জনগণের বসবাস উন্নয়নশীল দেশে এবং তাদের মাথাপিছু বার্ষিক গড় আয় শিল্পোন্নত দেশের অধিবাসীদের মাথাপিছু গড় আয়ের এক দশমাংশেরও কম। বিশ্বের অর্ধেক লোক আধপেটা খেতে পারে। পুষ্টির অভাবে ভোগে, নিরক্ষর থাকে এবং এ ধরনের জনসংখ্যা বিপজ্জনক হারে বেড়ে চলেছে। 

তদুপরি হ্যাভস ও হ্যাভসনটস এর ব্যবধান বাড়ছে এবং দারিদ্র্য এ সুযোগ-সুবিধার অভাবের সাথে বর্ণ ও গোত্র যোগ হয়েছে। একদিকে ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর প্রবল দারিদ্র্য বেড়ে চলেছে, অন্যদিকে বিত্তশালী মুষ্টিমেয় লোকদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমতাবস্থায় মানবাধিকার রক্ষিত হয় কি? মানবাধিকার হচ্ছে সেসব অধিকার যেগুলো মানব জাতি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যেক মানুষ ভোগ করার অধিকার পায়।

বৈধতার দৃষ্টিকোণ থেকে এটা হচ্ছে এমন এক ক্ষমতা যার দ্বারা একজন মানুষ কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে কতিপয় কাজ করাতে কিংবা করা থেকে নিবৃত্ত রাখতে পারে। ন্যায়পরায়ণতা ও মানবাধিকারের মানব জাতির গঠিত অধিকার এবং মানব সভ্যতার প্রাথমিক যুগ থেকে এটার গুরুত্বকে চিহ্নিত করা যায়। মানব জাতির উপর নির্দেশিত দশটি অনুশাসন বা বিধির মধ্যে চারটি হচ্ছে এক তোমরা কাউকে হত্যা করতে পারবে না, দুই তোমরা চুরি করতে পারবে না, তিন তোমরা মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে পারবে না এবং চার তোমরা প্রতিবেশীদের বাড়ি কিংবা গবাদি পশু কিংবা কোনো জিনিষের প্রতি লোভ করতে পারবে না। 

অনুশাসন বা বিধিসমূহ যা বলে তা হচ্ছে এই যে, সকল মানব জাতি তাদের জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির উপর স্বেচ্ছাচারিতা ও অবৈধ হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকার অধিকার রাখে। ধর্মীয়, নৈতিক ও বৈধ নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইতিহাসের প্রারম্ভ থেকে রাজা বা শাসকদেরকে অনেক সময় তাদের প্রজা বা শাসিতদের সাথে অন্যায় আচরণ করতে কিংবা তাদের অধিকার ও স্বাধীনতা থেকে নগ্নভাবে তাদেরকে বঞ্চিত করতে দেখা যায়। তাদের মধ্যে একজন ইংল্যান্ডের রাজা ‘জন’ তার জনগণের মধ্যে এতো বেশি অজনপ্রিয় ও ঘৃণ্য ছিলেন যে, আজ পর্যন্ত কোনো ইংরেজ রাজা তার নাম উচ্চারণ করেননি। 

জনগণ তার কাছ থেকে স্বাধিকার প্রাপ্তির মহাসনদ পত্র ম্যাগনাকার্টা জোরপূর্বক আদায় করে নেয়, যা তখন থেকে মানব জাতির মৌলিক মানবাধিকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক নথিপত্র হিসাবে আখ্যায়িত হয়। এই মহাসনদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অনুচ্ছেদ হচ্ছে- ‘কোনো স্বাধীন ব্যক্তির স্বাধীনতা খর্ব করা যাবে না কিংবা তাকে কারাগারে দেয়া যাবে না কিংবা তার স্বাধীন চেতনা বা স্বাধীনতা বা মুক্ত প্রথাকে অবরুদ্ধ করা যাবে না কিংবা তাকে নির্বাসিত করা যাবে না, কিংবা কোনোভাবেই ধ্বংস করা যাবে না, তবে দেশের আইন কিংবা রাজার আইনানুগ রায় দ্বারা তা করা যাবে।’’ (W.D Guthrie, ‌‘Magna Carta’ in E.C Gerhart (ed) The Lawyer’s Treasury, Charter Books, Newyork, 1963, P-78)। 

স্বভাবতই ম্যাগনাকার্টা স্বৈরাচার ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে শোষিত ও বঞ্চিতদের উত্তেজনাপূর্ণ যুদ্ধ হুংকারসহ স্বাধীনতা এবং মুক্তির প্রতিরূপ হয়ে দাঁড়ায়। ইউরোপে যখন রেনেসাঁ ও মানবাধিকার চেতনার বিকাশ ঘটেছিল কলম্বাস ও তাঁর সঙ্গীরা তখন আদিম আমেরিকানদের মৌলিক স্বাধীনতা নৃশংসভাবে লুট করেছিলেন। বিশ্বের সর্বপ্রথম মানবাধিকার রিপোর্ট হিসাবে ব্রিফ হিস্ট্রি অব দি পেস্ট্রাকসন অব দি ইন্ডিস (১৯৫০-৫১ খ্রিস্টাব্দে) কে বলা হয়। 

বিল অফ রাইটস (১৬৮৯), দি আমেরিকান ডিক্লারেশন অব ইন্ডিপেন্ডেন্স (১৯৯৬) ও ফ্রেঞ্চ ডিক্লারেশন অব দি রাইটস অব ম্যান অ্যান্ড সিটিজেন (১৭৮৯) স্বাধীনতা, সম্পত্তি এবং শোষণের প্রতিরোধের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। ১৯৪৮ সালে সার্বজনীন মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা ১৯৭৬ সালে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিল হিসাবে বাস্তব রূপ লাভ করে। সে সাথে নাগরিক অধিকার আদালত কর্তৃক সংরক্ষণের অধিকার রক্ষিত হয়। 

এটাও ঠিক, মানবাধিকার এখন আর রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অধিক্ষেত্রের বিষয় হিসাবে শৃঙ্খলিত নেই, বরং একটি আন্তর্জাতিকভাবে সংশ্লিষ্ট বিষয় হিসাবে স্বীকৃত। গণতন্ত্র, আইন ও আদালত অধিকার রক্ষায় চূড়ান্ত ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু এগুলো যথেষ্ট নয়। অন্যান্য অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে মানবাধিকার সমর্থনে দেশব্যাপী কার্যকর জনমত জোরদার করা, নাগরিকদের মধ্যে কর্তব্য ও দায়িত্ব সচেতনতা এবং সহিষ্ণুতা ও সদা সতর্কতা। 

বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি, অপব্যবহার উদ্ঘাটন ও আবিষ্কারের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ানোর ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করছে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে। কিন্তু এসবই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে দারিদ্র্যতা, কুসংস্কার এবং আইন-শৃঙ্খলার অবনতির কাছে- এগুলো মানবাধিকারের দরজায় লাত্থি মেরে চলেছে। ন্যূনতম ক্যালরি গ্রহণ ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ব্যতিরেকে মানবাধিকারের কথা বলা নিরর্থক, অস্থিতিশীল সমাজের দিকে অগ্রসর হওয়া। 

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট