একটা কথা সটান বলে দেয়া ভালো যে আমাদের দেশের শিক্ষকতা পেশা আকর্ষণীয় না যতটা অন্য পেশা। শিক্ষকদের বেতন কাঠামো এবং জীবনযাত্রার মান দক্ষিণ এশিয়ার শিক্ষকদের তুলনায় বেশ পেছনে। সেই র্যাঙ্কিং আর উল্লেখ না করি। অতীতের চেয়েও এখন বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বেশি হলেও এখনও অনেক পিছিয়ে। অনেক ক্ষেত্রে বৈষম্য বিদ্যমান। যেমন- বেসরকারি শিক্ষকদের উৎসব বোনাস। তারপরও চলছে। কবে এসব সমস্যার সমাধান হবে তা নিশ্চিত না।
সবচেয়ে আফসোসের বিষয় হলো খুব কমসংখ্যক শিক্ষকই চান তার সন্তান বড় হয়ে শিক্ষকতা পেশায় আসুক। শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির বিষয়ে বহু বিশেষজ্ঞ মত দিয়েছেন। আর এ কথাও সর্বাগ্রে সত্যি যে মানসম্মত শিক্ষার সাথে শিক্ষকদের জীবনমান ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। এটা কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
যাই হোক আমাদের দেশে এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক স্কুল কলেজে চাকরিরত শিক্ষকদের শিক্ষকতা পেশা শেষে ভোগান্তির নাম হলো পেনশনের টাকা পাওয়া। এই সময় শিক্ষকদের কাছে পেনশন মানেই টেনশন! অথচ শিক্ষকদের কাছ থেকেও একটি অংশ কেটে নেওয়া হয়। তারপরও পেনশনের টাকা পেতে পায়ের জুতা আর মাথার ঘাম কেন শেষ হয় এ প্রশ্ন থাকলেও সঠিক উত্তর নেই। এই সমস্যা বহু যুগের। চাকরিকালীন সময়ে সংসার সামলানো নিয়ে টেনশন করবে আবার চাকরি শেষে পেনশনের টাকা পাওয়া নিয়ে টেনশন করবে। এই তো নিয়তি!
খুব সম্প্রতি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৭৪ হাজারের বেশি শিক্ষক অবসর ও কল্যাণের টাকার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। বিষয়টা আমাদের জন্য মনে হয় লজ্জার। এই লজ্জা সবাইকে স্পর্শ করা দরকার। কিন্তু করে বলে মনে হয় না। শিক্ষকদের কষ্ট সবাইকে কাঁদাতে পারে না। সেটি হলে অনেক আগেই এই সমস্যার সমাধান হতো।
শিক্ষকরা কেন দ্বারে দ্বারে মানে এ টেবিল থেকে ও টেবিল ঘুরবেন প্রতিদিন সেই উত্তর কার কাছে আছে? ঘোরার তো কথা ছিল না। এ টাকা পাওয়ার কথা ছিল নির্বিঘ্নে। কত খরচই তো কত উন্নয়ন কাজে ব্যয় হচ্ছে। অথচ শিক্ষকরা কেন তাদের প্রাপ্য অর্থ পেতে এত ভোগান্তি পোহাবেন? শিক্ষকতা পেশা আকর্ষণীয় করতে এটাও তো একটা বড় শর্ত।
সে যদি দেখে তার শিক্ষক চাকরি শেষে পেনশনের টাকার জন্য ঘুরে ঘুরে হয়রান হচ্ছেন তখন সে কি আর তার স্যারের আদর্শে শিক্ষক হতে চাইবেন। আদর্শ দিয়ে বুক ভরলেও পেট তো ভরে না। সংবাদের জানা গেছে, প্রতিদিনই শত শত শিক্ষক পেনশনের টাকার জন্য ধরনা দিচ্ছেন ব্যানবেইস ভবনে। শিক্ষক-কর্মচারীদের আবেদনের চার বছরেও মিলছে না টাকা। পেনশনের টাকা পেতে বড় পেরেশানির মধ্যে পড়েছেন তারা। জানা গেছে, প্রতিবছর বাজেটে ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন।
সত্যি কি এই পরিমাণ অর্থ খুব বেশি কিছু? একটু সদিচ্ছা থাকলেই এই ভোগান্তি মুক্ত করতে পারে কর্তৃপক্ষ। জাতির বিবেকরা টেবিল থেকে টেবিলে ঘুরবেন, আর জাতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের পেনশনের জন্য রয়েছে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট। শিক্ষকদের প্রতি মাসের মূল বেতন থেকে অবসর বোর্ডে কেটে নেয়া হয় ৬ শতাংশ এবং কল্যাণ ট্রাস্টে কেটে নেয়া হয় ৪ শতাংশ টাকা।
কিন্তু বেতন থেকে কেটে নেয়া অর্থে পেনশনের পুরো টাকা পরিশোধ করা সম্ভব নয়। আর সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিবছর বাজেটে এবং চাহিদামতো এককালীন থোক বরাদ্দ না দেওয়ায় ৭৪ হাজার শিক্ষকের আবেদনের স্তূপ জমা হয়েছে। এর মধ্যে অবসর বোর্ডে আবেদন জমা রয়েছে ৩৮ হাজার এবং কল্যাণ ট্রাস্টে আবেদন জমা ৩৬ হাজার। শিক্ষার আলো ছড়িয়ে জীবনের প্রায় পুরোটা সময় পার করেছেন যেসব শিক্ষক, বৃদ্ধ বয়সে তাদের বেশির ভাগেরই এখন দিন কাটছে নিদারুণ কষ্টে।
নিজের চোখে আমার শিক্ষকদের দেখেছি অবসর পরবর্তী জীবনে তারা কত যন্ত্রণা সহ্য করেন। সকলের সংসারই তা সচ্ছল থাকে না। কারও শরীরে বাসা বাঁধে নানা ধরনের অসুখ-বিসুখ। সেসব চিকিৎসা করানোর জন্য দরকার অর্থ। তাদের আশা থাকে পেনশনের টাকা দিয়ে চিকিৎসা করাবেন। কিন্তু সেই টাকা পেতেই গলদ্ঘর্ম হয়ে যায় জীবন। চিকিৎসা তো অনেক পরের কথা।
আবার নিজেদের প্রাপ্য অবসরকালীন সুবিধা বুঝে নিতে গিয়ে পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছেন এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা। এই বয়সটা কি এত ঘুরে পেনশনের টাকা তোলার বয়স? অথচ বছরের পর বছর দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে তাদের। টাকা না পেয়ে অনেকে চিকিৎসা করাতে পারছেন না, দারিদ্র্যের জালে আটকে হাজারো পরিবার। অনেক পরিবারের দিন কাটছে অর্ধাহারে।
উচ্চ আদালতের নির্দেশ হলো, অবসর নেয়ার ছয় মাসের মধ্যে এ সুবিধা বুঝিয়ে দিতে হবে। কেন এদেশে একজন বুয়েট, রুয়েটে পড়া শিক্ষার্থী তার শিক্ষাজীবন শেষে শিক্ষকতা পেশাকে প্রথমেই চয়েস করেন না সেটা ভাবতে হবে। আমাদের তাদের মতো মেধাবী দরকার। তাদের মেধা ছড়িয়ে দিতে শিক্ষকতায় আনতে হবে।
আর মেধাবী কেউ শিক্ষকতা করতে চাইলেও কলেজ এবং মাধ্যমিকে। তারপর প্রাথমিকে আসে। এর কারণ হলো গ্রেডে বৈষম্য। কে আর সাধ করে নিচে থাকতে চায়! একই শিক্ষাগত যোগ্যতা, পরীক্ষায় লিখিত এবং মৌখিক স্তর উত্তীর্ণ হয়েই প্রাথমিকের শিক্ষকরা তাদের পেশায় যোগদান করেন। পেশা এক, শিক্ষাগত যোগ্যতা এক অথচ বেতন গ্রেড ভিন্ন! কেউ বলতেই পারেন যে তাহলে একজন প্রাথমিকে চেষ্টা না করে মাধ্যমিকে বা কলেজে চেষ্টা করলেই পারে! তাহলে কি প্রাথমিকে মেধাবীদের দরকার নেই? একদিকে বলা হচ্ছে শিক্ষকতা মহান পেশা।
অন্যদিকে সেইসব শিক্ষকদের জীবনের শেষভাগে দুর্দশা। একটি দেশ এগিয়েছে বলে আমরা যে চিৎকার করছি সেই দেশ এগিয়ে চলার নির্ণায়ক কী? এই শিক্ষকদের হাতে শিক্ষা নিয়ে কত বড় সচিব হয়েছেন, বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। এই দ্বারে দ্বারে ঘোরা শিক্ষকরা যখন সেই সব ছাত্রদের কাছেই তাদের জীবনের শেষ পাওনাটুকু নেওয়ার জন্য যাচ্ছেন এবং ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তারা শূন্য হাতে ফিরছেন।
শিক্ষকরা হলেন জাতির নির্মাণের কারিগর। জাতিকে সঠিক পথে পরিচালনা করার চাবিকাঠি থাকে শিক্ষকদের হাতে। বাংলাদেশের শিক্ষকদের বেতন কাঠামো আরও বৃদ্ধি করা দরকার। যারা দেশকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে পারেন সেই শিক্ষকরা যদি অবহেলিত থাকেন তাহলে জাতির প্রকৃত সমৃদ্ধি কোনোদিনই সম্ভন না। বাহ্যিক উন্নয়ন কোনো স্থায়ী ভালো লাভ করতে পারে না।
সারা জীবন শিক্ষকগণ সংসারের বোঝা কোনোভাবে টানবেন এবং চাকরি জীবন শেষে সেই দুর্ভোগ পোহাতে হলে শিক্ষকতা পেশা কিভাবে আকর্ষণীয় হবে? আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে শিক্ষকতা আকর্ষণীয় করতে হলে শিক্ষকদের জীবনমান উন্নয়নে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে। এমপিও ভুক্ত শিক্ষকগণ অবসর জীবনের পর যত দ্রুত সম্ভব পেনশনের টাকা পরিশোধের ব্যবস্থা করতে হবে। এখানে প্রয়োজন সদিচ্ছা।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
Comments