এখানে নদীও নারীর মতো কথা কয়...। শৈশবের দূর থেকে ভেসে আসা সুরেলা গানে পেতাম পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমা নদীর অস্তিত্ব। কোনো নদীর সঙ্গেই পরিচয় না থাকলেও এটুকু অন্তত বুঝতাম, নদী মানেই বিশেষ কিছু। কিন্তু এই দেশাত্মবোধক গানের একপর্যায়ে যখন আবার গাওয়া হতো- এখানে নদীও নারীর মতো কথা কয়; না থমকে উপায় থাকত না।
নারী কথা বলবে, বেশি বললে মুখরা রমণী শব্দবন্ধ বরাদ্দ তো আছেই কিন্তু নদী কীভাবে নারীর মতো কথা কয়! তার মুখ-ঠোঁট কোথায়, শ্রোতা কোথায়;কথক হওয়ার দরকারই বা কী! এখন মনে হয়, নদী আদতেই কথা কয়। নইলে ছলাৎছলাৎ কলকল শব্দের দ্যোতনা কেন; অনুপ্রাস কেন বারংবার বেজে যাবে মনোগহিনে! এখনকার অধিকাংশ নদী নীরব-নিশ্চুপ।
কুলকুল ধ্বনি নেই কোথাও। তাতে কী, নীরবতাও তো একধরনের ভাষা। এই নীরব ভাষা বুঝিয়ে দেয় নদী আর ‘নদী’র জায়গায় নেই। নঞর্থক বিষয় হয়ে গেছে! সব মানুষই বুকের ভেতরে বয়ে বেড়ায় এক বা একাধিক নদী। যে মানুষের নদী নেই, নদীতট নেই সে বড়ই দুর্ভাগা। এই দুর্ভাগাদের একজন ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। যদিও পরে ফিরতেবাধ্য হয়েছিলেন কপোতাক্ষ নদের কাছে। মাঝখানে, প্রবাসের উচ্চাকাক্সক্ষার সময়টুকু তার ‘শিক্ষাকাল’!
এই যে বললাম কপোতাক্ষ নদ, নদীরও লিঙ্গ হয় সেটা জেনেছি অনেক পরে এসে। ছোটবেলা থেকেই জেনে এসেছি নদী নারীবাচক শব্দ। যা কিছু মোহনীয়, কমনীয় তা-ই নারীবাচক; আর নারীবাচক শব্দের শেষে দীর্ঘ ঈ ব্যবহার করতে হয়। তরঙ্গিনী, স্লোতস্বিনী, কিশোরী, তরুণী, রমণী, জননী...। সময়ের ব্যাকরণ অনেক কিছুই পাল্টে দেয়। এখন খোদ নদীর নামই অনেকে হ্রস্ব ই কারদিয়ে লিখছেন।
‘নদি’ ব্যবহার করে বিস্তর লেখাজোকাও আছে! চীন বানানও এখন ‘চিন’ হয়ে গেছে। সব অচেনালাগে, বহুত কিছুই বেখাপ্পা মনে হয়। আউলাঝাউলা। পৃথিবী যখন এগিয়ে যায় তখনো আমি এইসব ব্যাস-বৃত্তে ঘুরপাক খাই। গোলকধাঁধার পথ ফুরায় না। ক্লান্তি ঘোচে না। ব্যাকরণ-তাত্ত্বিকরা বড়ই অস্থিরমতি!
ব্যক্তিগত কোনো নদী আমার ছিল না। এলাকার নদীর নামও জানতাম না। নদীমাতৃক দেশে সব জেলার উপর দিয়েই বয়ে গেছে নদী। নদীর সঙ্গে অনেকেরই প্রয়োজনীয় ও প্রাত্যহিক মিতালি। কারও কারও জীবন-জীবিকারও উৎস। কিন্তু আমার নদী কই; ছোট থেকে বড়বেলায় পর্যন্ত কখনো নদীর মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ পাইনি! একদিন হাতিরপুলের আড্ডায় নিজস্ব নদী বিষয়টাকে উসকে দিলেন কবি ও লিটল ম্যাগাজিন ‘নান্দিক’ সম্পাদক ইসমত শিল্পী। আমার এলাকার নদীর নাম কী জানতে চাইলেন।
এমন প্রশ্নে হতবিহ্বল হয়ে উপলব্ধি করলাম, নদী তো কখনো টানেনি আমাকে! কিংবা আমিই থেকেছি নদী-বিমুখ! ইলিশের মৌসুমের গ্রামের অবস্থাপন্ন পরিবারের তরুণরা তোরাবগঞ্জ হয়ে নদীপাড়ে যেত, কম দামে জেলেদের কাছ থেকে ইলিশ কিনতে। টাকার জোগান না থাকায় অত দূরের স্বপ্ন কখনো দেখিনি। রামগতি হয়ে ভোলায় যাতায়াত করা যায়, সেসবও শোনা গল্প।
শুধু বেড়ানোর জন্য যাব এমন পরিকল্পনা থাকলেও শেষপর্যন্ত বাস্তবায়ন ঘটাতে পারিনি। অথচ নদীর ঘাটেই বসবাস করি! কীভাবে পেলাম নদীর অদৃশ্য ঘাট, বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা না করলে বোঝা যাবে না। ঘনবসতিপূর্ণ বাড়িতে আর বসবাস করা যাচ্ছিল না। পরিবারের সদস্য সংখ্যা বাড়লে নতুন নতুন ঘরদোরও তুলতে হয়। কিন্তু জায়গা-জমি তো আর অসীম নয়।
বিকল্প আবাসন খুঁজতে খুঁজতে তাই চলে আসতে হল পার্শ্ববর্তী থানায়। দূরত্ব বিশ মাইলের মতো। তুলনামূলক কম টাকায় অনেক জায়গা-জমি কেনা গেল, প্রস্তুতকৃত বাড়ি-ঘর, গাছপালা, পুকুরসহ আনুষঙ্গিক সবকিছুও। এখন প্রয়োজন সেসবের রক্ষণাবেক্ষণের। বর্তমানের প্রায়-চরাঞ্চল, অতীতে চর এলাকা ছিল বলে ইরি ধান হয় না। সেচের ব্যবস্থা নেই। যে বছর সূর্য একটু বেশি তাপ ঢালে, এই মাথা থেকে ওই মাথা পর্যন্ত পুড়ে যায় ফসলের খেত। শুকনো-খটখটে ফসলের গোড়ালির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ ছাড়া কিছু করার থাকে না।
চা দোকানে, বয়স্কদের কাছ থেকে জেনেছি পরে- যেখানটায় আমাদের বাড়ি ঠিক সেখানেই ছিল নদীর ঘাট। এই ঘাটে এসে ভিড়ত জাহাজ। সময়ের ফেরে এই নদী চর ফেলতে ফেলতে ক্রমশ চলে গেছে অনেক দূরে। এজন্যই কি গানে বলা হয়েছে- নদীর এই কূল ভাঙ্গে ওই কূল গড়ে এই তো নদীর খেলা/ সকালবেলার আমির আমি ফকির সন্ধ্যাবেলা...। নদীর কূল ভেঙ্গে একদিকে যেমন বাড়িয়ে তোলে শিকস্তির হাহাকার অন্যদিকে উর্বর পলি পেয়ে হাসি ফোটে অন্য কোনো কৃষকের মুখে। এই ভাঙ্গাগড়া চলে আসছে আবহকাল ধরে। একদিকে ফসল পুড়ে ছাই হয়, অন্যদিকে সবুজ উৎসব।
অনুসন্ধান করে জানলাম, এলাকার নদীর নাম মেঘনা। যদিও ‘এলাকার’ শব্দের বদলে জেলা বলাই ভালো। পলি ফেলতে ফেলতে নদীটি চলে গেছে অনেক দূরে, আরও থানা-উপজেলাকে মাড়িয়ে। মোটামুটি ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। ঠিকুজির কিছুটা মিলল কিন্তু সেখানে যাওয়া কি এতটা সহজ! যেমন সহজ ছিল না নিঝুম দ্বীপ, হাতিয়া কিংবা সন্দ্বীপে যাওয়া। এই অক্ষমতাকে সামনে এনে দেয় লালনের গান- লালন মরল জল পিপাসায়/ থাকতে নদী মেঘনা/ আমার হাতের কাছে ভরা কলস/ তৃষ্ণা মেটে না...। জীবনতৃষ্ণা নদীর দিকে ঠেলে দেয় বটে, কিন্তু জীবনের রাক্ষুসে চাহিদার কাছে সে বরাবরই পরাস্ত হয়। দ্বৈতসত্তার যুদ্ধে দূর থেকে দূরে সরে নদী। জিইয়ে রাখে গ্লানির সাম্রাজ্য।
পথিক নবী যখন গেয়ে ওঠেন- নদীর জল ছিল না কূল ছিল না ছিল শুধু ঢেউ/ আমার একটা নদী ছিল জানল না তো কেউ...; জল-কূলহীন সেই নদী আবার কেমন নদী! ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই চোখের সামনে এসে দাঁড়ায় পচা-দুর্গন্ধযুক্ত বুড়িগঙ্গা। এই নদীতীরেই গড়ে উঠেছিল সভ্যতা, নগর ঢাকা- ভাবতে গেলে আজ খেই হারাতে হয়। নোংরা মানুষরা সাধারণ মানুষের চিন্তাকেও নিয়ন্ত্রণ করছে।
চাইলে, কজনের পক্ষে সম্ভব হবে স্ফটিক-স্বচ্ছ বুড়িগঙ্গার চেহারা মনে ভাসাতে! অথচ স্বচ্ছ একটি নদীতীর পেলে ঢাকাবাসীর বিনোদনের ক্ষেত্র সৃষ্টি হতো। মিটত মনের চাহিদা। এদিক থেকে দ্বিতীয় বড় শহর চট্টগ্রামের লোকজন ভাগ্যবান। পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত, আনোয়ারার পারকির চর, কাট্টলীর রানি রাসমণির বিচ, সীতাকুণ্ডের নদী দিয়েছে নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা।
সাতকানিয়ায় আছে অদ্ভুত সুন্দর এক ডলু নদী। এই নদী উঠে এসেছে শহীদুল জহিরের লেখায়। তার ‘ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প’ বইটিও ধারণ করেছে নদীটিকে। এই নদী প্রস্থে আবার খালের মতো। তবে ডলুর চেয়ে সরু নদী দেখেছিলাম চুয়াডাঙ্গায়। এগুলোকেও যদি নদী বলতে হয়, তাহলে যৌবনবতী খালকে অবমূল্যায়ন করাই হয় বটে!
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও পর্যটক
Comments