জ্বালিয়ে ছিলে দ্রোহের অনল, উজ্জীবিত হয়েছিল যুব তরুণ জনতা, এসেছিল ’৬৯-এর অভ্যুত্থান। সৃষ্টি করেছিলেন পৃথিবীতে প্রেমের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন অবকাঠামোগত নয়। যা মন-মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত প্রেমাসৌধ। মানব-মানবীর প্রেম পৃথিবীতে যতদিন রবে, হেলাল হাফিজের প্রেম নির্দশনটিই প্রেমিক-প্রেমিকার মনে বয়ে বেড়াবে।
নেত্রকোনায় জন্ম নেয়া মানুষটি স্বল্পসংখ্যক কবিতা লিখে বাংলা সাহিত্য পরিমণ্ডলকে দিয়ে গেছে এক নতুন ঐশ্বর্য। যা অপরিমাপীয় সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ। ৭ অক্টোবর ১৯৪৮ সালে নেত্রকোনা জেলার আটপাড়ায় জন্ম নেন হেলাল হাফিজ। অল্প বয়সে তিনি মাকে হারান। নেত্রকোনায় উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন উচ্চ শিক্ষায়। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান কেন্দ্র করে হেলাল হাফিজের জীবনে ঘটে যায় একটি ঘটনা। সেই সময় হেলাল হাফিজ রিক্সায় করে পুরনো ঢাকার দিকে যাচ্ছিলেন। যেতে যেতে রিক্সা থেকে দেখলেন ছাত্র-জনতার উপর বেধড়ক লাঠি পেটা করছে পাক আর্মি ও পুলিশ। ছাত্র-জনতাও ঢিল ছুড়ে এই লাঠিপেটার উত্তর দিচ্ছে। হেলাল হাফিজকে বহনকারী রিক্সাওয়ালা পাক আর্মি ও পুলিশকে খিস্তি করছেন, এবং ছাত্র জনতাকে উদেশ্য করে রিক্সা ওয়ালাটি বলছে মার শালাদেরকে । ঘটনাটি হেলাল হাফিজের মনে রেখাপাত ঘটালো। তিনি রাতে হলে এসে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে লাগলেন। আর ওই রাতে তিনি লিখে ফেলেন তার বিখ্যাত ঐতিহাসিক কবিতা নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়। যাতে চয়ন করা ছিল অগ্নিঝরা স্লোগান। স্লোগানটি ছিল “এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’’ হেলাল হাফিজের এই কবিতাটা দ্রোহের আগুন হয়ে বেড়িয়েছিল সারাদেশে।
হেলাল হাফিজ বলে গেছেন, ছফা ভাই (প্রখ্যাত দার্শিক ও লেখক আহমদ ছফা) আমাকে অনেক আদর করতেন। আমার নিষিদ্ধ সম্পাদকীয় কবিতাটা লেখা যখন শেষ করলাম, তখন ছফা ভাই আমাকে এক কবির বাড়ি নিয়ে গেলেন। তার নাম হুমায়ন কবির, বাড়ি বরিশালে। হুমায়ন কবির, ছফা ভাাইয়ের সাথে আমি দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার সম্পাদকের কাছে যাই। দৈনিক পাকিস্তানের তখন সম্পাদক ছিলেন আহসান হাবিব। নিষিদ্ধ সম্পাদকীয় কবিতাটা পড়ে আহসান হাবিব আহমদ ছফাকে বলেছিলেন “দেখ বাচ্চা ছেলেটা করেছেটা কি। এটা শুধুমাত্র একটি কবিতা নয় এটা একটি সশস্ত্র সংগ্রাম। আমি তো সরকারি চাকরি করি।
হেলালের কবিতা ও সংগ্রামে আমার পূর্ণ সমর্থন আছে তবে ছাপাতে পারব না। এই কবিতা তো আমার পত্রিকায় ছাপালে পত্রিকাসহ আমাকে পৃথিবী থেকে নিষিদ্ধ করে দেবে।” তারা সেদিন চলে এলেন দৈনিক পাকিস্তান অফিস থেকে। তারপর বাম ঘরানার লেখক কবিরা সারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে দু’রাতে লিখে ফেলেন “এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’’ কারণ ওই সময়টায় আন্ডার গ্রাউন্ডে বাম সংগঠনগুলো মুক্তিযুদ্ধ করার সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলছিল। তারপর তিনি মুক্তিযুদ্ধকে শাণিত করার জন্য একে একে অনেক গুলো কবিতা লিখে গেছেন, যেমন একটি পতাকা পেলে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। সাম্য, স্বাধীনতা, সমতার এক অন্যন্য প্রতীক কবি হেলাল হাফিজ। হেলাল হাফিজ ভালোবাসতেন হেলেনকে। হেলেনের প্রতি হেলাল হাফিজের এমন অকৃত্রিম ভালোবাসার নজির সারা পৃথিবীজুড়ে পাওয়া যাবে কিনা তা বিরল।
হেলাল হাফিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময় থাকতেন তৎকালীন ইকবাল হলে (যা পরবর্তীতে জহুরুল হক)। ১৯৭১ সালে পাক-হানাদার বাহিনী বর্বর হামলা চালায় ইকবাল হলে। সেদিন দৈবাৎক্রমে বেঁচে গিয়েছিল কবি। ২৫ মার্চ কবি রাতের খাবার খেতে বাইরে যান। খাওয়া-দাওয়া করে ফজলুল হক হলে তার এক বন্ধুর সাথে আড্ডা দিয়ে ওখানেই ঘুমিয়ে পড়েন। পরের দিন তিনি নিজের হলে এসে দেখেন লাশ আর লাশ। ইকবাল হল থেকে হেলাল হাফিজের লাশ নিতে ছুটে আসেন কবির ঘনিষ্ঠ বন্ধু কবি নির্মলেন্দু গুণ। হল গেটে হেলাল হাফিজকে দেখে মহানন্দে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠেন কবি নির্মলেন্দু গুণ।
কবির জীবনটা অনেক নিঃসঙ্গময়। মুক্তিযুদ্ধের পর তার পিতা মারা যায়। একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে কবিকে ডাকেন তার প্রিয়তমা হেলেন। কবি হেলেনের সাথে দেখা করতে আসলেন। হেলেন তখন কবিকে বলেন আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি মা-বাবার ইচ্ছায়। হেলেনের স্বামী ছিলেন ঢাকার মুন সিনেমা হলের মালিক। কবি নিশ্চুপ থাকলেন, হেলেন চলে গেলেন। প্রেম দ্রোহ ভালোবাসার কবি আড়ষ্ট হয়ে গেলেন। কবির জলে আগুন জ্বলল, তবে তা খালি চোখে দেখা গেল না, আর সেই যন্ত্রণার পরিমাপের সুচক বোধহয় ছিল না পৃথিবীতে। আজন্ম ছিলেন তিনি সঙ্গীহীন।
কবির নেত্রকোনা কবিতায় তার সন্ন্যাসী জীবনের কথাটি ফুটে উঠে “ দোহাই লক্ষ্মী মেয়ে কোনদিন জিজ্ঞেস কর না, আমি কেন এমন হলাম জানতে চেয়ো না, কী এমন অভিমানে আমাদের এতো ব্যবধান, কতোটা বিশৃঙ্খলা নিয়ে আমি ছিমছাম সন্ন্যাসী হলাম”। প্রেমিক তার প্রেমিকার প্রতি আকর্ষণটার প্রকাশ ভঙ্গির ধরনটা হেলাল হাফিজ কবিতায় নান্দনিকভাবে প্রকাশ করেছেন। কবি প্রেমিক-প্রেমিকার স্মৃতির রোমন্থন করতে গিয়ে লিখেছেন, “কোন কথাটা অষ্টপ্রহর কেবল বাজে মনের কোনে, কোন স্মৃতিটা উস্কানি দেয় ভাসতে বলে প্রেমের বাণে, পত্র দিয়ো পত্র দিয়ো।’’ কবি নেত্রকোনার মগড়া নদীকে খুবই ভালোবাসতেন, তাই তার কবিতায় মগড়া নদীর কথাটি ফুটে উঠেছে।
পুরুষের যৌবন শুধু নারী প্রেমে আবদ্ধ থাকার জন্য নয়, দেশ ও জাতির কল্যাণে যৌবন ব্যয় করাটা দরকার। এই বিষয়টিও ফুটে উঠেছে হেলাল হাফিজের কবিতায়, তিনি লিখেছেন, মানব জন্মের নাম হবে কলঙ্ক হবে, এমন দুঃখের সময়ে আমি যদি মিছিলে না যাই, উত্তর পুরুষের কাছে ভীরু কাপুরুষের উপমা হবো, আমার যৌবন দিয়ে এমন দুর্দিনে শুধু নারীকে সাজাই। নর-নারীকে একটি বন্ধনে আবদ্ধ করে শুধু পার্থিব জীবনে চলতে হয় এটা ঠিক না, একজনকে ছাড়াও অন্যজনকে চলতে হয় জীবনের তাগিদে, কথাটি ফুটে উঠে হেলাল হাফিজের কবিতায় ,
তিনি লিখেছেন, “সুতো ছিঁড়ে তুমি গোটালে নাটাই, আমিতো কাঙাল ঘুড়ি, বৈরী বাতাসে কি আশ্চর্য একা একা আমি আজও উড়ি”।
কবির জীবনবোথের উপলব্ধিটা ছিল খুবই প্রখর, তাই তিনি লিখেছেন, “জলের আগুনে পুড়ে হয়েছি কমল, কি দিয়ে মুছবো আগুনের জল”। পৃথিবীতে পরস্পরের প্রেম ভালোবাসা কোনো শর্ত বা চুক্তি দিয়ে হয় না, দুঠো হƒদয়ের একনিষ্ঠ টানই ভালোবাসা, কবি তার কবিতায় লিখেছেন, “বাঁধবো নিমিষে শর্তহীন হাত, গচ্ছিত রেখে লাজুক দু’হাত আমি, কাটাবো উজাড় যুগলবন্দি হাত, অযুত স্বপ্নে, শুনেছি জীবন দাবি। ভালোবাসা মাপার কি কোনো পরিমাপক যন্ত্র আছে, একজন প্রেমিক তার প্রেমিকাকে কতটুকু ভালোবাসে তা প্রেক্ষিতে কবি লিখেছেন, “দেখবো দেখাব পরস্পরকে খুলে, যতো সুখ ও দুঃখের সব দাগ, আয়না পাষাণি একবার পথ ভুলে, পরীক্ষা হোক কার কত অনুরাগ।”
কবি তার প্রেমিকার বিরহে লিখেছিলেন, “আমাকে ঠোকর মেরে দিব্বি যাচ্ছো চলে, দেখি দেখি, বাঁ-পায়ের চারু নখে চোট লাগেনি তো, ইস! করেছ কি? বস না লক্ষ্মীটি ক্ষমার রুমালে মুছে সজীব ক্ষতেই, এন্টিসেপ্টিক দুটো চুমো দিয়ে দেই। জোর করে ভালোবাসার মানুষকে আটকে রাখা যায় না, তাই কবি লিখেছেন, যদি যেতে চাও, যাও আমি পথ হব চরণ তলে, না ছোঁয়ে তোমাকে ছোঁব, ফেরাবো না, পোড়াবো হিমেল অনলে। কবি তার জীবনে ৫৮টি কবিতা লিখে গেছেন। তার কবিতাকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়, একটি ভাগ দ্রোহের অন্যটি প্রেম ও বিরহের। তবে কবির জীবনে বিরহটাই পুড়িয়েছে বেশি সময়কাল জুড়ে। কবি হেলাল হাফিজের প্রথম কবিতার বই বের হয় ১৯৮৬ সালে। কবিতার বইটির নাম যে জলে আগুল জ্বলে। কবির জীবনে আরো ট্র্যাজিকতাময় অধ্যায় রয়েছে।
কবি ১৯৭৬ সালে ঢাকা ছেড়ে নেত্রকোনায় চলে যান। তারপর সুদীর্ঘ দিন তিনি কবিতা লেখা থেকে বিরত থাকেন। তারও একটি কাহিনী আছে তা এই লেখায় বর্ণনা করলাম না। ২০১৩ সালে কবির আরেকটি কবিতার বই প্রকাশ পায়। তবে কবি হেলাল হাফিজ প্রেম ও দ্রোহ ৫৮টি কবিতার মাধ্যমে বাঙলা সাহিত্য অঙ্গনে যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তা বোধ হয় অন্য কোনো কবির পক্ষে সম্ভব হবে না। ২০২৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর কবি চলে যান অনন্তলোকে। তবে তার সৃষ্টির শিখাময় দ্রোহ আর মোমীয় আলোর প্রেম অনুশীলন করবে জগতের তরুণ-তরুণীরা।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
মানবকণ্ঠ/আরএইচটি
Comments