Image description

দেখতে দেখতে কেটে গেল একটি বছর। বিদায়ী বছর ২০২৪ রেখে গেল অনেক স্মৃতি। কোনোটি সাফল্যের আবার কোনোটি ব্যর্থতার। এভাবেই দিন আসে দিন যায়, বছর আসে বছর যায়। নতুন করে স্বপ্ন দেখতে দেখতে ক্যালেন্ডারের পাতা বদলায়, আসে নতুন দিন নতুন বছর। বিদায় ২০২৪! স্বাগতম ২০২৫। অন্য বছরগুলোর মতোই ২০২৪ ছিল নানা কারণে আলোচনা এবং সমালোচনায়। জন্ম দিয়েছে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার। সম্প্রতি প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ে ঘটেছে রহস্যময় অগ্নিকাণ্ড। গত ২৫ ডিসেম্বর বুধবার গভীর রাতে সাত নম্বর ভবনের ছয় থেকে নয়তলা পর্যন্ত চারটি ফ্লোরে আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় ১০ ঘণ্টা চেষ্টার পর ফায়ার সর্ভিসের ১৯টি ইউনিট আগুন নির্বাপণ করে। 

এ সময়ে ভস্মীভূত হয়েছে এলজিআরডিসহ ৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের আসবাবপত্রসহ গুরুত্বপূর্ণ সব নথি। আগুন নেভানোর কাজে গিয়ে ট্রাকচাপায় প্রাণ হারিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের এক সদস্য। আহত হয়েছেন আরও কয়েকজন। নজিরবিহীন এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অনেকেই বলছেন, এটি নিছক দুর্ঘটনা নয়। পরিকল্পিতভাবে এ অগ্নিকাণ্ড ঘটানো হতে পারে। তবে সরকারের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তদন্তের আগে কোনো কিছুই নিশ্চিত করে বলা যাবে না। অগ্নিকাণ্ডের সময় পুরো সচিবালয় এলাকা কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যায়।

আগুনের ঘটনায় বৃহস্পতিবার সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে ব্যাহত হয়েছে সচিবালয়ে স্বাভাবিক কার্যক্রম। দীর্ঘ ১০ ঘণ্টা পর আগুন পুরোপুরি নিভেছে। ছড়িয়ে পড়া আগুনের চারটি ফ্লোরে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগ, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের প্রায় সবকিছুই ছাই হয়ে গেছে। এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে- সচিবালয় এলাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। এই এলাকাটি নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা। এত গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় আগুন লাগে কেমনে। না-কি, এই আগুন লাগার পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। সেটা না হয় অন্তর্বর্তী সরকারের হাতেই ছেড়ে দিলাম।

২০২৪ সালে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয় ৪৬৭ জনের এবং আক্রান্ত হয় ৯০ হাজার ৭৯৪ জন। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ১ লাখের বেশি। বিদায়ী বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। জীবন মানেই মৃত্যুর পথে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলা। তবে জন্মালে মরতে হবেই, এটাই চিরন্তন সত্য।

১ জুলাই ২০২৪ থেকে সর্বজনীন প্রত্যয় পেনশন স্কিম নিয়ে সারাদেশে শিক্ষকদের কর্মবিরতি চলছিল। দল-মত নির্বিশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একযোগে আন্দোলন করতে দেখা গেছে। সরকারের ভাবগতিতে বোঝা গেছে, ছাত্রদের কোটাবিরোধী আন্দোলনে তারা যথেষ্ট সতর্ক হলেও শিক্ষকদের আন্দোলন নিয়ে মোটেই মাথাব্যথা নেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া অনুসরণ করলেই দেখা যায়, যখন যে দল ক্ষমতায় তখন তাদের পছন্দমতো শিক্ষক নিয়োগ দেয়, যোগ্যতা-অযোগ্যতার তোয়াক্কা করে না। শিক্ষক সমিতিগুলোর নেতারা সরকারপন্থি। তাদের নেতৃত্বেই ‘প্রত্যয়’ প্রত্যাহারের দাবিতে সব শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী অংশ নিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, দেশের বিবেক। সবসময় সরকারের পক্ষে কথা বলা তখনই সম্ভব, যখন সেখানে আপন স্বার্থের ভাগ থাকে। 

কোনো সরকারই সব কাজ সঠিক করে না, করা সম্ভবও নয়; অন্যায় কাজকে ‘অন্যায়’ বলেই শনাক্ত করা হয়। দেশের সব সমস্যাকে পিঠ দেখিয়ে চলা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা প্রত্যয় পেনশন স্কিম নিয়ে একাট্টা হয়েছিলেন। মানবিক সমাজ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। প্রত্যয় বাতিল করে নিজেদের জন্য পৃথক বেতন স্কেলসহ তিন দফা দাবি জানিয়ে আন্দোলন চালিয়েছেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজেদের ‘বিশেষ’ মনে করেন। ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে টানা চতুর্থবারের মতো নতুন সরকারের ক্ষমতা হাতে নেন শেখ হাসিনা। দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকার অভিজ্ঞতার পরও ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমাধান করতে পারেনি হাসিনা সরকার। একের পর এক বিতর্কিত বক্তব্য ও ভুল সিদ্ধান্তের ফলে ক্রমেই বেড়েছে আন্দোলনের তীব্রতা। যা সামাল দিতে না পেরে বাধ্য হয়ে ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। 

কোটা সংস্কার আন্দোলন বা জুলাই-আগস্ট আন্দোলন অথবা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ২০২৪ সালে বাংলাদেশের সব থেকে বেশি আলোচিত বিষয়। ২০২৪ সালের ৫ জুন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের জারি করা পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণার পর কোটা পদ্ধতির সংস্কার আন্দোলন আবার নতুনভাবে আলোচনায় আসে। শুরুতে আন্দোলন সভা-সমাবেশের মধ্যে স্থির থাকলেও ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার এক বক্তব্যে কোটা আন্দোলনকারীদের পরোক্ষভাবে ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ হিসেবে অভিহিত করেন। এর পর থেকেই কোটা আন্দোলন আরও জোরদার হয়। 

এ আন্দোলনে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী ও আন্দোলনকারী (প্রায় ২১ হাজার) আহত হওয়ার পাশাপাশি আবু সাঈদ ও মীর মুগ্ধসহ ১ হাজারের অধিক নিহত হন। তরুণ ছাত্র সমাজের হাত ধরে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ফের একবার জাগ্রত হয় বাংলাদেশ। ৫২, ৬৯ ও ৭১-এর পর ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতন ঘটিয়েছিল মূলত এদেশের ছাত্রসমাজ। দীর্ঘ সময় পর ২০২৪ সালে আরেকটি অভ্যুত্থান দেখল বাংলাদেশ। এবারও ছিল ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান। আন্দোলনের তীব্রতার মুখে ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দলোনে শেখ হাসিনা সরকারের করুণ পতন হবে এমন ধারণা সরকারের কেউই করতে পারেনি। সরকারের এমন আত্মবিশ্বাস ছিলো, তাদের প্রবল দাপটে যেকোনো আন্দোলন খড়কুটোর মতো উড়ে যাবে। সরকার পতনের যেকোনো আওয়াজকে তারা চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে সক্ষম। গত ১৫ বছর ধরে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরকে এমনভাবে সাজানো হয়েছিলো যে সেটাকে উপড়ে ফেলা বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে অসম্ভব ছিল। সাধারণ মানুষ হয়তো কল্পনা করতো যে শেখ হাসিনার স্বাভাবিক মৃত্যুর পর কিছু পরিবর্তন আসলেও আসতে পারে। কিন্তু কে জানতো একটা টর্নেডো এসে হাসিনা সরকারকে তছনছ করে দেবে। 

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এর পরপরই সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ঘোষণা দেন। তিন দিন পর ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। প্রধান উপদেষ্টাসহ এ সরকারের সদস্যসংখ্যা ২১। উপদেষ্টামণ্ডলীতে রয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ। এ ছাড়া প্রধান উপদেষ্টার দুজন বিশেষ সহকারী, একজন আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশেষ দূতও আছেন। 

২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে বছরের শেষ দিকটায় উত্তপ্ত ছিল রাজনীতির মাঠ। মাঠ দখলে রাখতে বছরের শুরু থেকেই নানা কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে রাজনীতির মাঠে নিজেদের সরব উপস্থিতির জানান দিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। বিএনপিও সারা দেশে মিছিল, মিটিংসহ গণসমাবেশ করেছে। ঢাকায় গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী ছিল উত্তেজনা। সেদিন ঢাকায় বিভাগীয় সমাবেশ ডেকেছিল বিএনপি। সমাবেশের স্থান নির্ধারণ নিয়ে শুরু থেকেই চলছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির যুক্তিতর্ক। সমাবেশের চার দিন আগেই বিএনপির নয়াপল্টন অফিসে সমাবেশের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন দলটির নেতাকর্মীরা। 

পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে মতিঝিল, দৈনিক বাংলা, নয়াপল্টনসহ সারা ঢাকা শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সংঘর্ষে একজন পুলিশ কনস্টেবলসহ ২ জন নিহত হয়। গ্রেপ্তার করা হয় হাজার হাজার বিএনপির নেতাকর্মীকে। বিএনপি-জামায়াতসহ সমমনা দলগুলো একের পর এক হরতাল, অবরোধ কর্মসূচি দিয়ে রাজনীতির মাঠকে উত্তপ্ত করে রাখে। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ২০২৩-এর মতো ২০২৪ ছিল একটি ঘটনাবহুল বছর। ব্যক্তি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে নানা চ্যালেঞ্জ ও উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছে বছরটি।

বছরের শেষ দিকে এসে বিএনপির নির্বাচন বর্জন এবং আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ আরও কয়েকটি দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ। নির্বাচন ঘিরেই সারা বছর আলোচনায় ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি, রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের কর্মকাণ্ড এবং ইইউসহ পশ্চিমা বিশ্বের বাংলাদেশ নিয়ে নানা বিবৃতি ও তৎপরতা।

নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষা ও মুখস্থনির্ভরতার পরিবর্তে অভিজ্ঞতানির্ভর পড়াশোনায় জোর দেয়া হয়। এতে বদলে যায় চিরাচরিত পড়াশোনার পদ্ধতি। শিক্ষাক্রমে এমন বিশাল পরিবর্তনে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা ছিল সারা দেশেই। মেট্রোরেল চালু হয়ে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত যাত্রী পরিবহন করছে। যেটি ঢাকার যানজটে নাকাল অনেকের জন্য স্বস্তির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পুরো বছরেই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে দিশেহারা ছিল সাধারণ মানুষ। কথায় কথায় হঠাৎ করেই দাম বাড়ানো হয়েছে আলু, পেঁয়াজ, মাছ, মাংস, ডিম ও শাক-সবজিসহ নানা পণ্যের। সাধারণ ভোক্তা ও ছোট ব্যবসায়ীরা আঙুল তোলেন সিন্ডিকেটের দিকে। কথিত এই সিন্ডিকেটকে সরকার যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি বলেও অভিযোগ ছিল সাধারণ মানুষের। একপর্যায়ে ডিম, আলু ও পেঁয়াজের দাম সরকার নির্ধারণ করে দিলেও এতে তেমন কাজ হয়নি। বরং আলু, পেঁয়াজের সিন্ডিকেট সরকারকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে তাদের ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়েছে।

নতুন বছর মানেই নতুন চাওয়া ভিন্ন স্বাদের বছর পাওয়া। সারা বিশ্বে কলরব নতুন বছরকে নিয়ে। কেমন কাটবে আমাদের এবারের নতুন বছর। নতুন বছরের অনুভ‚তিটাই অন্যরকম। এ নিয়ে অনেকের মধ্যে কৌত‚হল থাকে। নতুন বছরকে নিয়ে অনেকেই মজার মজার কবিতা ও ছড়া লেখেন। আবার কেউ কেউ লেখেন সুন্দর সুন্দর গল্পও। পুরাতন বছরের গ্লানিময় অতীতকে দূরে ফেলে নতুন বছরের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে প্রস্তুত সকলেই। নতুন বছর সবার জীবনে আনন্দময় হয়ে উঠুক এই প্রত্যাশা সবার।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট