Image description

অতি মূল্যবান একটি জীবন স্বেচ্ছায় সমাপ্তি টানার ঘটনা বৃদ্ধি আমাদের উদ্বিগ্ন করছে। দেশে আত্মহত্যা জনিত ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে এক তথ্যে জানা গেছে, পারিবারিক সমস্যা, হতাশা, সম্পর্ক নিয়ে জটিলতা, আর্থিক সমস্যাসহ বেশ কয়েকটি কারণে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের সারা দেশের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৩১০ জন শিক্ষার্থী ২০২৪ সালে আত্মহত্যা করেছেন। সমীক্ষা বলছে, এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছেন মেয়ে শিক্ষার্থীরা, এ হার ৬১ শতাংশ। 

শিক্ষার স্তর অনুযায়ী আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি ছিল মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে, ৪৬ দশমিক ১ শতাংশ। তবে এর আগের বছরের চেয়ে গত বছর আত্মহত্যার সংখ্যা কমেছে। ২০২৩ সালে ৫১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। আর ২০২২ সালে এ সংখ্যা ছিল ৫৩২। সংস্থাটির সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ‘গত বছর আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী, ৬৫ দশমিক ৭ শতাংশ। তার পরে রয়েছে ২০ থেকে ২৫ বছর বয়সী, ২৪ শতাংশ। আর আত্মহত্যা করা মোট শিক্ষার্থীর ৭ দশমিক ৪ শতাংশের বয়স ১ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। ২৬ থেকে ৩০ বছর বয়সী ছিল ২ দশমিক ৯ শতাংশ। আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩৮ দশমিক ৪ শতাংশ ছেলে। তৃতীয় লিঙ্গ ও ট্রান্সজেন্ডার শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ।’ 

২০২৪ সালে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ছিল স্কুলগামীদের মধ্যে, এ হার ৪৯ দশমিক ৪ শতাংশ। কলেজ পর্যায়ে ২৩ দশমিক ২ শতাংশ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ১৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ছিল ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। তাদের মধ্যে ছিল ৬ থেকে ১২ বছর বয়সী ৪৭ দশমিক ৬ শতাংশ, ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী ৪৭ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ২০ থেকে ২৫ বছর বয়সী ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। আর শিক্ষার স্তর অনুযায়ী, আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিল মাধ্যমিক পর্যায়ের ৪৬ দশমিক ১ শতাংশ, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ ও স্নাতক পর্যায়ের ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এছাড়া প্রাথমিক পর্যায়ে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ, স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ১ দশমিক ৯ শতাংশ, ডিপ্লোমা পর্যায়ের শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী এবং সদ্য পড়ালেখা শেষ করা বেকার শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ।

গত তিন বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আত্মহত্যার প্রবণতা কমেছে। কিন্তু এখনও সেই সংখ্যা অনেক। যারা আত্মহত্যা করেছে তারা মেধাবী এবং এই জাতির ভবিষ্যৎ শক্ত হাতে ধরতে পারতো, তাদের ওপর নির্ভর ছিল কিছু পরিবার, তাদের ঘিরে স্বপ্ন ছিল অসংখ্য মানুষের। তবুও তারা শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। কেন তারা এ পথ বেছে নিল? একজন শিক্ষার্থীর চোখে থাকে অনেক ধরনের স্বপ্ন। এই স্বপ্ন পূরণে থাকে বহুমুখী বাধা। সেই বাধা আসতে পারে যেকোনো অবস্থান থেকে। সেই বাধা অতিক্রম করে বিজয়ী হওয়ার নামই জীবন। আর্থিক সমস্যা থাকতে পারে, প্রেম ব্যর্থ হতে পারে কিন্তু সবার ওপরে জীবনটা যে অনেক সুন্দর সেই সত্য বোঝার ক্ষমতাও থাকতে হবে। যারা আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে তারা কেউ আমাদের ভবিষ্যৎ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা দক্ষ প্রশাসক হতে পারতো। 

সর্বোচ্চ শিক্ষিত এসব তরুণ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতো। তবুও তাদের আত্মহত্যা করতে হলো। এখানে ভাবার বিষয় হলো আমাদের পারিবারিক জটিলতা এবং সম্পর্কের টানাপড়েন ইদানীং সময়ে প্রচণ্ড মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে। আত্মহত্যা কোনো সমাধান না হলেও সারা বিশ্বেই কম-বেশি আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে। মানুষ কেন আত্মহত্যা করে তার একেবারে নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। তবে ‘অভাব’ শব্দটির সাথে আর যোগ রয়েছে। সেই অভাব কেবল বস্তুগত চাহিদার নয় বরং মনেরও বটে।
 
সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম ১৮৯৭ সালে প্রকাশিত তার ‘সুইসাইড’ নামক গ্রন্থে আত্মহত্যার জৈবিক ও মনস্তাত্তি¡ক কারণগুলো যৌক্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রত্যাখ্যান করে সামাজিক কারণগুলোকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তার মতে আত্মহত্যা একটি সামাজিক ঘটনা। তিনি মূলত সামাজিক সংহতি এবং সামাজিক নিয়ন্ত্রণের সাথে আত্মহত্যাকে সম্পর্কিত করে দেখার চেষ্টা করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে ডুর্খেইম বলেন, যারা সমাজের সাথে অতিমাত্রায় সম্পৃক্ত তারা আত্মহত্যা করে। আবার যারা সমাজ থেকে অতিমাত্রায় বিচ্ছিন্ন তারাও আত্মহত্যা করে। বাংলাদেশে আত্মহত্যা করার পেছনে সামাজিক, অর্থনৈতিক বিভিন্ন কারণ রয়েছে।

পরিবারের সাথে দ্বন্দ্ব এবং দূরত্ব তৈরি হওয়া, প্রেমে ব্যর্থতা, পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল না করা, কাঙ্ক্ষিত জিনিস না পাওয়া, বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে, ঋণ থেকে মুক্তি পেতে, মানসিক সমস্যাজনিত কারণে, মাদকদ্রব্যে আসক্ত হলে ইত্যাদি আরও অনেক ছোট-বড় বহু কারণ রয়েছে। সামান্য মানসিক উদ্বিগ্নতা তৈরি হলেই মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। যে সমস্যার সমাধান করা অত্যন্ত সহজ সে সমস্যার জন্যও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। তবে যে কারণেই আত্মহত্যা করুক না কেন তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। 

আবার শুধুমাত্র আত্মহত্যার চেষ্টা করে তা থেকে বেঁচে যাওয়ার সংখ্যাও অনেক বেশি। আত্মহত্যার প্রবণতা ক্রমেই একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একজন ছেলে বা মেয়ে তুচ্ছ কারণে আত্মহত্যা করছে। আমাদের এই প্রজন্মের এসব মেধাবী ছেলেমেয়েরা যদি আত্মহত্যার মতো অপ্রত্যাশিত অপরিণামদর্শী চিন্তা-ভাবনার পথ বেছে নেয় তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে আমরা কোথায় দাঁড়াব। একেকজন একেক কারণে জীবনের এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। আজকাল মানসিক চাপকে অনেকেই দোষারোপ করছেন। বর্তমান প্রগতির যুগে অবশ্যই তরুণ প্রজন্মের উপর মানসিক চাপ বাড়ছে কিন্তু আত্মহত্যা মানসিক চাপ কমানোর যে কোনো সমাধান নয় বরং মানসিক চাপ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ সে কথা বুঝতে হবে। নিজেকে শেষ করে কোনো সমস্যার সমাধান আশা করাটা বোকামি বরং সমস্যার মাঝে থেকে সমস্যার বাধাকে অতিক্রম করতে হয়। এটাই নিয়ম। নিয়মের বাইরে গিয়ে নিজেকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে নিলে কোনো সমাধান হয় না। 

আত্মহত্যা প্রতিরোধে সমাধান কোথায়? কীভাবে এই সংখ্যা কমিয়ে আনা যায়? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আত্মহত্যার পেছনের কারণগুলো অনুসন্ধান করতে হবে। তারপর সেসব সমস্যার সমাধান করতে হবে। জীবনে হতাশ হওয়ার যেমন কারণ রয়েছে তেমনি জীবনকে ভালোবাসার মতো কারণও রয়েছে প্রচুর। বর্তমান সমাজে হতাশা নামক ব্যাধি খুব সহজেই মানুষের মনে বাসা বাঁধছে। এই হতাশা কাটাতেই অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। পারিবারিক বন্ধন হালকা হওয়ার সাথে সাথে এসব হতাশ মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।

সামাজিক অস্থিতিশীলতা, চাকরির বাজারের অস্থিরতা, সম্পর্কের টানাপড়েন, বিশ্বাস ও মূল্যবোধের অভাব, ব্যক্তিগত শ্রদ্ধাবোধের অনুপস্থিতি, মাদকদ্রব্যের বিস্তার বৃদ্ধি পাওয়া, সন্তানের বেড়ে ওঠায় একাকিত্ব এসব কিছুই তার ব্যক্তিজীবনের ওপর শ্রদ্ধাবোধ আলগা করতে ভূমিকা রাখে। জীবনকে ভালোবাসার চেয়ে ভালো আর কোনো কিছুই হতে পারে না। প্রথমে নিজের জীবনকে ভালোবাসতে হবে। মানসিক শক্তি বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে অনেকেই আজকাল মেডিটেশনের সাহায্য নিচ্ছে। মেডিটেশন হতে পারে মানসিক চাপ কমানোর কার্যকর উপায়। জীবন একটি ঘটনায় থেমে থাকে না। প্রত্যেকেরই কিছু করার সুযোগ থাকে। এভাবে মনকে দায়িত্বশীল করে তুলতে হবে। 

একজন ছেলেমেয়ে যখন কলেজ শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখে তখন তার পরিবার তাকে ঘিরে যে স্বপ্ন দেখে তা একটি সাজানো গোছানো ভবিষ্যতের। দেশও তাকে নিয়েই স্বপ্ন দেখে। লেখাপড়া শেষ করে দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবে এটাই তার কাছে দেশের প্রত্যাশা। এখান থেকে একজন চলে যাওয়া মানে দেশের একটি নক্ষত্রের ঝরে যাওয়া। আমরা এভাবে কারও বিদায় চাই না। শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে সমাজের নেতিবাচক দিক। 

সমাজের কোথাও না কোথাও একটি দুর্বলতা তৈরি হচ্ছে বা হয়েছে। যার প্রভাব পড়ছে এসব মেধাবী শিক্ষার্থীর চিন্তা-চেতনায়। তাদের আত্মবিশ্বাস কমে গেছে। ধৈর্য নেই। কোনো দুর্ঘটনা সহ্য করার মতো মানসিক দৃঢ়তা নেই। এমন সমাজ তো আমরা চাই না বা কোনোদিন চাইনি। আমরা শিক্ষার্থীদের ধরে রাখতে চাই। তাদের মেধার প্রতিফলন ঘটাতে চাই। আমরা তাদের শেখাতে পারি যে ভালো মন্দ যাই ঘটুক না কেন, সেটা জীবনেরই অংশ এবং আত্মবিশ্বাস না হারিয়ে তাদের ধৈর্যশীল হতে হবে। একটি সুস্থ সমাজে আত্মহত্যা কোনো সমাধান আনতে পারে না। সেটা যে কারও ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আমরা চাই সুস্থ সমাজ, সুস্থ জীবন, সুস্থ নাগরিক এবং উন্নত দেশ।
 
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট