Image description

ঐতিহাসিক ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে গিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। দুই মাসের বেশি সময় ধরে সেখানে অবস্থান করছে। তবে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে একটি সংবাদ এসেছিল, লাল পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় তিনি আর ভারত থাকতে পারছেন না। শেখ হাসিনা দুবাইতে পাড়ি জমিয়েছে। সেখানে আশ্রয় পেয়েছে। একদিন পরে গণমাধ্যমগুলো প্রচার করতে থাকে হাসিনার ভারত ত্যাগ করার বিষয়টি সত্য নয়। তিনি কোথায় আছেন সেটাও সবার নিকট অস্পষ্ট। 

তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অনেকে দাবি করে হাসিনা সংযুক্ত আরব আমিরাত গিয়েছিল, তাকে বিমান ও বিমানবন্দরে চৌদ্দ ঘণ্টা বসিয়ে রেখে ফেরত দেয়া হয়েছে। বিশ্বের কোনো রাষ্ট্র ডিক্টেটর হাসিনাকে যেমন আশ্রয় দিচ্ছে না, গ্রহণ করার আশ্বাস দিয়েও রিফিউজ করা হয়েছে। হাসিনাপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় এক বিবৃতিতে তার মায়ের ভারতে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করে, কোথায় আছেন সেটা গোপন রাখেন। ধরে নেয়া যায়, আত্মগোপনে চলে গিয়েছেন বা ভারতের প্রশাসন তাকে সরিয়ে রেখেছে কোথাও। তাহলে এই নাটকের অন্তরালে ভিন্ন দৃশ্যপট নিয়ে নানান প্রশ্ন উঠে আসা স্বাভাবিক। ইদানীং হাসিনার কল রেকর্ড ফাঁসের যেন মহরত চলছে। 

সরকার পরিচালনার সময় যে হাসিনা যার তার কলরেকর্ড ফাঁস করত, আবার ক্ষমতা হারানোর পর তারই কল রেকর্ড ফাঁস হয়ে চলছে, যা সত্যি অভাবনীয় বিষয়। ‘যিনি বাংলাদেশের সীমানার কাছাকাছি রয়েছেন, চট করে ঢুকে পড়বেন। আবার গত সপ্তাহের কল রেকর্ডে হাসিনা বলেন, ড. ইউনূস সরকার একমাস টিকে কিনা সন্দেহ। লিস্ট করে রাখো। আরেকবার সুযোগ পেলে সবাইকে শাস্তি দেয়া হবে, এরকম।’ 

সর্বশেষ, ৯ অক্টোবর একটি নির্ঘুম রাত কাটে এক শ্রেণির মানুষের। বিষয়টা নিয়ে যদিও কোনো গণমাধ্যম মাথা ঘামায়নি। তবে অপপ্রচারে লিপ্ত ছিল আওয়ামী লীগের কিছু অ্যাক্টিভিস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। যদিও এর তরজমা করে দিয়েছে উপদেষ্টা আসিফ। ১০ অক্টোবর গণমাধ্যমে এসেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ‘পদ ছেমড়ছেন’ বলে যে গুজব মঙ্গলবার রাতে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়েছিল, তা নিয়ে ফেসবুকে উপহাস করেছেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তিনি তার ফেসবুক পেজে লেখেন, ‘শুধু চেয়ারই না, প্রধান উপদেষ্টাসহ দেশ ছাড়লেন বাকি উপদেষ্টারাও। সোর্স: চালাইদেন।’ 

ব্যাখ্যা হলো, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে ‘চালাইদেন’ শব্দটি ফেসবুকে জনপ্রিয়তা পায়। আন্দোলন চলার সময় হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সমর্থক সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্টরা গুজব বা অসমর্থিত সূত্রের নানান তথ্য তাদের নিজস্ব গ্রুপে শেয়ার করতেন। এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হলে, তখন উত্তরে বলা হতো আপাতত ‘চালাইদেন’। পরবর্তীতে এটা একধরনের ভাইরাল হয়ে যায় এবং আন্দোলনের সমর্থকরা বিরোধী পক্ষের গুজব চিহ্নিত করতে ব্যঙ্গ করে হ্যাস ট্যাগ বা শব্দবন্ধ ব্যবহার শুরু করে। এর কারণ হলো, গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে হঠাৎ করেই প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সেনাপ্রধানের দ্বন্দ্বের রেষে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় সেনা সদস্যদের অনুপ্রবেশ, ব্যারিকেড দিয়ে রাখা এবং মুহাম্মদ ইউনূসের সময় ফুরিয়ে এসেছে, এরকম কথা ছড়ানো হয়। 

বিষয়টি সোশ্যাল মিডিয়ায় এক ধরনের উত্তেজনার উদ্ভব হয়। এটা কেবল নতুন গুজব নয়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর গত দুই মাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নিয়ে নানা ধরনের গুজব ছড়ানো হয়। সবচেয়ে বেশি গুজব ছড়ানো হয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে। ইউনূস সরকার আসলেই কী ঠুনকো বা ভঙ্গুর সরকার? এই প্রশ্নের জবাব পেতে হলে বেশ গভীরে চলে যেতে হবে। প্রথমত, ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে জানতে হবে। দ্বিতীয়ত, সেনাপ্রধান ক্ষমতা কুক্ষিগত করবেন কিনা, এ সম্পর্কে এবং তৃতীয়ত, হাসিনা ক্ষমতা দখল করতে পারবে কিনা এ নিয়ে গবেষণা করতে হবে। প্রথমে বলা যায়, ডক্টর মুহাম্মাদ ইউনূস অর্ডিনারি কোনো ব্যক্তি নয়। আমরা জানি, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের একচ্ছত্র পরাক্রমাশীল রাষ্ট্র। পশ্চিমা দেশসমূহ এর দোসর, সঙ্গী, মিত্র। 

একমাত্র ব্যতিক্রম রাশিয়া। যার সাথে রয়েছে দীর্ঘদিনের শত্রুতা। সে এক লম্বা ইতিহাস। তথাপিও সংক্ষেপে বলতে গেলে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ রাষ্ট্র রাশিয়ার (সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন) দিকে কু-নজর পড়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের। যুক্তরাষ্ট্রের কুদৃষ্টি থেকে কেউ রক্ষা পেয়েছে এমন তথ্য-উপাত্ত কারো হাতে নেই। হতে পারে সেটা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অন্তর্গত অঙ্কিত কোনো ছক, যে রাষ্ট্রের উপর ক্ষোভ ধীরে ধীরে এই ফর্মুলা প্রয়োগ করে তাকে নিঃশেষ করে দেয়া যার কাজ। এমনিভাবে রাশিয়াকে টুকরো টুকরো করার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়েছিল ৬৯ বছর পরে। যুক্তরাষ্ট্রের কড়া দৃষ্টি থেকে রেহাই পায়নি মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রসমূহও। চীন অর্থনৈতিক পরাক্রমাশীল হতে নাছোরবান্দা। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মনস্তাত্তি¡ক একটা যুদ্ধ চলে, সেটা ওখানেই সীমাবদ্ধ। 

এই পরাক্রমাশীল যুক্তরাষ্ট্রের মহা সম্মাননার খাতির-যত্নে রয়েছেন ড. মুহাম্মাদ ইউনূস। পশ্চিমা বিশ্ব আর যুক্তরাষ্ট্র একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। ডক্টর ইউনূসকে এককথায় তারা ঘরের মানুষ মনে করে। যেমন, বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন ড. মুহাম্মাদ ইউনূসকে বিশ্বের শীর্ষ ১২ জন ব্যবসায়িক নেতার মধ্যে স্থান দেয়। এখানে শেষ নয়, এশিয়ার ৬০ বছর বয়সী নায়কদের মধ্যেও তাকে অন্তর্ভুক্ত করে। যুক্তরাজ্যের প্রসপেক্ট ম্যাগাজিন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন পলিসি পরিচালিত একটি উন্মুক্ত অনলাইন জরিপে শীর্ষ ১০০ জন পাবলিক ইন্টেলেকচুয়ালের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান দেয়া হয় তাকে। এরপর বিশ্বের সর্বোচ্চ সম্মাননা  স্লোভাকিয়ার ইনফরমাল ইকোনমিক ফোরাম ইকোনমিক ক্লাবের দেয়া সর্বোচ্চ পুরস্কার গোল্ডেন বিয়াটেক অ্যাওয়ার্ড দেয়া হয়। 
সাস্কিয়া ব্রুইস্টেন, সোফি আইজেনম্যান এবং হ্যান্স রাইটজের সাথে একত্রে সামাজিক ব্যবসা- গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভস প্রতিষ্ঠা করেন। ড. ইউনূসের নতুন, মানবিক পুঁজিবাদের দৃষ্টিভঙ্গির আন্তর্জাতিক বাস্তবায়ন শাখা হিসেবে এই সামাজিক ব্যবসা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সামাজিক ব্যবসার জন্য ইনকিউবেটর তহবিল পরিচালনা করে এবং কোম্পানি, সরকার, ফাউন্ডেশন এবং এনজিওদের পরামর্শ সেবা দেয়। গ্রেট সম্মাননা হলো, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর থেকে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম এব কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল পান। ডক্টর ইউনূস হলেন মাত্র সাতজন ব্যক্তির একজন, যিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম এবং যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল পেয়েছেন। 

তিনি ২০১২ সালের স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো ক্যালেডোনিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হন এবং ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। ড. ইউনূস ১৯৯৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের কার্যক্রমকে সমর্থনকারী জনহিতকর সংস্থা ইউনাইটেড নেশনস ফাউন্ডেশনের পরিচালনা পর্ষদে দায়িত্ব পালন করেন। ক্রীড়া উন্নয়নে তার বিস্তৃত কাজের জন্য অলিম্পিক লরেল পুরস্কার পান। এরপর জাতিসংঘের ইউনাইটেড নেশনস ফাউন্ডেশনের চ্যাম্পিয়ন অব  গ্লোবাল চেঞ্জ পুরস্কার প্রাপ্ত হন। মানব মর্যাদা, সমতা এবং ন্যায়বিচার বৃদ্ধির জন্য তার আলোকিত নেতৃত্ব এবং উদ্ভাবনের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে এই পুরস্কার দেয়া হয়। 

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২০২৩ সালে জাতিসংঘের ‘অ্যাডভাইজরি বোর্ড অব এমিনেন্ট পারসনস অন জিরো ওয়েস্ট’-এর সদস্য হিসেবে নিয়োগ পান। ‘জিরো ওয়েস্ট’ বা শূন্য অপচয় বিষয়ক জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ২০২২-এর রেজল্যুশন অনুযায়ী ড. ইউনূসকে এই মনোনয়ন দিয়েছেন সংস্থাটির মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। নিয়োগ প্রসঙ্গে ডক্টর ইউনূসকে লেখা চিঠিতে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, আমি বিশ্বাস করি যে, আপনার জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা জাতিসংঘের শূন্য-অপচয় বিষয়ক কর্মকাণ্ডকে ত্বরান্বিত করতে বিশেষ ভ‚মিকা রাখবে। টেকসই উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে শূন্য-অবচয় বিষয়ক কর্মকাণ্ড এগিয়ে নিয়ে যেতে এই অ্যাডভাইজারি বোর্ড গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করবে বলে আমি আশা করি।’ 

এ উপলক্ষে ড. ইউনূসকে লেখা চিঠিতে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি যে, আপনার জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা জাতিসংঘের শূন্য-অপচয় বিষয়ক কর্মকাণ্ডকে ত্বরান্বিত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘টেকসই উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে শূন্য-অপচয় বিষয়ক কর্মকাণ্ড এগিয়ে নিয়ে যেতে এই অ্যাডভাইজরি বোর্ড একটি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করবে বলে আমি আশা করি।’ এখানে শেষ নয়, জাতিসংঘের অ্যাডভাইজারি বোর্ডে ১৩ জন সদস্য রয়েছেন এবং তিনি এই বোর্ডের সভাপতি হিসেবে নিযুক্ত। মধ্যপ্রাচ্যের সম্মানের লিস্টেও বেশ এগিয়ে আছেন তিনি। এই সপ্তাহে,বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ৫০০ মুসলিম ব্যক্তিত্বের তালিকা প্রকাশ করা হয়। যেখানে ড. মুহাম্মদ ইউনূস শীর্ষ ৫০ ব্যক্তিত্বের মধ্যে রয়েছেন। জর্ডানের রাজধানী আম্মানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘দ্য রয়াল ইসলামিক স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ সেন্টার (আরআইএসএসসি) ১৬তম বারের মতো এ তালিকাটি প্রকাশ করেন। 

বিশ্বের ধনী, দরিদ্র, মধ্যমভিত্তিক বহু দেশ শান্তিতে নোবেলজয়ী ইউনুসের ফর্মুলা অনুসরণ করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে সফলতা পেয়েছেন। দারিদ্র দূরীকরণে ৪০টিরও বেশি দেশ তাঁর সামাজিক ব্যবসার মডেল অনুসরণ করছে। ড. ইউনূসের চিন্তা, কাজ, ভবিষ্যৎ লক্ষ্য ও তার জীবনাদর্শ নিয়ে বিশ্বের ৮০টিরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে গবেষণা হয়। বিশ্ব মোড়লদের সমাদৃত এই ব্যক্তি আমাদের বাংলাদেশের সন্তান হলেও আমাদের দেশ তাকে গত দেড় দশকে করেছে শতাধিক মামলার আসামি, করেছে অপমানিত, লাঞ্ছিত। তাকে দাঁড়াতে হয়েছে আদালতের কাঠগোড়ায়, ঢুকতে হয়েছে লোহার গারদে। কিন্তু রাখে আল্লাহ মারে কে।

অবশেষে, ৫ আগস্ট বিদায় ঘণ্টা বাজলো হাসিনা সরকারের। এই বাংলাদেশের ছাত্র, জনতা, সর্বস্তরের মানুষ বিদেশ থেকে এনে ডক্টর ইউনূসের হাতে ন্যস্ত করলো দেশের ভার। তিনি হলেন প্রধান উপদেষ্টা। এইবার সেনাপ্রধান সম্পর্কে জানা যাক। সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৮তম সেনাপ্রধান হিসেবে ২০২৪ সালের ২৩ জুন দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অর্থাৎ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরুর মাত্র এক মাস পূর্বে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তিনি শেখ হাসিনার শাসনামলের সেনাপ্রধান। এরকম পদে স্বাভাবিকভাবে শেখ হাসিনার আস্থাভাজন ব্যক্তি ছাড়া আসীন হতে পারেন না। 

‘৬ আগস্ট, হিন্দুস্তান টাইমসের খবরের শিরোনাম ছিল, হাসিনার আত্মীয়, আপাতত তার হাতেই ক্ষমতা, কে এই সেনাপ্রধান ওয়াকার? চলতি বছরের জুন মাসে তিন বছরের জন্য বাংলাদেশের সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তিনি আবার শেখ হাসিনার আত্মীয়। তার বাবাও এর আগে সেনাপ্রধান ছিলেন। সেই ওয়াকারই শেষ পর্যন্ত হাসিনার সরকারের পতনের অনুঘটক হিসেবে কাজ করলেন।’ ‘শেখ হাসিনা পালিয়ে যাবার পর জাতির উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিয়েছিলেন সেনাপ্রধান। তিনি বলেছিলেন, দেশে একটি রাজনৈতিক ক্রান্তিকাল চলছে।

একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হবে। সব হত্যার বিচার করা হবে। আমার উপর আস্থা রাখেন। আমরা রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। মারামারি সংঘাত করে আর কিছু পাব না। সংঘাত থেকে বিরত হোন। সবাই মিলে সুন্দর দেশ গড়ার চেষ্টা করি। এ সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।’ সেনাপ্রধান তার কথা রেখেছিলেন, তিনি সকলের কথামতো একটি অন্তর্বর্তীকালীন উপদেষ্টা পরিষদ গঠনে যাবতীয় সহায়তা করলেন। প্রকৃতপক্ষে সেনাপ্রধান ইচ্ছে করলে ক্ষমতা নিজের হাতে রেখে দিতে পারতেন, এ ক্ষেত্রে শতকরা আশিভাগ মানুষেরই সমর্থন ছিল যে সেনাবহিনীর হাতে ক্ষমতা থাকুক এবং তারা দেশ গঠনে নেতৃত্ব দিবে। কিন্তু সেনাপ্রধান এক সেকেন্ডের জন্য ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইলেন না। তিনি মনে করেছিলেন দেশের ভারে হয়তো ন্যুব্জ হয়ে যাবেন।
 
উপদেষ্টা পরিষদ গঠন এবং তাদেরকে ক্ষমতা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি মরিয়া হয়ে ওঠলেন। এখন প্রশ্ন হলো, যে সেনাপ্রধান তখনকার সময় ক্ষমতা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য কালানিপাত করেননি, সে কীভাবে এবং কেন পুনরায় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে হাসিনাকে বসাবেন? এরকম ভাবনা নিতান্ত বোকামি। এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে পাওয়া দুই কোটি দশ লাখ একাত্তর হাজার ছয়শত একাত্তর টাকা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টে প্রাপ্ত এই টাকা আত্মসাতের দায়ে তাকে পাঁচ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল। যে মামলাটি ছিল সম্পূর্ণ সাজানো এবং মিথ্যা। 

আবার একাত্তর সালের যুদ্ধ অপরাধী মামলায় জামায়াতে ইসলামের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মাদ কামরুজ্জামাম, জামায়াতের সেক্রেটার জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, জামায়াতে ইসলামের মীর কাশেম আলীদের ফাঁসি এবং মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাইদীর আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হলো। অথচ, প্রায় পনেরশ ছাত্র-জনতা হত্যাকারী, এখন পর্যন্ত দুইশ ছাব্বিশটি হত্যা মামলার আসামী শেখ হাসিনার কতবার ফাঁসি বা কতবছর কারাদণ্ড হতে পারে, এই প্রশ্নের জবাব উস্তাদও অতি সহজভাবে দিতে পারবে। মানুষের প্রত্যাশার অন্ত নাই। আওয়ামী লীগের অলস মস্তিষ্কের বিফল ভাবনা হয়তো রাশিয়া এবং ভারত হাসিনাকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়ে যাবে।

রাশিয়া সম্পর্ক শুরুতেই বর্ণিত হয়েছে, তাদের এমন কোনো শক্তি বা হাতিয়ার নেই যা ব্যবহার করে হাসিনাকে সিংহাসন উপহার দিবেন। সারা বিশ্বে গত কয়েক হাজার বছরের রেকর্ডে রাশিয়া এরকম দুঃসাহসিক কর্ম ঘটিয়েছে এমন কোনো প্রমাণ নেই। তাহলে নিশ্চিত ভারত হাসিনাকে বসাবেন? ভারতের নিজেরই পায়ের তলায় মাটি নেই। গোড়ালি পর্যন্ত পানিতে তলানো। ভারতের সাথে দক্ষিণ এশিয়ায় যে কয়টি রাষ্ট্র রয়েছে কারো সাথেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নেই। সবার সাথে সম্পর্ক তলানিতে। মোদি সরকারের পররাষ্ট্র নীতি এতোটা দুর্বল যে, প্রত্যেকটা রাষ্ট্রই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ভারত থেকে। 

সাম্প্রতিক নমুনা হচ্ছে, মালদ্বীপের মতো দেশ থেকেও ভারতের দূর দূর বিতাড়িত হওয়া। চীনের কাছে সীমান্তে মার খাচ্ছে,পাকিস্তানের সীমান্তে মার খাচ্ছে। সেভেন সিস্টার্সে চরম উত্তেজনা। যা হুমকির মুখে। তাসের ঘরের মতো সামান্য বাতাসে পরে যেতে পারে। সেই ভয়ে প্রহর গুনতে হচ্ছে ভারতকে। মায়ানমার সীমান্তেও উত্তেজনা। সবদিক মিলিয়ে ভারতের মন ভালো নেই। তার উপর হাসিনাকে সে দেশে থাকার সুযোগ দিয়ে মারাত্মক চাপ সামলাতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পশ্চিমা বিশ্বের। কী আর করার ফেলেতো দেয়া যায় না। এ থেকে অনুধাবনই করা যায় ডক্টর ইউনূকে দায়িত্ব থেকে সরানোর ক্ষমতা ভারত রাখে না। সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান ক্ষমতা পূর্বেই নিজের হাতে রাখতে পারতেন। কোনো বাধাতো ছিল না। 

অতএব, দেড় হাজার ছাত্র-জনতা খুন করা এখন পর্যন্ত দুইশ ছাব্বিশটি মামলার আসামিকে কেউই অবৈধভাবে ক্ষমতায় বসানোর সামর্থ্য রাখে না। সতেরো বছর অবৈধ ক্ষমতা ধরে রাখার পুরস্কার ছিল গণ রোষানলে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া। তাহলে আবারও অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করা বা করিয়ে দেয়ার পরিণাম কতোটা ভয়ংকর হতে পারে? মাত্র কয়েকদিন আগে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ডক্টর ইউনূসের যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘে সফরে বাইডেনের সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক, জাতিসংঘে প্রাপ্ত অসামান্য সম্মাননায় পরিচয় করিয়ে দেয়, তিনি নির্দ্বিধায়-নিঃসংকোচে বিশ্বের অন্যতম সর্ব সমাদৃত শক্তিধর একজন ব্যক্তি। তিনি প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নির্বাচন পর্যন্ত বহাল তবিয়তেই থাকবেন। 

দেশবাসীর উদ্দেশ্যে তিনি ভাষণে বলেছিলেন, ‘জুলাই-আগস্ট মাসে গণঅভ্যুত্থানে বলপ্রয়োগ ও হতাহতের যে দুঃসহ ঘটনা ঘটানো হয়েছে তার স্বচ্ছ তদন্ত নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন প্রধানকে বাংলাদেশে এসে তদন্ত শুরু করতে আহ্বান করা হয়েছে। তাদের প্রথম দল অলরেডি এসেও গেছে।’ অতএব, কে কি করল সেটা দেখার এবং অবাস্তব কিছু ঘটার দুরভিসন্ধি চিন্তা-চেতনা না করে বরঞ্চ ডক্টর ইউনূস কি করল বা কী ঘটালো সেটা দেখার জন্য আমরা শুধু অপেক্ষা করি।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট