Skip to main content

ছেলেমেয়েদের হাতে বই তুলে দেন

নুরুল ইসলাম বাবুল
Image description

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বই পাঠের মাধ্যমে শিশুমনের সুস্থ ও সুন্দর বিকাশ ঘটে। জ্ঞানার্জনের অন্যতম উপকরণ হলো বই। শুধু তাই নয়, বই পাঠের মাধ্যমে চিত্ত বিনোদনও লাভ করা যায়। একটি সুন্দর, মানবিক ও সভ্য জাতি গঠনের ক্ষেত্রে বই পাঠের ভূমিকা অপরিসীম। এক্ষেত্রে নিজেরা যেমন বই পাঠ করতে হবে, তেমনি ছেলেমেয়েদের হাতে তুলে দিতে হবে বই। এবার নিজের সন্তানদের কথা দিয়ে আজকের প্রসঙ্গের ভেতরে প্রবেশ করি। বড় মেয়ে তখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। রিডিং স্কিল অসাধারণ। বাংলা ও ইংরেজি দুটোতেই সাবলীলভাবে পড়তে পারে। নিয়মিত স্কুলে যায়। বাড়ি ফিরে পাঠ্যবই নিয়ে বসে। যথাসময়ে হোমওয়ার্ক তৈরির চেষ্টা করে। আমি ওর পাশে বসে থাকি। প্রয়োজনে সহযোগিতা করি। আমি লক্ষ করি, ও পাঠ্যবইয়ের কবিতাগুলো বার বার পড়ে। আবৃত্তি করে আমাকে শোনায়। কবি পরিচিতি পড়ে। গল্পগুলোও পড়ে। আমাকে ভালোলাগার কথা জানায়। আমি মেয়ের আগ্রহ দেখে আমার বুকশেলফ থেকে কিছু শিশু-কিশোর উপযোগী বই ওর পাশে রাখি। নিজেও ওগুলো থেকে পড়ি। মেয়ে একটা-দুটো বই নাড়াচাড়া করে। দু-একটা পড়ে। এভাবে একসময় সে পুরোদমে পাঠক হয়ে ওঠে। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য, জীবনী, সাধারণ জ্ঞান, ম্যাগাজিন, দৈনিক পত্রিকাসহ নানারকম বই তার পাঠের তালিকায় চলে আসে। এখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আজও অবধি তার পাঠাভ্যাসে ভাটা পড়ে নাই। বড় মেয়েকে দেখে ছোট দুই জমজ মেয়ে আরও একধাপ এগিয়ে যায়। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তারা পাঠ্যবই বলতে গেলে বাদ দিয়ে আমার বুকশেলফ উজার করে ছড়া, কবিতা, গল্প, কিশোর উপন্যাস পড়তে থাকে। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিশু-কিশোর পত্রিকা, দৈনিক সংবাদপত্র তাদের লাগবেই। ঘটনাচক্রে সেসময় পৃথিবীজুড়ে করোনাকাল চলছিল। স্কুল বন্ধ। প্রাইভেট পড়া নাই। এক অফুরন্ত সময় হাতে। মেয়েরা একটার পর আরেকটা বই পড়ে শেষ করতে লাগল। আমি ওদের এই কর্মকাণ্ডে নিরুৎসাহী করি নাই। বরং যথাসাধ্য বইপত্র যোগান দেয়ার চেষ্টা করেছি। ওদের মা পাঠ্যবই রেখে মেয়েদের এরকম পাঠাভ্যাস দেখে অসন্তোষ প্রকাশ করে। আমি মেয়েদের উৎসাহ দিতেই থাকি। করোনাকালে ওরা ক্লাসিক বইসহ সমকালীন বাংলা সাহিত্যের কয়েকশ বই পাঠ সমাপ্ত করেছিল। সেই পাঠাভ্যাস তারা ধরে রেখেছে। এমনকি রীতিমতো ক্লাসের পাঠেও মনোযোগী রয়েছে।

বর্তমান সময়ে আমরা লক্ষ করছি যে, শুধু সাধারণ জনগোষ্ঠী নয়, শিক্ষিত সমাজ থেকেও পাঠাভ্যাস বিলুপ্তির পথে। সন্তানদের কথা বাদই দিলাম, অভিভাবকদের মধ্যেও পাঠের অভ্যেস নেই বললেই চলে। বই, ম্যাগাজিন এমনকি দৈনিক পত্রিকা থেকেও মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, মোবাইল গেইমে আসক্ত হয়ে জ্ঞানচর্চার এই পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ছে তারা। অনলাইনে পাঠের সুবিধা, নানা তথ্য-উপাত্ত প্রাপ্তির সহজ উপায় পেয়ে অনেকেই প্রিন্ট বই থেকে দূরে সরে গেছেন। তাতে খুব বেশি লাভ হয়েছে বলে মনে হয় না। তবে এতে আর যাই হোক পাঠের প্রকৃত আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি আমরা। তাছাড়া অনলাইনে ঢুকলে চারপাশ থেকে নানারকম রঙিন জগত ভেসে আসে। নানারকম বিনোদনের আহ্বান উঁকি দেয়। একের পর এক প্রলোভন দেখিয়ে কেড়ে নেয় মূল্যবান সময়। এতে প্রকৃত পাঠের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ে। সুতরাং আমাদের ফিরে আসতে হবে মূল জায়গায়। নিজেদের পাঠাভ্যাস গড়ে তুলে তৈরি করতে হবে সন্তানদের। এখানে যে কথা বলতে চাই তা হলো, সন্তানদের পাঠাভ্যাস তৈরিতে অভিভাবকের করণীয় সম্পর্কে। মূলত পরিবার থেকেই শিশুরা প্রথম শিক্ষা লাভ করে। জšে§র পর একটি শিশু প্রথমে যা যা শেখে তার সবই পরিবার, পরিজন, নিকট আত্মীয়দের কাছ থেকেই শেখে। তারপর ধীরে ধীরে সে প্রতিবেশী, সমাজ, এক সময় বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে শিক্ষা লাভ করতে থাকে। কিন্তু পারিবারিকভাবে শিশু যে শিক্ষা লাভ করে, তা তার মনোজগতে তুমুলভাবে প্রভাব বিস্তার করে।

বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ পাঠদানকালে শিশুর মনোজগতের সেই অবস্থা টের পান। তারা সহজেই বুঝতে পারেন শিশুটি কেমন পরিবারে বেড়ে উঠেছে। সুতরাং সন্তানের ইতিবাচক মনোজগত বিকাশে পিতা-মাতার বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের পাঠাভ্যাস তৈরিতে কিছু করণীয় সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে অভিভাবক তথা বাবা-মাকে। ছোট সময় থেকেই সন্তানের খেলাধূলার উপকরণের সাথে দৃষ্টিনন্দন ছবিযুক্ত বই কিনে দিলে ওরা পড়তে না-পাড়ুক বইয়ের সাথে পরিচিত হতে পারবে। মজার মজার ছড়া শুনাতে হবে। এ সময় বই সামনে রেখে দিলে ওরা বুঝতে পারবে বইতে এমন সুন্দর ছড়া থাকে। ফলে বইয়ের প্রতি সন্তানের আকর্ষণ তৈরি হবে। বিদ্যালয়ে ভর্তির পর শুধু শিক্ষকদের দিকে তাকিয়ে না-থেকে পরিবার থেকে বর্ণ পরিচয়, শব্দ তৈরি বাক্য গঠনসহ রিডিং স্কিল অর্জন করানোর চেষ্টা করতে হবে। সেই সাথে লিখনচর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। রিডিং ক্ষমতা তৈরি হলেই পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরণের বই যেমনÑ গল্প, ছড়া, কবিতা, সাধারণ জ্ঞান, ছোটোদের পত্রিকা ও সাময়িকী, দৈনিক পত্রিকার শিশুতোষ পাতা ইত্যাদি সন্তানের পড়ার টেবিলে রেখে দিলে অথবা ওদের সামনে নিজে পাঠ করলে শিশুমনে কৌতূহল সৃষ্টি হবে। একসময় তারা এগুলো পাঠের জন্য আগ্রহী হয়ে উঠবে। তারপর সন্তানের মধ্যে দারুণ একটা পাঠাভ্যাস গড়ে উঠবে। যা সন্তানের সুন্দর মানুষিকতা? তৈরিতে ভূমিকা রাখে। এক্ষেত্রে পারিবারিক লাইব্রেরি তৈরি করতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, বইমেলা, লেখালেখির চর্চাসহ নানারকম শিল্পকর্মের সাথে সম্পৃক্ততাও সন্তানের সুন্দর মানুষিকতা? তৈরি করতে পারে। যদিও আমাদের দেশে অসচেতন অভিভাবক, আর্থিক দৈন্যতা, শুধু চাকরি প্রাপ্তির জন্য লেখাপড়া এমন মনোভাবসহ নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। তবুও সামর্থ্য অনুযায়ী চেষ্টা করতে হবে। তাছাড়া পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য বই পড়লে একাডেমিক পড়ালেখার ক্ষতি হয় এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে। বরং পাঠের পরিধি যত বেশি বাড়ানো যাবে সন্তানের বহুবিধ জ্ঞানের বিকাশ তত তরান্বিত হবে। আমার নিজের সন্তানদের বেলাতে এমনটাই ঘটেছে বলে লক্ষ করছি। পরিশেষে বলতে চাই- বই পাঠের মাধ্যমে যেমন জ্ঞানার্জনের সুযোগ রয়েছে, তেমনি রয়েছে তুমুল আনন্দ গ্রহণের উপায়। শুধু তাই নয়, ছেলেমেয়েদের সভ্য করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাদের হাতে বই তুলে দেয়ার বিকল্প পথ নাই। অতএব প্রত্যেকের উচিত সুন্দর, সুস্থ চেতনার জাতি গঠনের প্রয়োজনে প্রতিটি ঘরে ঘরে পাঠাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এভাবে আগামী প্রজন্মকে দেখাতে হবে আলোকিত সুন্দর পথের দিশা।

লেখক: শিশুসাহিত্যিক, কবি ও কলামিস্ট

মানবকণ্ঠ/এসআরএস


Comments