Skip to main content

‘নেতা মাত্রই শিক্ষার্থী’-এই বোধে উজ্জীবিত হোক তারুণ্য

রাহমান ওয়াহিদ
Image description

এখনকার বেশিরভাগ শিক্ষার্থী পড়াশোনা বলতে পাঠ্যবই পড়া ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। জানা বা বোঝার আগ্রহটিও নেই তাদের। এমন অনেক শিক্ষার্থীকেই পাওয়া যাবে যারা আসলে জানেন না যে তারা কেন পড়াশোনা করছেন। এক মনীষী বলেছেন, ‘যখন তুমি নতুন একটা বিষয় জানবে তখন তোমার মধ্যে সে সম্পর্কে পরিষ্কার একটা ধারণা জন্মাবে। আর কোনো কাজ ভালোভাবে করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেয়া। সেজন্যই পড়াশোনা বিষয়টি জরুরি।’ নিজেকে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে নেয়ার জন্যও পাঠ্যপুস্তকের সাথে বাইরের পড়াশোনাটাও মনোযোগ দিয়ে করা দরকার। যারা ছাত্রাবস্থায় থেকেই ভবিষ্যতে জনগণের কল্যাণ করতে ব্রতী হতে চান অর্থাৎ জাতিকে নেতৃত্ব দিতে চান, তাদের জন্যই বিশেষ করে আজকের এই কথাগুলো।

বাস্তবতা হলো- আমাদের দেশে ছাত্র রাজনীতির মূল চেতনায় ‘প্রচুর পড়াশোনা’র বিষয়টিই নেই। মূল রাজনৈতিক দলের অন্ধ আনুগত্য আর চাপাবাজি করে মাঠ গরম করাই নেতৃত্বের শীর্ষে পৌঁছার মূল চাবিকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এখনকার ছাত্র রাজনীতির শিক্ষার্থীদের দলীয় লেজুড়বৃত্তির ঊর্ধ্বে উঠে পড়াশোনার জায়গাটা ঠিক রেখে রাজনীতি, সমাজসেবা ইত্যাদি কার্যক্রমে নিজেদের সম্পৃক্ত করাটা খুব জরুরি। কোনোভাবেই লেখাপড়ার ক্ষেত্রে আপস করা যাবে না। দেশপ্রেম ও রাজনীতির শেকড়ই হলো প্রকৃত জ্ঞানার্জন। দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি রাজনীতিক প্রয়াত নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, ‘শিক্ষা হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র, যার মাধ্যমে পৃথিবীকে বদলে ফেলা যায়।’ তার মানে শুধু পাঠ্যপুস্তক নয়, পাঠ্যবইয়ের বাইরেও এমন কিছু অধ্যয়ন করা, যা পৃথিবীকে বদলে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। এখন তো রাজনীতিতে ধীরশক্তিসম্পন্ন সুশিক্ষিত ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্বের তেমন দেখাই মেলে না।

মেধাবীরা রাজনীতিতে আসছেন না- এমন হা-হুতাশের কথা শোনা যায় প্রায়ই। কিন্তু এ কেবল কথার কথাই। মেধাবীদের রাজনীতিতে সম্মানজনক জায়গা করে দেয়ার তেমন উদ্যোগ তো আমরা দেখি না। অথচ রাজনীতি হলো একটি জাতি, রাষ্ট্র বা সম্প্রদায়কে পরিচালনা করার প্রক্রিয়া। গণতন্ত্রে নাগরিকরা সেই প্রতিনিধিদেরই ভোট দেয়, যারা তাদের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেন। ‘তাদের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া’র এই যে রাজনীতি, তা পরিচালনা করতে দরকার দেশপ্রেমিক ও প্রজ্ঞাবান নেতৃত্ব। এ ধরনের নেতৃত্ব গড়ে ওঠে রাষ্ট্রের তৃণমূল থেকে, যারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অত্যন্ত কাছাকাছি থেকে তাদের অভাব অভিযোগ চাহিদা জানতে জানতে, বুঝতে বুঝতে তাদেরই সমর্থনে ধাপে ধাপে উঠে আসে রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ে। এমন নেতৃত্বই সর্বস্তরের জনগণের কল্যাণে নীতি গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে হƒদয়ের তাগিদ অনুভব করেন। যেমনটি অনুভব করেছিলেন আমাদের প্রয়াত মহান নেতৃবৃন্দ। তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতেই প্রয়োজন পুঁথিগত বিদ্যার পাশাপাশি বিশ্ব সংসারে উত্থান-পতনের ইতিহাস, জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয় বিষয়াদি, সর্বাবস্থায় জনগণকে সাথে রাখার জ্ঞান।

এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বলেছেন এভাবে- ‘সেই পড়ালেখাকেই আমরা বলি শ্রেষ্ঠ শিক্ষা, যা কেবল তথ্য পরিবেশন করে না, যা বিশ্ব সত্তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে।’ আজকে যেসব শিক্ষার্থী  রাজনীতির সাথে যুক্ত আছেন বা পরে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছে লালন করছেন, তাদেরকে এ কথাগুলো আত্মার সাথে গেঁথে নিতে হবে। নেতৃত্বের মান উন্নয়নে প্রয়োজন হলো-জানা। জানতে হলে পড়তে হবে। কথায় আছে, নেতা মাত্রই শিক্ষার্থী। ভালো নেতা হতে হলে পড়াশোনা করতে হয়। দল বা দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে নেতাকে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিতে হয়। প্রচুর পড়াশোনার সাথে দেশপ্রেম, ত্যাগী মনোভাব ও সততা ছাড়া এ দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়। নেতা সেই ব্যক্তি যিনি বিশেষ কোনো লক্ষ্য অর্জনের জন্য অন্যদেরকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখেন। তাই একজন নেতাকে শুধু ভালো বক্তা হলেই চলে না, বিদ্যমান পরিস্থিতির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ ক্ষমতা, ভূ-রাজনীতির কলাকৌশল সম্পর্কে সম্যক ধারণা আর জনমতকে তার মতের দিকে টানবার যুক্তিভিত্তিক সম্মোহনী ক্ষমতাও তার থাকতে হয়। মহান নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে. ফজলুল হক, মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবসহ সমসাময়িক নেতৃবৃন্দ এসব গুণ অর্জন করতে পেরেছিলেন বলেই তাদের ত্যাগ ও সফল নেতৃত্বের ফলশ্রুতিতে মুক্ত বাঙালি আজ বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। আজকের বাস্তবতায় জনগণের কাছে দায়বদ্ধ ও ত্যাগী নেতৃত্বের বড়ই অভাব। ছাত্র রাজনীতিও লোভ লালসা ও পদ-পদবির চোরাবালিতে ডুবতে বসেছে। আশার কথা যে-শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশে নতুন এক রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের রাজনীতি যে পথে চলেছে সেখান থেকে উত্তরণের সুযোগ তৈরি হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাজনীতি সচেতন একটি তরুণ প্রজন্মের উন্মেষও ঘটেছে। সুস্থ রাজনীতির ধারায় তাদের অংশগ্রহণ ঘটলে রাজনীতি নতুন এক পথ খুঁজে পেতে পারে। এই সুযোগকে কাজে লাগাতে না পারলে এ রাষ্ট্র আবারো পুরনো রাজনীতির পথে হাঁটা শুরু করবে, যা কারো কাম্য নয়। ভবিষতে যারা জাতিকে নেতৃত্ব দিতে চান, তাদের পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন জাতীয় সমস্যা নিয়ে নীতিভিত্তিক গবেষণা, বিশেষ করে কৃষি ও শিল্প খাতের সমস্যা সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ তৈরি করতে হবে।

এজন্য পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতা, অর্থনীতি/বাণিজ্য পাতা, ইকোনমিস্ট বা সমমানের ফিচার পড়তে হবে। শুধু তত্ত্বগত জ্ঞান অর্জনই যথেষ্ট নয়, তাদেরকে দেশের সমস্যা সমাধানে টেকনোক্রেটিক সমাধানের প্রায়োগিক দিকটিও জানতে হবে। আজকের বাস্তবতায় পেশাগত দক্ষতাহীন মানুষ ভালো নেতা হতে পারেন না, নীতি গ্রহণে ভূমিকাও রাখতে পারেন না। তাদের প্রতিটি সমস্যার সমাধান সূত্র জানতে হবে। রাজনীতির মাধ্যমে দেশের মানুষের দৈনন্দিন সমস্যার সমাধান করতে তাদের মানুষের খুব কাছাকাছি যেতে হবে, জানতে হবে তাদের চাহিদার কথা, কান পেতে শুনতে হবে তাদের নাড়ির স্পন্দন। এসব করতে যথেষ্ট শ্রম ও সময় দিলে আজকের ধীরশক্তিসম্পন্ন তরুণ শক্তির হাতেই চলমান রাজনীতির অন্তঃসারশূন্যতা দূর হতে পারে। প্রয়োজন আজ নৈতিকতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ একঝাঁক দক্ষ রাজনীতিকের। জুলাই বিপ্লবের চেতনায় দীপ্ত তারুণ্য কাক্সিক্ষত এই জনকল্যাাণমুখী রাজনীতির প্রতিষ্ঠায় অগ্রণীর ভূমিকা পালন করতে পারেন। ‘নেতা মাত্রই শিক্ষার্থী’-এই বোধে উজ্জীবিত হয়ে তারা বিশ্বের বড় বড় নেতার জীবনী পড়ে সেখান থেকে রাজনৈতিক চরিত্র গঠনের শিক্ষাটি নিতে পারেন। রাজনীতিতে আগ্রহী শিক্ষার্থীরা প্রচুর পড়াশোনাকে মূল কাজ হিসেবে নিয়ে জাতিকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য নিজেদেরকে যোগ্য করে গড়ে তুলুন- এটিই  কল্যাণপ্রত্যাশী জনগণের কাম্য আজ।

লেখক: কবি, কথাশিল্পী ও কলামিস্ট

মানবকণ্ঠ/এসআরএস


Comments