Image description

বাংলাদেশ ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বিতাড়িত প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে আসছে। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই শরণার্থীদের জন্য বাংলাদেশ বিশ্বে প্রশংসিত হলেও, দীর্ঘমেয়াদে এটি দেশের জন্য একটি বড় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাগত চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। কক্সবাজার ও ভাসানচরের রোহিঙ্গা শিবিরে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, পরিবেশগত ক্ষতি, মাদক ও অপরাধ বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিলতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। ২০২৫ সালে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশের পরবর্তী পদক্ষেপগুলোর মধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ ও পরিকল্পনা রয়েছে।

আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন: বাংলাদেশ ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করতে যাচ্ছে। এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য হলো রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করা এবং মানবিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা। সম্মেলনে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন।

দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ও মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি: বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা অব্যাহত রাখার পরিকল্পনা করেছে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরি করতে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হবে। এছাড়াও, রাখাইন রাজ্যের মানবিক পরিস্থিতি উন্নয়নে জাতিসংঘের নেতৃত্বে গৃহীত উদ্যোগগুলোকে সমর্থন করা হবে। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের চেষ্টা চালিয়ে গেছে, কিন্তু তাতে আশানুরূপ সাফল্য আসেনি। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকার তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে আগ্রহ দেখালেও বাস্তবে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তাই বাংলাদেশকে চীনের মতো প্রভাবশালী দেশগুলোর মাধ্যমে মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়াতে হবে।

আন্তর্জাতিক ফোরামে সক্রিয় ভূমিকা: বাংলাদেশ জাতিসংঘের সঙ্গে সহযোগিতা জোরদার করে রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে সম্প্রতি আলোচনায় বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ের আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘ, আসিয়ান, ওআইসি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের জন্য বাংলাদেশকে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা বাড়াতে হবে। বিশেষ করে, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন নিশ্চিত করতে হবে।

আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ: বাংলাদেশ ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক আদালতে  গাম্বিয়ার মাধ্যমে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলা পরিচালনা করছে। এটি রোহিঙ্গাদের ন্যায়বিচার পাওয়ার পাশাপাশি প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করতে পারে।

পর্যায়ক্রমিক প্রত্যাবাসন পরিকল্পনা: বাংলাদেশ, চীন ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি পরীক্ষামূলক প্রত্যাবাসন পরিকল্পনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে মিয়ানমারের নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ব্যাপক পরিসরে প্রত্যাবাসন সম্ভব নয়। তাই বাংলাদেশকে অবশ্যই রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করে ধাপে ধাপে প্রত্যাবাসনের চেষ্টা করতে হবে।

কক্সবাজার ও পার্বত্য এলাকার পরিবেশ রক্ষা: রোহিঙ্গা বসতির কারণে কক্সবাজার ও সংলগ্ন বনাঞ্চলে ব্যাপক পরিবেশগত ক্ষতি হয়েছে। বৃক্ষরোপণ, বন সংরক্ষণ এবং পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো গড়ে তুলতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

আন্তর্জাতিক অর্থায়ন ও সাহায্য বৃদ্ধি: রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সহায়তা বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে প্রচারণা চালাচ্ছে। ২০২৫ সালের জন্য বাংলাদেশ ১ বিলিয়ন ডলার সহায়তা চেয়েছে, যা রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা ও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করা হবে। বর্তমানে রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা ক্রমশ কমছে। তাই বাংলাদেশকে আরও জোরালো ক‚টনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশগুলোর কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য নিশ্চিত করতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট শুধুমাত্র বাংলাদেশের সমস্যা নয়; এটি আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্যও হুমকি। আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর (বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড) সহায়তা নেয়া যেতে পারে, কারণ এসব দেশেও রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিচ্ছে।

চীন ও ভারতের সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিতকরণ: বাংলাদেশকে চীন ও ভারতের সঙ্গে কৌশলগত আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে, কারণ এই দুই দেশ মিয়ানমারের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। বিশেষ করে, চীন যদি মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে রাজি করাতে পারে, তাহলে এটি বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হবে। 

বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এছাড়াও, রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে, তবে এটি দক্ষ কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব। মিয়ানমারের ওপর কূটনৈতিক চাপ বজায় রাখা, রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা এবং শরণার্থী শিবিরে অপরাধ ও পরিবেশগত সমস্যা মোকাবিলা করা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। 

বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে কার্যকর পথ হলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও সক্রিয় করা, চীন ও ভারতের সহায়তা নেয়া এবং নিজ দেশের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের দিকে এগিয়ে যাওয়া। ২০২৫ সালে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশের পরিকল্পনা ও পদক্ষেপগুলো বেশ ব্যাপক ও বহুমুখী। আন্তর্জাতিক সম্মেলন, দ্বিপক্ষীয় আলোচনা, মানবিক সহায়তা ও তৃতীয় দেশে স্থানান্তরের মতো উদ্যোগগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশ এই সংকটের স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। তবে এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহযোগিতা অপরিহার্য।

লেখক: শিক্ষার্থী