Image description

২০০০০ বছর পূর্বের প্রস্তর যুগের এবং প্রায় চার হাজার বছরের পুরনো তাম্রযুগের ধ্বংসাবশেষ বাংলায় পাওয়া গেছে। এতে কি প্রমাণ হয়, বাংলা জনপদের সভ্যতার বিকাশ বহু আগ থেকে শুরু হয়েছিল। বাংলা জনপদটি দীর্ঘদিন পাল রাজাদের শাসনাধীন ছিল। পাল বংশের স্থায়িত্বকাল ছিল প্রায় ৪০০ বছর। পাল বংশের উল্লেখ্য  যোগ্য রাজা ছিলেন নারায়ণপাল ৮৬০-৯১৫, মহীপাল ৯৭৮-১০৩০, রামপাল। তার শাসনকালে শিল্পকলায় বাংলা শিখরে উঠে। 

বাংলায় সৌরবিদ্যা, ভূগোল, আধুনিক কৃষি যন্ত্র উদ্ভাবন, শারীরিক বা স্বাস্থ্যবিষয়ক (কবিরাজি) এ ধরনের জ্ঞান অনুশীলন শুরু হয় প্রায় আড়াই হাজার বছর আগ থেকে। সৌর পঞ্জিকা হলো এমন পঞ্জিকা (বর্ষপঞ্জি) যেখানে দিনসমূহকে হিসাব করার জন্য সূর্যের ঘূর্ণন পদ্ধতির ফলে উদ্ভূত গণনাকে ব্যবহার করা হয়। হিসাবের সুবিধার্থে পৃথিবীতে সৌর পঞ্জিকার ব্যবহারই অধিক প্রচলিত; যেমন: ইংরেজি পঞ্জিকা, বাংলা পঞ্জিকা। বাংলা পঞ্জিকার ভারতীয় সৌর পঞ্জিকা থেকে। যা ভারতীয় সৌরবিদরা আবিষ্কার করেছিলেন প্রায় তিন হাজার আগে। এর প্রচলন বাংলা জনপদে অনেক আগেই ঘটেছিল। 

বাংলা জনপদে সৌরবিজ্ঞান চর্চাটা শুরু হয় ইউরোপের অনেক আগ থেকে। প্রাচীন বাংলা ছিল বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নথিভুক্ত রূপ, যেটি মধ্যযুগে পূর্ব ভারতের বঙ্গ অঞ্চলে কথ্য ছিল। এটি ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মগধী প্রাকৃত থেকে বিবর্তিত অপভ্রংশ থেকে বিকশিত হয়েছিল এবং প্রথম প্রাচীন বাংলা সাহিত্য রচনাগুলো ৮ম শতাব্দীর থেকে পাওয়া যায়। ১২০০ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ কোনো প্রকার বাংলা ভাষার লিখিত রূপ বা সাহিত্য পাওয়া যায় না। এই সময় আরবীয় ইসলামিক জনগোষ্ঠী বাংলার অনেক অংশ দখল করে নেয়। তারা বাংলা জানত না, বাংলা চর্চার পথটা তখন বন্ধ হয়। বাংলা ভাষায় যে সকল জ্ঞান-বিজ্ঞান বা সাহিত্য রচনা হতো তার পথও রহিত হয়ে যায়। এটিকে অনুর্বর যুগ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। 

ইসলামিক শাসনকর্তাদের সময় আবার বাংলার মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞান শুরু হলে তা আবার আঁতুড়ঘর থেকে শুরু হওয়া বলা যায়। কারণ সৌর বিজ্ঞানের বিষয়গুলো বাদ দিয়ে শাসকরা হিজরি পঞ্জিকার ব্যবহার শুরু করে, ফলে সৌর বিজ্ঞান বিকাশমান ধারাটা থেমে যায়। যদিও আকবরের আমলে আবার সৌর বিদ্যার সাথে সংমিশ্রণ ঘটিয়ে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। বাংলার ইতিহাস বলতে এখন বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং আসামের বরাক উপত্যকার বিগত চার সহস্রাব্দের ইতিহাসকে বোঝায়, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদ এক অর্থে বাংলাকে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারতের ইতিহাসে বাংলা এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। প্রাচীন রোমান ও গ্রিকদের কাছে এই অঞ্চল গঙ্গারিডাই নামে পরিচিত ছিল। চার সহস্রাব্দ পূর্বে বাংলায় সভ্যতার ক্রমবিকাশ শুরু হয়। 

প্রাচীন গ্রিক ও রোমান ভাষায় এই অঞ্চলকে গঙ্গারিডই নামে উল্লেখ করা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে বাংলা সর্বদাই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। প্রাচীন বাংলা কয়েকটি জনপদে বিভক্ত ছিল। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান ভাষায় এই অঞ্চলকে গঙ্গারিডই নামে উল্লেখ করা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে বাংলা সর্বদাই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। প্রাচীন বাংলা কয়েকটি জনপদে বিভক্ত ছিল। বাংলার অন্যতম অঞ্চল ছিল পুন্ড্রবর্ধন। এর  রাজধানী পুন্ড্রনগর (বর্তমান মহাস্থান) এবং অপর শহর কোটিবর্ষ (বর্তমান বানগড়)-এর মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত ছিল সোমপুর মহাবিহার। এর ধ্বংসাবশেষটি বর্তমান বাংলাদেশের বৃহত্তর নওগাঁ জেলার বদলগাছি উপজেলার পাহাড়পুর গ্রামে অবস্থিত।

পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার বা সোমপুর বিহার বা সোমপুর মহাবিহার বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার। পালবংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপাল দেব (৭৮১-৮২১) অষ্টম শতকের শেষের দিকে বা নবম শতকে এই বিহার তৈরি করছিলেন। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম এই বিশাল স্থাপনা আবিষ্কার করেন।

ইউনেস্কোর মতে পাহাড়পুর বিহার বা সোমপুর বৌদ্ধ বিহার দক্ষিণ হিমালয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৌদ্ধ বিহার। এই বিহার বা বিশ্ববিদ্যালয়টির আয়তনে এর সাথে ভারতের নালন্দা মহাবিহারের তুলনা হতে পারে। এটি ৩০০ বছর ধরে বৌদ্ধদের অতি বিখ্যাত শিক্ষাদান কেন্দ্র ছিল। শুধু উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকেই নয়, বরং চীন, তিব্বত, মায়ানমার (তদানীন্তন ব্রহ্মদেশ), মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের মানুষ এখানে জ্ঞান অর্জন করতে আসতেন। খ্রিস্টীয় দশম শতকে বিহারের আচার্য ছিল অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। বৌদ্ধ বিহারটির ভূমি-পরিকল্পনা চতুষ্কোনাকার। 

উত্তর ও দক্ষিণ বাহুদ্বয় প্রতিটি ২৭৩.৭ মি এবং পূর্ব ও পশ্চিম বাহুদ্বয় ২৭৪.১৫ মি। এর চারদিক চওড়া সীমানা দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল। সীমানা দেয়াল বরাবর অভ্যন্তর ভাগে সারিবদ্ধ ছোট ছোট কক্ষ ছিল। উত্তর দিকের বাহুতে ৪৫টি এবং অন্য তিন দিকের বাহুতে রয়েছে ৪৪টি করে কক্ষ। এই কক্ষগুলোর তিনটি মেঝে আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রতিটি মেঝে বিছানো ইটের ওপর পুরু সুরকি দিয়ে অত্যন্ত মজবুতভাবে তৈরি করা হয়েছিল। ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের স্বীকৃতি প্রদান করে। ১২শ শতাব্দীতে দাক্ষিণাত্যের কর্ণাটক থেকে আগত সেন রাজারা বাংলা দখল করেন। 

সেন রাজাদের আমলে সোমপুর রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা হারায়। সেন শাসনের ফলে পতনের দ্বারপ্রান্তে থাকা এই বিহার সম্পর্কে একজন পণ্ডিত লিখেছেন, ‘পাহাড়পুরের বিহার ও মঠের ধ্বংসাবশেষগুলো বড় আকারের ধ্বংসের কোনো স্পষ্ট চিহ্ন বহন করে না। এই বিহারের পণ্ডিতরা বিদ্যালয়টি ছাড়তে শুরু করে এবং  ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয় এই প্রতিষ্ঠান। এর ধ্বংস শুরু হয় মুসলিম আক্রমণের ফলে সৃষ্ট ব্যাপক অস্থিরতার কারণে। 

কুমিল্লার শালবন বিহার হিসাবে যে খননকৃত বিহারটি পাওয়া যায় তাও একটি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। ধারণা করা হয় যে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর শেষ থেকে অষ্টম শতাব্দীর প্রথম ভাগে দেববংশের চতুর্থ রাজা শ্রীভবদেব এ বৌদ্ধ বিহারটি নির্মাণ করেন। শালবন বিহারের ছয়টি নির্মাণ ও পুনর্র্নির্মাণ পর্বের কথা জানা যায়। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীর মধ্যে তৃতীয় পর্যায় কেন্দ্রীয় মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়। ওই সময় সমগ্র বিহারটির সার্বিক সংস্কার হয় বলে অনুমান করা হয়। চতুর্থ ও পঞ্চম পর্যায়ের নির্মাণকাজ ও সংস্কার কাজ সম্পন্ন হয় নবম-দশম শতাব্দীতে।

কুমিল্লার ময়নামতিতে খননকৃত সব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে শালবন বিহার অন্যতম প্রধান। কোটবাড়ি এর বার্ডের কাছে লালমাই পাহাড়ের মাঝামাঝি এলাকায় এই বিহারটির অবস্থান। বিহারটির আশপাশে এক সময় শাল-গজারির ঘন বন ছিল বলে এ বিহারটির নামকরণ হয়েছিল শালবন বিহার। এর কাছে যে গ্রাম রয়েছে তার নাম শালবনপুর। এখনো ছোট একটি বন আছে সেখানে। এ বিহারটি পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের মতো হলেও আকারে ছোট, বিহারে সর্বমোট ১১৫টি কক্ষ আছে। কক্ষের সামনে ৮.৫ ফুট চওড়া টানা বারান্দা ও তার শেষ প্রান্তে অনুচ্চ দেয়াল। প্রতিটি কক্ষের দেয়ালে তিনটি করে কুলুঙ্গি রয়েছে। তেলের প্রদীপ, পুস্তক, পড়ার উপকরণ ইত্যাদি রাখা হতো। এই কক্ষগুলোতে শিক্ষার্থীরা থাকতেন। তারা সেখানে  বিদ্যাশিক্ষা ও ধর্মচর্চা করতেন। শালবন যা ময়নামতি এবং পাহাড়পুর শুধুমাত্র বাংলা অঞ্চলের বিদ্যা অর্জনের স্থান ছিল না। 

পুরাকীর্তি অনুসন্ধানে বের হয়ে আসছে আরও অনেক বিহার, যেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা হতো। কল্পনা করা যায়, আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে শালবন বিহার ও পাহাড়পুর বিহার আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠে ছিল এই বংলায়। যেখানে প্রায় পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী শিক্ষা অর্জন করতে পারতেন। এই সময় পৃথিবীর কোথাও এত বড় বিদ্যার্জনের কেন্দ্র ছিল না। এই সময়কার জনসংখ্যার অনুপাতে জ্ঞানার্জনের জন্য এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয় যথেষ্ট ছিল। কাল পরিক্রমায় শাসকের পরির্তনের ফলে এগুলো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা হারায়। আবার কোনো কোনো শাসক এগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। এর ফলে বাংলা জনপদের মানুষ জ্ঞান অর্জন করতে পারে না। তারা আধুনিক সভ্যতা থেকে পিছিয়ে পড়ে। 

আরএ তারা মূর্খ থেকে যায়। বাংলা জনপদের মানুষ মূর্খ থাকার কারণে বিভিন্ন দেশের শাসকরা একে উপনিবেশে পরিণত করে। আর বাংলা হারায় তার স্বাধীনতা। পরিশেষে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামে বাংলা জনপদটি স্বাধীনতা লাভ কমর বিহার দুটিকে যদি ধ্বংস না করে পুনঃ পুনঃ সংস্কার করে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে জ্ঞান অনুশীলন করা হতো তাহলে আজকে বাংলাদেশে যেভাবে ফ্যাসিবাদের জন্ম নেয় তা আর নিতে পারত না। নিবিড় পর্যবেক্ষণ করলে বুঝা যায়, বাংলার এই দুটি বিহার সৃষ্টি থেকে অদ্যাবধি যদি বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র হিসাবে পরিচালিত হতো, তাহলে বাংলাদেশটিও ইউরোপের যে কোনো দেশের চেয়ে হয়ে যেত জ্ঞানার্জনের বড় কেন্দ্র। 

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট