
বাংলাদেশের কারিগরি শিক্ষার বিকাশ ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে প্রকৌশলী এবং উপ-সহকারী প্রকৌশলীদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ১০ম গ্রেডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদে স্নাতক ডিগ্রিধারীদের আবেদন করা নিয়ে বেশ বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণত, বুয়েট, রুয়েট, কুয়েট, চুয়েটসহ বিভিন্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ডিগ্রিধারীরা ৯ম গ্রেডের সহকারী প্রকৌশলী পদে আবেদন করে থাকেন। কিন্তু কিছুক্ষেত্রে তারা ১০ম গ্রেডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদেও আবেদন করছেন, যা ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য নির্ধারিত করা উচিত বলে মনে করা হয়।
বাংলাদেশের কারিগরি শিক্ষার ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ। ১৯৬০-এর দশকে এশিয়ার অন্যতম কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বিভিন্ন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এবং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়ে যায়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে শিল্প ও নির্মাণ খাতের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষ জনশক্তির চাহিদা বৃদ্ধি পায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে কারিগরি শিক্ষার সিলেবাস আধুনিকীকরণ করা হয় এবং ডিপ্লোমা ও স্নাতক পর্যায়ে প্রকৌশল শিক্ষার জন্য আলাদা আলাদা মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়।
ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররা চার বছর মেয়াদি কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করেন, যা মূলত বাস্তবভিত্তিক ও হাতে-কলমে শিক্ষার ওপর নির্ভরশীল। তারা সরাসরি কাজের পরিবেশে দক্ষতা অর্জন করেন এবং বিভিন্ন নির্মাণ, বিদ্যুৎ, যান্ত্রিক, কৃষি ও অন্যান্য প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অন্যদিকে, স্নাতক ডিগ্রিধারী প্রকৌশলীরা তাত্ত্বিক ও গবেষণাধর্মী শিক্ষায় দক্ষতা অর্জন করেন এবং তারা মূলত পরিকল্পনা, নকশা ও ব্যবস্থাপনামূলক কাজে নিয়োজিত থাকেন। ফলে ৯ম গ্রেড ও ১০ম গ্রেডের মধ্যে স্বতন্ত্র পেশাগত দায়িত্ব থাকা উচিত।
বর্তমানে, ১০ম গ্রেডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদের জন্য স্নাতক ডিগ্রিধারীদের আবেদন করার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। তাদের মতে, ১০ম গ্রেডের পদ তাদের জন্য বরাদ্দ থাকলেও, স্নাতক প্রকৌশলীরা এই পদে আবেদন করায় ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের নিয়োগের সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে। এর ফলে বেকারত্ব বাড়ছে এবং প্রকৃতপক্ষে যারা মাঠপর্যায়ের প্রকৌশল কাজে দক্ষ, তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অবকাঠামো খাতে প্রকৌশলীদের ভূমিকা অপরিসীম। সড়ক, সেতু, বিদ্যুৎ, পানি, গৃহায়ন, শিল্পকারখানা থেকে শুরু করে তথ্যপ্রযুক্তি খাত পর্যন্ত, সবক্ষেত্রে দক্ষ প্রকৌশলীদের প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এই চাহিদা মেটাতে দেশের কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিপুলসংখ্যক ডিপ্লোমা প্রকৌশলী এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক প্রকৌশলীরা বের হয়ে আসছেন। তবে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে অনেক সময় এক ধরনের বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়, যা প্রকৌশল পেশায় স্বচ্ছতা ও দক্ষতার যথাযথ মূল্যায়নে বাধা সৃষ্টি করে। বিশেষ করে, সরকারি প্রতিষ্ঠানে উপ-সহকারী প্রকৌশলী (১০ম গ্রেড) এবং সহকারী প্রকৌশলী (৯ম গ্রেড) পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে নীতিগত অস্পষ্টতার কারণে প্রকৃত ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা অনেক সময় উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না।
সরকারি চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দেখা যায়, ১০ম গ্রেডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদে স্নাতক ডিগ্রিধারীরাও আবেদন করতে পারেন, যা মূলত ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের জন্য সংরক্ষিত হওয়া উচিত। কারণ, একজন ডিপ্লোমা প্রকৌশলী মূলত হাতে-কলমে প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন করেন এবং তাদের প্রশিক্ষণ কৌশলগত দিক থেকে সহকারী প্রকৌশলীর চেয়ে ভিন্ন।
অপরদিকে, স্নাতক প্রকৌশলীরা তুলনামূলকভাবে গবেষণাধর্মী ও প্রশাসনিক দিকগুলোতে বেশি দক্ষ। এই দুই স্তরের প্রকৌশলীদের কাজের পরিধি এবং প্রশিক্ষণের ধরন ভিন্ন হওয়ায় কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও স্পষ্ট বিভাজন থাকা জরুরি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ১০ম গ্রেডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদে স্নাতক ডিগ্রিধারীদের অংশগ্রহণের ফলে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের চাকরির সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে।
এভাবে চলতে থাকলে কারিগরি শিক্ষার প্রতি আগ্রহ কমে যাবে, যা ভবিষ্যতে দক্ষ জনশক্তির সংকট সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া, যখন স্নাতক ডিগ্রিধারীরা ১০ম গ্রেডে যোগদান করেন, তখন তারা ভবিষ্যতে দ্রুত পদোন্নতির সুবিধা পান, অথচ ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা একই পদে অনেক বছর ধরে চাকরি করেও তেমন সুযোগ পান না। এর ফলে এক ধরনের পেশাগত অসামঞ্জস্য সৃষ্টি হয়, যা প্রকৌশল পেশার ভারসাম্য নষ্ট করে। এই বৈষম্য দূর করতে হলে ১০ম গ্রেডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদ কেবলমাত্র ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের জন্য নির্ধারণ করা উচিত।
স্নাতক প্রকৌশলীদের জন্য সরাসরি ৯ম গ্রেডের সহকারী প্রকৌশলী পদ সংরক্ষিত রাখা উচিত। এভাবে কাজের ক্ষেত্র আলাদা করা হলে প্রত্যেক স্তরের প্রকৌশলীরা তাদের নিজস্ব যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থান পাবেন এবং দক্ষতা অনুযায়ী অবদান রাখতে পারবেন। এছাড়াও, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে স্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত ১০ম গ্রেডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী নিয়োগের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের আবেদন নিশ্চিত করা এবং স্নাতকদের ক্ষেত্রে ৯ম গ্রেডের সহকারী প্রকৌশলী পদকে বাধ্যতামূলক করা। এতে করে প্রকৌশল খাতে দক্ষতার ভিত্তিতে সঠিক জনশক্তি ব্যবহার নিশ্চিত হবে এবং কর্মসংস্থানের ভারসাম্য রক্ষা পাবে।
সরকারি চাকরিতে স্নাতক প্রকৌশলীদের ১০ম গ্রেডে অংশগ্রহণের ফলে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের নিয়োগের হার কমছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সালে স্নাতক প্রকৌশলীদের নিয়োগের হার ছিল ৪৫%, যেখানে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের নিয়োগের হার ছিল ২০%। এই পার্থক্য স্পষ্টভাবে দেখায় যে, স্নাতক প্রকৌশলীদের জন্য উন্মুক্ত ১০ম গ্রেডের পদ ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের জন্য সুযোগ সীমিত করছে। একই সঙ্গে, ২০১৮ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের জন্য নিয়োগের হার ধারাবাহিকভাবে কমেছে, যেখানে স্নাতক প্রকৌশলীদের জন্য উন্মুক্ত পদ বাড়ছে। এটি একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা, যা দেশের কারিগরি শিক্ষার প্রতি আগ্রহ কমিয়ে দিতে পারে এবং ভবিষ্যতে দক্ষ জনশক্তির সংকটের কারণ হতে পারে।
এভাবে, সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে এবং প্রকৌশল খাতে দক্ষ জনশক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে, যাতে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং অন্যান্য শিল্প খাতে দক্ষতা বজায় রাখা যায় এবং প্রতিযোগিতামূলক বাজারে সাফল্য অর্জিত হয়। বাংলাদেশের কারিগরি খাতের বিকাশ এবং প্রকৌশল শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য যথাযথ পরিকল্পনা প্রয়োজন। ১০ম গ্রেডের উপ-সহকারী প্রকৌশলীদের জন্য আলাদা নীতিমালা করা হলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে এবং প্রকৃত দক্ষ জনশক্তি সঠিকভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হবে। এটি বাস্তবায়িত হলে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
লেখক: নিবন্ধকার ও প্রকৌশলী
Comments