
প্রতি বছর আমাদের দেশে নানা ধর্মীয়, সামাজিক এবং জাতীয় উৎসবের সময় মানুষের যাতায়াতের চাপ বেড়ে যায়। এই সময়টাতে সাধারণত পরিবহনের চাহিদা অনেক বেড়ে যায় এবং সঙ্গে আসে যানবাহনের ভাড়া বৃদ্ধির সমস্যা। বিশেষত ঈদ, দুর্গাপূজা, নববর্ষ বা অন্যান্য উৎসবের সময় পরিবহনের ভাড়া বাড়িয়ে দেয়া হয়।
একটি সামাজিক অস্বস্তির জন্ম দেয় এই ভাড়া বৃদ্ধি, কারণ এতে করে সাধারণ মানুষের ওপর অর্থনৈতিক চাপ বৃদ্ধি পায়। এই সমস্যা সম্পর্কে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিভিন্ন বাহনের মালিক পক্ষের নানা কৌশল, সরকারি নিয়ন্ত্রণের অভাব, জনগণের সচেতনতার অভাব এবং পরিবহন খাতের সমস্যাগুলোর কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
প্রথমত, উৎসবের সময়ে দেশে মানুষের যাতায়াতের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। শহর থেকে গ্রামে, গ্রাম থেকে শহরে, এক স্থান থেকে আরেক স্থানে মানুষের যাতায়াত বৃদ্ধির সাথে সাথে যানবাহনের চাহিদাও বেড়ে যায়। যেমন, ঈদ বা দুর্গাপূজার সময়ে দেশের নানা স্থান থেকে মানুষ তাদের পরিবারের সাথে সময় কাটাতে চলে আসে বা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যায়। এই সময়টিতে বাস, ট্রেন, মিনিবাস, লঞ্চসহ সব ধরনের পরিবহনে চাপ বেড়ে যায় এবং অধিকাংশ পরিবহনেই অতিরিক্ত যাত্রী ওঠে।
এখন এই অতিরিক্ত যাত্রী চাপকে মোকাবিলা করার জন্য পরিবহন মালিকরা একে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে দূরত্ব অনুযায়ী মনগড়া ভাড়া বাড়িয়ে দেয়। উৎসবের সময় জনগণের চাহিদা বাড়ায় এবং তারা নিজেদের গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। এই প্রক্রিয়া সাধারণত অনেক সময় অসতর্কভাবে সম্পন্ন হয়, যেখানে যাত্রীদেরকে জানানো হয় না যে, ভাড়া বাড়ানো হচ্ছে।
উৎসবকালীন সময়ে যানবাহনের ভাড়া বৃদ্ধি করার পেছনে পরিবহন মালিকদের বিভিন্ন কৌশল কাজ করে। পরিবহন মালিকরা যেসব অজুহাতে ভাড়া বাড়িয়ে থাকেন উদাহরণস্বরূপ, অনেক মালিক দাবি করেন যে তাদের বহরে পর্যাপ্ত যানবাহন নেই, ফলে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমে যায় এবং তারা ভাড়া বাড়ানোর সুযোগ পান। অগ্রিম টিকিট দ্রুত বিক্রি হয়ে যাওয়ার অজুহাতে অনেক পরিবহন সংস্থা মূল টিকিটের তুলনায় বেশি দামে নতুন টিকিট বিক্রি করে। এছাড়া, তারা দাবি করেন যে এ সময় যানজট বেড়ে যাওয়ায় জ্বালানি খরচও বেশি হয়। মহাসড়কে দীর্ঘ সময় আটকে থাকার কারণে চালক ও সহকারীদের জন্য বাড়তি অর্থ দিতে হয়।
এ ছাড়া, অনেক ক্ষেত্রে নামে-বেনামে চাঁদা দিতে হয়, যা পরিবহন ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। ফেরার পথে যাত্রী থাকে না অজুহাতে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়। মালিকদের দাবি, যাত্রার একদিকে অতিরিক্ত চাহিদা থাকলেও ফেরার পথে তেমন যাত্রী পাওয়া যায় না। যতদিন যাচ্ছে পরিবহন মালিকরা নতুন নতুন কৌশল গ্রহণ করে যাত্রীদের থেকে বেশি ভাড়া আদায়ের চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই কৌশলগুলোর কারণে সাধারণ যাত্রীরা চরম দুর্ভোগের শিকার হন। অতিরিক্ত ভাড়া পরিশোধ করা তাদের জন্য আর্থিক চাপ সৃষ্টি করে। অনেক যাত্রী বাধ্য হয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও স্বাভাবিক মূল্যে টিকিট পান না।
এছাড়া, অতিরিক্ত ভাড়ার কারণে নিন্ম ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের যাতায়াতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যানবাহনের ভাড়া বৃদ্ধির একটি বড় কারণ সরকারি নিয়ন্ত্রণের অভাব। যদিও সরকারিভাবে কিছু বিধিমালা রয়েছে, যা ভাড়া বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি সীমা নির্ধারণ করে, বাস্তবে দেখা যায়, এসব বিধিমালার যথাযথ বাস্তবায়ন কখনোই হয় না। সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে অনেক পরিবহন মালিক অধিক ভাড়া আদায় করে থাকেন। সরকার এক্ষেত্রে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিলে এই অস্বচ্ছতা এবং অবৈধ ভাড়া আদায় বন্ধ হতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় বাজার মনিটরিংয়ের নামে বিভিন্ন টার্মিনালে অভিযান পরিচালনা করা হয়।
পরিবহন সংশ্লিষ্টরা গন্তব্য ও ভাড়ার তালিকা উল্লেখ করে চার্ট ঝুলিয়ে রাখে, কিন্তু অভিযান শেষ হলে তারা আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়। অনেক সময় দেখা যায়, পরিবহন কর্তৃপক্ষ চার্টে উল্লিখিত ভাড়ার চেয়ে বেশি টাকা দাবি করে। যাত্রীরা দিতে না চাইলে বলা হয়, টিকিট নেই বা আসন নেই। এতে যাত্রীদের কিছু বলার সুযোগ থাকে না এবং তারা বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত ভাড়া পরিশোধ করেন। সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করা এবং নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা।
ভাড়ার তালিকা নির্দিষ্ট করে পরিবহন মালিকদের তা মেনে চলার বাধ্যবাধকতা দেয়া। যাত্রীদের জন্য অভিযোগ জানানোর নির্দিষ্ট হটলাইন চালু করা। পরিবহন খাতে স্বচ্ছতা আনতে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করা, যেমন অনলাইন টিকিটিং ব্যবস্থা আরও উন্নত করা। পরিবহন শ্রমিকদের ন্যায্য পারিশ্রমিক নিশ্চিত করে মালিকদের মুনাফার সীমাবদ্ধতা নির্ধারণ করা।
সরকারের পাশাপাশি জনগণেরও কিছু দায়বদ্ধতা রয়েছে এই সমস্যা সমাধানে। অধিকাংশ যাত্রী উৎসবের সময় যাতায়াতের ব্যাপারে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নন। তাদের কাছে কোন ভাড়া বৃদ্ধি হবে, কতটুকু বৃদ্ধি হবে, সেটি জানানো হয় না, এবং তারা জানতেও পারেন না যে, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এই অজ্ঞতা বা অবহেলার কারণে পরিবহন মালিকদের জন্য সুযোগ তৈরি হয়, যেখানে তারা একতরফা ভাড়া বৃদ্ধি করতে পারে। যাত্রীদের উচিত নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়া, এবং কোনো পরিবহন মালিক যদি ভাড়া বৃদ্ধির অজুহাত দেয়, তবে সেটি প্রশ্ন করা। প্রতিটি ভাড়া বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকা উচিত এবং এটি নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন।
সাধারণ জনগণের মধ্যেও এই সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে যাতে তারা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে জানে এবং তারা কখনোই অবৈধভাবে বেশি ভাড়া পরিশোধ না করে। দীঘ দিনের পরিবহন মালিকদের অপকৈশল সমস্যার সমাধান করতে হলে, একদিকে যেমন সরকারের সঠিক তদারকি এবং ব্যবস্থা প্রয়োজন, তেমনি জনগণের সচেতনতার ভ‚মিকা অপরিসীম। প্রথমত, সরকারকে কঠোরভাবে পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধির উপর নজরদারি করতে হবে।
সরকারকে জনগণের সুবিধার্থে একটি সুনির্দিষ্ট ভাড়া নিয়ম তৈরি করতে হবে, যা প্রাকৃতিকভাবেই উৎসব বা বিশেষ সময়ে ভাড়া বৃদ্ধি করা থেকে বিরত থাকবে। একই সাথে, সরকারি পরিবহনে আধিকারিকভাবে অতিরিক্ত ভাড়া বৃদ্ধির কোনো সুযোগ না রেখে, মালিকদের স্বচ্ছতা এবং দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, পরিবহন মালিকদের জন্য তদারকি ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করতে হবে। এতে করে ভাড়া বৃদ্ধি আর কোনো দুষ্টু উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না। তৃতীয়ত, যাত্রীদের মধ্যেও সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে, যাতে তারা জানে যে, ভাড়া বৃদ্ধি করা হলে তারা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারে। সচেতন যাত্রী সমাজ গড়ে তুললে, পরিবহন খাতে আরও স্বচ্ছতা আসবে এবং মালিকদের অতিরিক্ত ভাড়া বৃদ্ধির প্রবণতা কমবে।
অতএব, উৎসবের সময়ে যানবাহনের ভাড়া বৃদ্ধি একটি একাধিক কারণে সৃষ্ট সমস্যা, যা জনগণের জন্য একটি বড়ো অস্বস্তি। তবে, সরকারের কঠোর পদক্ষেপ, পরিবহন মালিকদের দায়িত্বশীলতা এবং জনগণের সচেতনতার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। দেশের পরিবহন খাতের সুষ্ঠু উন্নয়ন, শৃঙ্খলা এবং জনগণের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। সরকারের সহায়তায় এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি পেলে, অতিরিক্ত ভাড়া বৃদ্ধি আর একটি সাধারণ সমস্যা হবে না।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট
Comments