
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়া স্পেশাল মিলিটারি অপারেশন শুরু হওয়ার পর থেকেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলোর ঐক্যবদ্ধ নিষেধাজ্ঞা, হুংকার এবং লাগাতার অপপ্রচার শুরু হয়। ইউক্রেনের জয়গান শুরু হয় সমস্ত পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমগুলোতে। প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি হয়ে উঠেন যুদ্ধকালীন সময়ের এক মহানায়ক। সমর ক্ষেত্রে একের পর এক পরাজিত হয়েও ইউক্রেনের যোদ্ধারা হয়ে উঠেন মহান যোদ্ধা। যারা সত্যি সত্যিই রাশিয়া-ইউক্রেনের সংকটের সমীকরণটা বুঝেন তারা শুধু পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যম আর পশ্চিমা নীতি নির্ধারকদের হম্বি-তম্বি দেখে রাগে নিজের মাথার চুল ছেঁড়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।
তবে এসব লোকজন ভালো করেই জানেন নির্মল আকাশ আসে ঝড়ের পরে। নিউটনের তৃতীয় সূত্রেই তাদের নির্ভরতা “প্রতিটি কর্মের সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে।“ আজ আমরা তেমনটিই লক্ষ্য করছি। সত্যকে মিথ্যার বাতাবরণে চাপিয়ে রাখা যায় না। সত্য অখণ্ড, শেষ জয় সত্যেরই, সত্যমেব জয়তে। আজকের আলোচনার বিষয়টা হলো রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চল আক্রমণ নিয়ে।
২০২৪ সালের ৬ আগস্ট ইউক্রেন বাহিনী অতর্কিতে আক্রমণ চালায় রাশিয়ার কুর্স্ক অঞ্চল এবং প্রথম সপ্তাহেই প্রায় এক হাজার বর্গ কিলোমিটার জায়গা দখল করে নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটাই ছিল প্রথম সামরিক দখল যেখানে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র রাশিয়ার ভ‚খণ্ড দখল করে। ইউক্রেনকে এ ব্যাপারে সরাসরি মদদ দেয় বাইডেন প্রশাসন ও তার ইউরোপিয়ান সাঙ্গপাঙ্গরা। কুরস্ক আক্রমণ ছিল ইউক্রেন এবং পশ্চিমাদের ভয়ানক ভুল সিদ্ধান্ত, অদূরদর্শিতা এবং প্রাজ্ঞতার অভাব। রাশিয়ার মতো এত-বড় শক্তিশালী দেশটির বিরুদ্ধে এই আক্রমণ ছিল পশ্চিমাদের জন্য নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারার শামিল। রাশিয়া যখন আবার একের পর এক কুরস্কের জায়গাগুলো দখল করে নিচ্ছ তখন পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যম একেবারে নীরব, মুখে যেন কুলুপ পড়েছে। একি লজ্জা, ভয় নাকি পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমগুলোর ন্যক্কারজনক ভণ্ডামি।
২৪ সালের ৬ আগস্ট। ইউক্রেন রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চলে আক্রমণ চালায় এবং রাশিয়ার ভূখণ্ড দখল করে নেয়। সেপ্টেম্বরের মধ্যেই কুর্স্কের প্রায় ১৩০০ বর্গ কিলোমিটার ভূখণ্ড দখল করে নেয়। তবে অক্টোবর থেকে আর সামনে এগুতে পারেনি ইউক্রেন। ৭ আগস্ট যখন সকালে স্কাই নিউজ চ্যানেলে খবর দেখছিলাম তখন পুরো খবরটিই ছিল ইউক্রেনের এই বিষয়কে নিয়ে। পশ্চিমা বিশ্বে সব সংবাদ মাধ্যমে এটিকে একটি ঐতিহাসিক সাফল্য হিসেবে প্রচার করেছিল। ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর সাহসী অভিযানকে পশ্চিমা মিডিয়া ব্যাপকভাবে প্রচার করে এবং প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে একজন দূরদর্শী ও সাহসী নেতা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
জেলেনস্কি হয়ে উঠেন পশ্চিমা মূল্যবোধ ও গণতন্ত্র রক্ষার প্রতীক। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য এই অভিযানে প্রকাশ্য সমর্থন দেয় এবং এটিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে একটি বড় কৌশলগত সাফল্য বলে দাবি করে। রাশিয়ার পরাজয় নিশ্চিত, পুতিন এবার পালাবে, ইউক্রেন এবার পুরো কুরস্ক অঞ্চলটি দখল করে নেবে এসব হম্ব-তম্বি আগড়ম-বাগড়ম খবর প্রচার করতে থাকে। ইউক্রেনের এই হামলাকে পশ্চিমা বিশ্বের সামরিক পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে দেখানো হয় এবং এটিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শনের এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলে প্রচার করা হয়। ইউক্রেনের সেনাবাহিনী আধুনিক পশ্চিমা অস্ত্র ও সামরিক সহায়তা পেয়ে রাশিয়ার শক্ত ঘাঁটিগুলোতে আঘাত হানে, যা শুরুতে সফল মনে হলেও, বাস্তবে এটি ছিল একটি চরম ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান। প্রাথমিকভাবে ইউক্রেনীয় বাহিনী কিছুটা সাফল্য হলেও, দ্রুতই তাদের লজিস্টিক সংকট, রুশ প্রতিরোধ এবং কৌশলগত সীমাবদ্ধতার কারণে দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে। রাশিয়া পরিকল্পিতভাবে পাল্টা হামলা চালায় এবং কুরস্ক পুনর্দখলের জন্য ব্যাপক সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে ২০২৫ সালের ১১ মার্চের মধ্যে রাশিয়া কুরস্কের প্রায় পুরো অঞ্চলটাই পুনর্দখল করে নেয়।
রাশিয়ার এই সাফল্য ইউক্রেন এবং তাদের পশ্চিমা মিত্রদের জন্য এক বিশাল ধাক্কা, এক বিশাল পরাজয় এবং অপমান। ইউক্রেনের এই আক্রমণ ছিল মূলত পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের এক বড় রাজনৈতিক ও সামরিক জুয়া, যা শেষ পর্যন্ত তাদের জন্য বিপর্যয় ডেকে এনেছে। এই ব্যর্থ অভিযানের মূল পরিকল্পনাকারী ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী। এই দুটি রাষ্ট্রই রাশিয়ার মহা শত্রু। রাশিয়াকে কীভাবে পরাস্ত কর যায় তার নীল নকশা প্রণয়ন করে যায় প্রতিনিয়ত। এই দুটি রাষ্ট্রই ইউক্রেনকে এই ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানে উস্কানি দিয়েছিল। পেছন থেকে শুধু হাততালি দিয়ে বাহবা দিয়েছে।
অথচ নিজেরা সরাসরি কোনো সামরিক হস্তক্ষেপ করেনি। পশ্চিমা শক্তিগুলো ইউক্রেনকে বিশাল পরাক্রমশালী রাশিয়ার বিরুদ্ধে সামনে ঠেলে দেয় এবং আশা করেছিল যে এটি রাশিয়ার শক্তিকে দুর্বল করবে। কিন্তু বাস্তবে, এই হামলা রাশিয়াকে আরও সংঘবদ্ধ হতে সাহায্য করে এবং তাদের সামরিক প্রতিরোধকে আরও মজবুত করে তোলে। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী প্রথম থেকেই পশ্চিমা সহযোগিতা এবং সামরিক অস্ত্রের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল, যা তাদের জন্য একটি বড় দুর্বলতা হয়ে দাঁড়ায়। ইউক্রেনের এই পরাজয় পশ্চিমা শক্তিগুলোর জন্যও একটি রাজনৈতিক ও কৌশলগত ধাক্কা, কারণ এটি তাদের সামরিক সহায়তার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
এখন যখন রাশিয়া কুরস্ক পুনর্দখল করেছে, তখন পশ্চিমা মিডিয়া ও রাজনৈতিক নেতারা চুপ করে আছে, যা তাদের দ্বৈত নীতির সুস্পষ্ট উদাহরণ। লজ্জায় একেবারে নাস্তানাবুদ। এখন আবার অন্য পরিকল্পনা আঁকছে। নতুন করে কিছু সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে “কোয়ালিশন অব উইলিঙ্গ” জোট তৈরি করছে। মাথা খারাপ হলে যা হয় তা শুরু হয়েছে ইউরোপিয়ান নীতিনির্ধারকদের মধ্যে। তবে এটাই ধ্রুব সত্য এই পরিকল্পনাও ভেস্তে যাবে, বুমেরাং-এ রূপ নেবে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের কোনো অশুভ পরিকল্পনাই ধোপে টিকবে না।
বরং রাশিয়ার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করাই হবে পশ্চিমাদের জন্য এবং গোটা বিশ্বের জন্য মঙ্গলজনক। তবে সূ²ভাবে পর্যালোচনা করলে একটি জিনিস পরিষ্কার যে কুরস্ক পুনর্দখল রাশিয়ার জন্য এক বিশাল বিজয়। রাশিয়ার এই বিজয় শুধু কুরস্ক পুনর্দখলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি পশ্চিমা আধিপত্য-বাদী কৌশলের একটি বড় পরাজয়। বিগত কয়েক বছর ধরে পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়াকে দুর্বল করার চেষ্টা করেছে, বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা ও সামরিক চাপে রাশিয়াকে কোণঠাসা করতে চেয়েছে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো-এই প্রচেষ্টা তাদের নিজেদের কৌশলগত ব্যর্থতা প্রকাশ করেছে। ইউক্রেনের সামরিক সক্ষমতা পশ্চিমা অস্ত্র সাহায্য পাওয়া সত্তে¡ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে টিকে থাকতে পারছে না। এটি প্রমাণ করে যে পশ্চিমা দেশগুলোর দেয়া অস্ত্র ও সহায়তা যুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারণে যথেষ্ট নয়, বরং ময়দানে কৌশলগত শক্তিই আসল শক্তি। পশ্চিমা পরিকল্পনাকারীরা রাশিয়াকে সাময়িকভাবে দুর্বল করতে চাইলেও, রাশিয়া নতুন নতুন কৌশল গ্রহণ করে যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের শক্তিশালী করে তুলেছে। এই ঘটনার মাধ্যমে এটি আরও স্পষ্ট হয়েছে যে রাশিয়ার মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে সরাসরি মোকাবিলা করা পশ্চিমা পরিকল্পনার জন্য আত্মঘাতী হতে পারে।
এদিকে, পশ্চিমা মিডিয়ার নীরবতা এই বিষয়টির ওপর আলোকপাত করে যে তারা কেবলমাত্র নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী সংবাদ প্রচার করে। যখন ইউক্রেন কুরস্কে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন তারা এটিকে ‘গণতন্ত্রের বিজয়’ হিসেবে দেখাচ্ছিল, ইউক্রেনীয় সেনাদের ‘সাহসী যোদ্ধা’ বলে প্রশংসা করছিল এবং এই আক্রমণকে রাশিয়ার পতনের সূচনা হিসেবে তুলে ধরছিল। কিন্তু এখন, যখন রাশিয়া অঞ্চলটি পুনরুদ্ধার করেছে, তখন তারা একেবারে নীরব। পশ্চিমা মিডিয়ার এই আচরণ প্রমাণ করে যে তারা নিরপেক্ষ সংবাদ প্রচার করে না; বরং তাদের প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য হলো পশ্চিমা স্বার্থ রক্ষা করা এবং জনগণের মনোভাব নিয়ন্ত্রণ করা। একইভাবে, পশ্চিমা নেতারা যখন দেখলেন যে কুরস্কে তাদেও পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে, তখন তারা নিজেদের কৌশলগত ভুল স্বীকার না করে বরং বিষয়টিকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে।
তারা এখন ইউক্রেনের অন্যান্য অঞ্চল এবং নতুন সামরিক কৌশলের দিকে নজর দিচ্ছে, যেন কুরস্কের পরাজয় গুরুত্বহীন ঘটনা। এই দ্বৈত নীতি শুধুমাত্র মিডিয়ার নয়, বরং পুরো পশ্চিমা পররাষ্ট্রনীতির একটি বহিঃপ্রকাশ।
রাশিয়ার কুরস্ক পুনর্দখল শুধুমাত্র একটি সামরিক সাফল্য নয়; এটি একটি কৌশলগত ও মনস্তাত্তি¡ক বিজয়ও। এই যুদ্ধে রাশিয়া তার সামরিক শক্তির পাশাপাশি কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ বিজয় অর্জন করেছে। ব্রিকস (ইজওঈঝ) দেশগুলো ও বিশ্ব রাজনীতিতে পশ্চিমা আধিপত্য-বিরোধী শক্তিগুলোর সঙ্গে মস্কোর সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়েছে। উত্তর কোরিয়া, ইরান, চীন এবং অন্যান্য মিত্রদের কাছ থেকে রাশিয়া যে সমর্থন পেয়েছে, তা দেখিয়েছে যে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ও কৌশল রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই পরাজয় প্রমাণ করে যে এককভাবে যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে পারবে না।
ইউক্রেনের ওপর তাদের যে অগাধ বিনিয়োগ ছিল, তা এখন সন্দেহের মুখে পড়েছে। ইউরোপীয় জনগণের মধ্যে যুদ্ধের প্রতি সমর্থন ক্রমশ কমছে, কারণ তারা দেখছে যে এই যুদ্ধে ইউক্রেন ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং পশ্চিমাদের দেয়া সহায়তা একের পর এক ব্যর্থতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা যদি রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে, তবে তা তাদের নিজেদের জন্যও চরম ক্ষতিকর হতে পারে। ফলে, কুরস্ক পুনর্দখল পশ্চিমাদের জন্য একটি কঠোর শিক্ষা, তাদের আগ্রাসী নীতি সবসময় কার্যকর হয় না এবং বিশ্ব রাজনীতির ভারসাম্য ক্রমশ বদলাচ্ছে।
কুরস্ক পুনর্দখলের ঘটনা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে পশ্চিমা হেজেমনি এখন দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং তাদের কৌশলগত ভুলের কারণে তারা একের পর এক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। এই যুদ্ধের ফলাফল শুধু সামরিক নয়, এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। ইউক্রেন যুদ্ধ পশ্চিমা বিশ্বকে একটি কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে, তাদের একচেটিয়া আধিপত্যের সময় শেষ হয়ে আসছে এবং নতুন শক্তির সমীকরণ তৈরি হচ্ছে। ভবিষ্যতে, যদি পশ্চিমারা তাদের নীতি পরিবর্তন না করে, তবে তারা আরও বড় ব্যর্থতার সম্মুখীন হতে পারে, যা আন্তর্জাতিক শক্তির ভারসাম্যকে স্থায়ীভাবে রাশিয়ার পক্ষে নিয়ে যেতে পারে।
লেখক: শিক্ষক, গবেষক ও কলামিস্ট
Comments