
আমাদের রাজনীতিতে নীতি আদর্শ অনেকটাই অপাঙ্ক্তেয় হয়ে পড়েছে। মুখে নীতি আদর্শের কথা বললেও কাজে তার স্বাক্ষর থাকে না। সৎ, নিষ্ঠাবান ও নীতি আদর্শে অবিচল নেতাকর্মী এখন খুঁজে পাওয়াই কঠিন। অনেকে রাজনীতিকে নিজ স্বার্থ উদ্ধারের সহজ মাধ্যম বলে মনে করে। অথচ রাজনীতির উদ্দেশ্যটা সম্পূর্ণ এর ভিন্ন।
কিতাবি ভাষায় রাজনীতি হলো ন্যায়নীতি ও আদর্শ অবলম্বন করে রাজ্যের জনগণের কল্যাণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া। কিন্তু এখনকার বাস্তবতায় রাজনীতিতে জনগণের কল্যাণ শব্দটি শুধু কথার কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো- রাজনীতি এখন আর সৎ ও নীতিবান মানুষের হাতে নেই। এটি অনেকটাই চলে গেছে কালো টাকার ব্যবসায়ী ও স্বার্থান্বেষী মানুষের হাতে। সৎ ও আদর্শবান মানুষ যে রাজনীতিতে একেবারেই নেই, তা বলা যাবে না। তবে সংখ্যায় তারা অতি নগণ্য।
তারা আদর্শহীন, অসৎ, লুটেরা লুম্পেনদের দাপটে সর্বদা ম্রিয়মাণ হয়ে থাকেন। মনে রাখতে হবে- তারাও দল ও দেশের সম্পদ। কিন্তু সম্পদকে তো শক্তির হতে হবে। ক্ষমতায় যাওয়াই যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান লক্ষ্য, সেখানে এসব ভালো মানুষদের রাজনীতিকে গতিশীল ও দলকে ক্ষমতাসীন করতে সুশিক্ষিত, দক্ষ ও নেতৃত্ব গুণসম্পন্নও হতে হবে। আধুনিক রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ও পরিচালনায় জনগণ ও যোগ্য নেতৃত্বের অপরিহার্যতা ইতিহাসের অনিবার্য নিয়মে পরিণত হয়েছে। সে কারণে প্রতিটি রাষ্ট্রের উত্থানের সঙ্গে বেশ কিছু দূরদর্শী নেতার ভ‚মিকা অন্যতম প্রধান শর্ত হিসেবে কাজ করেছে।
এ কারণেই আধুনিক সব রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ও স্বাধীনতা অর্জনে জনগণ ও নেতার ভ‚মিকা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। প্রতিটি রাষ্ট্রই নেতৃত্ব দানের জন্য নেতাদের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এখনও আছে। এশিয়া মহাদেশ ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত হওয়ার কালে পেয়েছিল এক ঝাঁক জননন্দিত নেতাকে, যাদের মেধা ও প্রজ্ঞায় এশিয়ার স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের যাত্রা শুরু হয়। চীনে মাও সে তুং, ভিয়েতনামে হো চি মিন, ইন্দোনেশিয়ায় সুর্কণ, ভারতবর্ষে গান্ধি, জিন্নাহ, নেহেরু, সুভাষরা নেতৃত্ব দিয়েছেন স্বাধীনতার জন্য। আমরা বাঙালিরা সেই নেতৃত্বের পর পেয়েছিলাম শেখ মুজিবকে, যিনি বাঙালির হাজার বছরের স্বাধীন রাষ্ট্রচিন্তার সফল রূপায়ণ ঘটিয়েছেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে।
কিন্তু পরবর্তীতে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার নেতৃত্বের অভাবে প্রায় সব কটি রাষ্ট্রেই চলেছে চরম অস্থিরতা, সাম্প্রদায়িকতা, হানাহানি, সম্পদ কুক্ষিগত করা ও ক্ষমতার লড়াই এর রক্তক্ষয়ী সহিংসতার মধ্য দিয়ে। এ পরিস্থিতির আজো কোনো পরিবর্তন হয়নি। তা সত্তে¡ও জনমানুষের সুশাসন ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের আকাক্সক্ষা থেমে যায়নি। শাসনব্যবস্থায় একটা আমূল পরিবর্তনের লক্ষ্যে ভালো ও দক্ষ রাজনীতিকরা সাহস করে এসে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলে মূল রাজনৈতিক দলের অন্ধ আনুগত্য, পেশিশক্তি ও চাপাবাজির জোরে নেতৃত্বের শীর্ষে চলে যাওয়ার নিন্দনীয় দৌরাত্ম্য হ্রাস পাবে।
কারণ, রাজনীতি হলো একটি জাতি, রাষ্ট্র বা সম্প্রদায়কে পরিচালনা করার প্রক্রিয়া। গণতন্ত্রে নাগরিকরা সেই প্রতিনিধিদেরই ভোট দেয়, যারা তাদের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেন। ‘তাদের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া’র এই যে রাজনীতি, তা পরিচালনা করতে দরকার দেশপ্রেমিক ও প্রজ্ঞাবান নেতৃত্ব। এ ধরনের নেতৃত্ব গড়ে ওঠে রাষ্ট্রের তৃণমূল থেকেই, যারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অত্যন্ত কাছাকাছি থেকে তাদের অভাব অভিযোগ চাহিদা জানতে জানতে তাদেরই সমর্থনে ধাপে ধাপে উঠে আসেন রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ে। এমন নেতৃত্বই সর্বস্তরের জনগণের কল্যাণে নীতি গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে সক্ষম হন। যেমনটি হয়েছিলেন আমাদের প্রয়াত মহান নেতৃবৃন্দ।
এখন তো রাজনীতিতে ধীশক্তিসম্পন্ন সুশিক্ষিত ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্বের তেমন দেখাই মেলে না। মেধাবীরা রাজনীতিতে আসছেন না-এমন হা-হুতাশের কথা শোনা যায় প্রায়ই। কিন্তু এ কেবল কথার কথাই। মেধাবীদের রাজনীতিতে সম্মানজনক জায়গা করে দেয়ার তেমন উদ্যোগ তো আমরা দেখি না। প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সন্দেহাতীত সততা ও দেশপ্রেমের গুণে একজন সমরনায়ক থেকে শুধু জননন্দিত রাজনীতিকই হয়ে ওঠেননি, তিনি সেই সময়ের পরীক্ষিত ঝানু রাজনীতিক ও অর্থনীতিবিদদের কাছে টানতে পেয়েছিলেন এবং তাদের অনেককেই দেশ পরিচালনার কাজেও লাগিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, নিজ দলের কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য নেতাকর্মীদের দিক্ষিত করে তুলতে শীর্ষ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীদের দলের কর্মসূচির ওপর নিয়মিত প্রশিক্ষণ নেয়া বাধ্যতামূলকও করেছিলেন, যা আর কোনো দলের মধ্যে দেখা যায়নি।
সাম্প্রতিককালে গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাজনীতি সচেতন একটি তরুণ প্রজন্মের উন্মেষ ঘটেছে। সুস্থ রাজনীতির ধারা তৈরি করতে তারা সক্রিয় ভ‚মিকা রাখলে রাজনীতি নতুন এক পথ খুঁজে পেতে পারে। এই সুযোগকে কাজে লাগাতে না পারলে এ রাষ্ট্র আবারো পুরনো রাজনীতির পথে হাঁটা শুরু করবে, যা কারো কাম্য নয়। তাই যখনই নির্বাচন হোক, পোড় খাওয়া জনগণ যাতে তাদের প্রত্যাশাগুলো পূরণের জন্য এমন একটি রাজনৈতিক দল বেছে নিতে পারে, যারা অতীতের সরকারগুলোর মতো তাদেরকে হতাশ করবে না। ভবিষতে যারা জাতিকে নেতৃত্ব দিতে চান,তাদের পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন জুাতীয় সমস্যা এবং প্রশাসন পরিচালনার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে সম্যক ধারণা নিতে হবে। আজকের বাস্তবতায় পেশাগত দক্ষতাহীন মানুষ ভালো নেতা হতে পারেন না, নীতি গ্রহণে ভূমিকাও রাখতে পারেন না। তাদের প্রতিটি সমস্যার সমাধান সূত্র জানতে হবে।
রাজনীতির মাধ্যমে দেশের মানুষের দৈনন্দিন সমস্যার সমাধান করতে তাদের মানুষের খুব কাছাকাছি যেতে হবে, জানতে হবে তাদের চাহিদার কথা। এসব করতে যথেষ্ট শ্রম ও সময় দিলে আজকের ধীরশক্তিসম্পন্ন তরুণ শক্তির হাতেই চলমান রাজনীতির অন্তঃসারশূন্যতা দূর হতে পারে। প্রয়োজন আজ নৈতিকতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এক ঝাঁক দক্ষ রাজনীতিকের। জুলাই বিপ্লবের চেতনায় দীপ্ত তারুণ্য কাক্সিক্ষত জনকল্যাাণমুখী রাজনীতির প্রতিষ্ঠায় অগ্রণীর ভূমিকা পালন করতে পারেন। নতুন বা পুরনো যে রাজনৈতিক দলই হোক, তাদেরকে সততার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে শতভাগ, নিজেদের পরিশুদ্ধ করতে হবে, জনআকাঙ্খাকে ধারণ করে তা বাস্তবায়নের জন্য যথেষ্ট দক্ষ ও ঘুনেধরা আমলাতন্ত্রের ওপর প্রভাব বিস্তার করার মতো বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তিসম্পন্ন হতে হবে।
রাজনীতিতে শুধু দলের পরিবর্তন নয়, গুণগত পরিবর্তনটাই আজ সবচেয়ে বেশি জরুরি। এজন্য যেসব পরীক্ষিত, ত্যাগী ও দেশপ্রেমিক নেতা দলের দ্বারা কোণঠাসা হয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়েছেন, তাদের খুঁজে বের করে কাছে টেনে তাদের অভিজ্ঞতাভিত্তিক পরামর্শ নিয়ে দেশকে এগিয়ে নেয়ার কর্মযজ্ঞে তাদেরকেও সম্পৃক্ত করতে হবে। এভাবে জনআকাক্সক্ষার সাথে খাপ খাইয়ে নবীন ও প্রবীণের সম্মিলনে এমন এক কল্যাণমুখী সরকার গঠন করতে হবে,যাতে জনগণ অনুধাবন করতে পারে-এটি তাদেরই সরকার, তাদেরই নিজস্ব কণ্ঠস্বর।
লেখক: কবি, কথাশিল্পী ও কলামিস্ট
Comments