Image description

বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে ৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস উদযাপিত হবে। এর উদ্দেশ্য হলো স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা বাড়ানো এবং এই খাতে সমস্যা সমাধানের জন্য প্রচেষ্টা চালানোর তাগিদ দেয়া। ১৯৪৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিষ্ঠার ইতিহাসকে সামনে রেখে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও অন্যান্য সহযোগী সংস্থার তত্ত্বাবধানে প্রতি বছর এই দিবসটি পালন করা হয়। এই দিবসটি সমস্ত স্তরের স্টেকহোল্ডারদের একত্রিত হওয়ার, এবং কার্যকর, টেকসই স্বাস্থ্য নীতি এবং অনুশীলনের পক্ষে পরামর্শ দেয়ার জন্য একটি অমূল্য সুযোগ প্রদান করে। দিনটি উদযাপন করা সরাসরি দুটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনকে সমর্থন করে। 

এসডিজি টার্গেট ৩: সুস্বাস্থ্য এবং কল্যাণ। এটি সমৃদ্ধ এবং টেকসই সমাজগুলোর ভিত্তি হিসাবে সুস্বাস্থ্যের গুরুত্বকে জোর দেয় এবং বৈষম্য হ্রাস এবং অংশীদারিত্বকে উৎ্সাহিত সহ অন্যান্য এসডিজির সাথে স্বাস্থ্যের আন্তঃসংযোগকে তুলে ধরে। এসডিজি টার্গেট ১০: বৈষম্য হ্রাসকরণ: এটি সমান চিকিৎ্সার পক্ষে এবং কুষ্ঠরোগের সাথে বসবাসকারী ব্যক্তিদের জন্য বিশেষত স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে বৈষম্য হ্রাস করার পক্ষে প্রচারণায় গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে।

স্বাস্থ্য বিষয়ক ’কুষ্ঠ’ ইস্যুটি এসডিজি অর্জনের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। যদি কুষ্ঠ ইস্যুটি জাতীয়ভাবে অবহেলিত হয় তবে বাংলাদেশ এর পক্ষে এসডিজি’র টার্গেট অর্জন করা কঠিন হতে পারে। আমাদের জাতীয় বাজেটে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দের মাধ্যমে কুষ্ঠ ইস্যুটি সঠিকভাবে সমাধান করা হলে বাংলাদেশ জাতীয়ভাবে উপকৃত হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্য খাতে অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে বলে অনেকে মনে করেন। জলবায়ু পরিবর্তন, সংঘাত, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক সংকট মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিশ্বব্যাপী এই সংকটগুলো কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য বিপর্যয়কর হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে। বিশ স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কুষ্ঠরোগ একটি অবহেলিত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগ, যা এখনও বিশ্বের ১২০টিরও বেশি দেশে দেখতে পাওয়া যায়।

বাংলাদেশে কুষ্ঠ অন্যতম একটি জাতীয় স্বাস্থ্য সমস্যা। যদিও মূলত স্বাস্থ্য সমস্যা, তবে কুষ্ঠ অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং মানবিক সমস্যা সৃষ্টির জন্যও দায়ী। যদি কেউ এই রোগ এর কারণে প্রতিবন্ধী হয়, তবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা জীবিকা নির্বাহের কাজকর্ম করতে পারেন না, তারা পরিবার এবং সমাজের জন্য বোঝা হয়ে উঠেন। যেহেতু কুষ্ঠরোগের বিষয়ে কুসংস্কার রয়েছে, তাই কুষ্ঠ রোগীরা এমনকি তাদের পরিবারের সদস্যরাও বৈষম্যের শিকার হন, যার ফলস্বরূপ তাদের কর্মসংস্থান, বিবাহ, শিক্ষা এবং অন্যান্য সামাজিক ক্রিয়াকলাপের জন্য সমস্যায় পড়তে হয়। তারা সমাজ কর্তৃক এক ধরনের বয়কটের শিকার হন, যদিও কুষ্ঠ ব্যাপক মানবিক দুর্ভোগ তৈরির জন্য দায়ী, তবুও এই বিষয়টি দেশে অবহেলিত ছিল। বিষয়টি তার প্রাপ্য জাতীয় মনোযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কুষ্ঠ হলো একটি দীর্ঘস্থায়ী সংক্রামক রোগ যা মূলত মাইকোব্যাক্টেরিয়াম লেপ্রে নামক এক ধরনের ব্যাকটিরিয়া দ্বারা সৃষ্ট। এই রোগটি ত্বক, পেরিফেরিয়াল স্নায়ু, উপরের শ্বাসযন্ত্রের ট্র্যাক্টের শ্লেষ্মা এবং চোখের ওপর প্রভাব ফেলে। শারীরিক বিকৃতি ছাড়াও, কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা কুসংস্কার এবং বৈষম্যের মুখোমুখি হন। তবে, কুষ্ঠরোগ নিরাময়যোগ্য এবং প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা প্রতিবন্ধিতা রোধ করতে পারে। প্রাথমিক রোগ নির্ণয় এবং আক্রান্তদের তাৎ্ক্ষণিক চিকিৎসার আওতায় আনা হলে কুষ্ঠ নিরাময় হয়। আক্রান্তদের সময়মতো চিকিৎ্সা না করা হলে প্রতিবন্ধিতা দেখা দিতে পারে।

গতিশীলতা পুনরুদ্ধার করতে ফিজিওথেরাপি এবং পুনর্গঠনমূলক শল্য চিকিৎসার প্রয়োজন। আলসার এবং সংক্রামিত ক্ষতগুলোর যত্ন নেয়া হলে ব্যথা এবং অঙ্গ-বিচ্ছেদ রোধে গুরুত্বপূণ ভ‚মিকা পালন করে। কুষ্ঠরোগের প্রভাবগুলো আজীবন হতে পারে এবং তাই স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনও সেরকম। কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা তাদের স্বাস্থ্যের অধিকার আদায়ের জন্য সোচ্চার হচ্ছেন। তারা কুসংস্কার এবং বৈষম্যের অবসানের জন্য প্রচারণা চালাচ্ছেন, যা তাদের চিকিৎ্সা সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তারা প্রতিবন্ধী-অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে প্রত্যেকে সমাজে পুরোপুরিভাবে অংশ নিতে পারে।

কুষ্ঠরোগের ফলে সমাজে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়, সে বিষয়ে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আমরা নিষ্ক্রিয়তা প্রদর্শন করতে পারি না। এমন একটি পৃথিবীর কল্পনা করুন যেখানে স্থায়ী প্রতিবন্ধিতা হওয়ার আগে অনেক লোক কুষ্ঠরোগের নিরাময় পেতে পারে। যেখানে লোকেরা তাদের সম্প্রদায়গুলোতে ফলোআপ চিকিৎ্সা এবং মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা পেতে পারে। যেখানে দারিদ্র্য, বৈষম্য এবং কাঠামোগত বাধা আর মানুষকে একটি পূর্ণ, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন থেকে বিরত রাখে না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস ২০২৫ এর বার্তা হলো স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে দেশের প্রত্যেকের জন্য দায়িত্ব পালনের একটি উদাত্ত আহ্বান। সকল প্রচেষ্টা একত্রিত করে কুষ্ঠ বিষয়টি সমাধান করার জন্য এই দিবসটি আমাদের জন্য একটি সুযোগ এনে দেয়। এই  দিনের ইভেন্টগুলোতে অংশ নিয়ে কুষ্ঠমুক্ত একটি স্বাস্থ্যকর এবং আরও ন্যায়সঙ্গত বিশ্ব গড়ার আন্দোলনে আমরা অবদান রাখতে পারি।

বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে কুষ্ঠমুক্ত দেশ গড়ার ভিশন অর্জনের জন্য ‘একটি জাতীয় কৌশলগত পরিকল্পনা ২০২৩-২০৩০’ তৈরি করেছে। এখন এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া সরকারের দায়িত্ব। আমাদের কুষ্ঠ বিরোধী কার্যক্রম হাতে নেয়া দরকার, যেমন এই রোগের বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো, আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করা ও চিকিৎসার আওতায় আনা, দেশব্যাপী জটিল কেস-সহ এই রোগের চিকিৎসার মানসম্পন্ন চিকিৎসার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা, চিকিৎ্সক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেয়া, আক্রান্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন করা এবং সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী কাঠামোতে কুষ্ঠরোগের চিকিৎসা  অন্তর্ভুক্ত করার আরো পদক্ষেপ নেয়া। কুষ্ঠ সময় মতো চিকিৎ্সায় নিরাময়যোগ্য। এর পরীক্ষা এবং চিকিৎ্সা দেশে বিনামূল্যে পাওয়া যায়। কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা তাদের স্বাস্থ্যের অধিকার যাতে পায় তা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হবে।
 
দ্য লেপ্রসী মিশন ইন্টারন্যাশনাল-বাংলাদেশ এর মতে, স্বাস্থ্যের সংজ্ঞানুসারে মানসিক স্বাস্থ্য স্বাস্থ্যেরই একটি অংশ। কুষ্ঠজনিত কুসংস্কারের কারণে আক্রান্ত ব্যক্তিরা মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সমস্যার সম্মুখীন হন। স্বাস্থ্য একটি মৌলিক মানবাধিকার। এটি বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের যথাযথ স্বাস্থ্যসেবাতে, বিশেষ করে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য কাউন্সিলিং, প্রবেশগম্যতা প্রয়োজন। এটা না হলে তারা কেবল স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির অধিকার থেকেই বঞ্চিত হবে না, বরং তাদের জীবিকা, আনন্দ এবং একটি বিকাশমান জীবনযাপনের সুযোগ থেকেও তারা বঞ্চিত হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে আসুন আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থে কুষ্ঠের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একত্রে কাজ করার অঙ্গীকার গ্রহণ করি। 

লেখক: কলামিস্ট