
আর এক সপ্তাহ পরেই শেষ হচ্ছে পবিত্র মাহে রমজান। পবিত্র ঈদুল ফিতরের পরপরই সরাসরি জাতীয় নির্বাচনের জন্য সকল ধরনের প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছে বিএনপি। দলটির একাধিক সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। ইফতার পার্টির মাধ্যমে সারাদেশে দলীয় নেতাকর্মীদের চাঙ্গা ও সাধারণ জনগণের মধ্যে দলটির জনপ্রিয়তা আরো বাড়াতে নানা কৌশলে এগোচ্ছেন স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতারা। প্রতিদিন তারেক রহমানের উপস্থিতিতে দেশের কোথাও না কোথাও ইফতার পার্টি, আলোচনা সভায় অংশ নিচ্ছে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। দলটির কয়েকটি সূত্র গতকাল বুধবার মানবকণ্ঠকে জানিয়েছে সরকারের নানা সংস্কার কাজ মোটামুটি শেষ পর্যায়ে রয়েছে। শেখ হাসিনার বিচারসহ জুলাই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচারও দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। সব কিছু বিবোচনা করে একমাত্র নির্বাচনের লক্ষে বিএনপি এখন মাঠ চষে বেড়াচ্ছে।
বিএনপির নয়াপল্টন সূত্র জানিয়েছে, ঈদের পরেই সারাদেশে ৩০০ আসনে নিজ নিজ এলাকায় দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীদেরকে অবস্থান করার জন্য নির্দেশ দেয়া হতে পারে। বিএনপির একজন স্থায়ী কমিটির সদস্য গতকাল মানবকণ্ঠকে বলেন, সারাদেশে প্রতিটি থানায়, পৌরসভায়, জেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে সংগঠনিক শক্তি তৈরি করবে দলটি। তারপর খুব অল্প সময়ের মধ্যে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত থাকতে মনোনয়ন প্রত্যাশীদেরকে নির্দেশ দেয়া হবে। সেই মোতাবেক দলটির নেতারা কাজ করছে বলেও জানান বিএনপির এই নেতা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে দেশের হারানো গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন করছে। এরই ধারাবাহিকতায় স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে। বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনের দিনক্ষণ সুনির্দিষ্ট না থাকলেও প্রায় সব রাজনৈতিক দল দ্রুত সময়ে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। এজন্য সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি নির্বাচনের প্রস্তুতি রয়েছে বিএনপির। ধানের শীষের লিফলেট এটা একটা নির্বাচনী প্রস্তুতির সংকেত।
এদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, তার দলের মূল লক্ষ্য দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করা। এখন সময় এসেছে নেতৃত্ব বাছাই করার। জনগণ ভোটের মাধ্যমে তা ঠিক করবে। স¤প্রতি একটি জেলা সম্মেলনে ভার্চুয়ালি যোগ দিয়ে এসব কথা বলেন তিনি। সম্মেলন পূর্ব সমাবেশে তারেক রহমান বলেন, এখানে যে কাউন্সিলররা আছেন তারা হচ্ছে শহীদ জিয়ার সৈনিক, বেগম খালেদা জিয়ার সৈনিক- যাদের অন্তরে ছিল শুধুই বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষ। যে কোনো মূল্যে জনগণের আস্থা অর্জন করতে নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। তারেক রহমান আরো বলেছিলেন, বিএনপি চেষ্টা করছে দেশের মানুষের দেয়া দায়িত্ব পালন করার। সময় এসেছে দেশকে গড়ে তোলার। তাই আড়াই বছর আগেই বিএনপি ৩১ দফা উপস্থাপন করেছে। এ সময় যে কোনো মূল্যে নেতাকর্মী সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার ওপর গুরুত্বারোপ করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
আর বিএনপি চেয়ারপারসনের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা কমিটির বিশেষ সহকারী ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন বলেন, সংস্কারের কথা বলে নির্বাচনকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিএনপির হাতে দেশে যত সংস্কার হয়েছে তা কারো হাত দিয়ে হয় নাই। তিনি বলেন, ১৭টি বছর জনগণ আন্দোলন সংগ্রাম করেছে ভোটের অধিকারের জন্য। হাজার হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছে নিজের ভোট নিজে দেয়ার জন্য। অথচ, রক্তের বিনিময়ে পতিত স্বৈরশাসকের বিদায় হলেও ভোট নিয়ে এখনো ষড়যন্ত্র অব্যাহত আছে।
অপরদিকে গত প্রায় ৮ মাস আগে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর দল শক্তিশালী করতে একের পর এক নতুন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বিএনপি। পরবর্তী নির্বাচনের দিনক্ষণ নির্ধারণ না হলেও সে বিষয়ে কৌশল এবং সতর্কতার সঙ্গে এগোচ্ছে বিএনপি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেড় দশকের বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনার পতনের আন্দোলনে ক্লান্ত ও বিপর্যস্ত বিএনপি এবং অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দলটির নেতাকর্মীরা নির্বিঘ্নে চলাফেরা করছেন। দেশজুড়ে চলছে সাংগঠনিক তৎপরতা। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ‘কঠিন’ হবে এমনটা ভেবেই বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছেন দলের নীতিনির্ধারকরা।
দলীয় সূত্র জানায়, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে জনমনে স্বস্তি ফেরানো এবং নতুন ধারার রাজনীতির চর্চা ঘটাতে চায় বিএনপি। এ ক্ষেত্রে বিএনপি ঘোষিত রাষ্ট্র মেরামতের লক্ষ্যে ৩১ দফা রূপরেখা জনগণের কাছে নতুনভাবে তুলে ধরতে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে দলের শৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর হওয়ার পাশাপাশি সংগঠন গোছাতেও নজর দলটির হাইকমান্ডের। বর্তমান পরিস্থিতিতে নেতাকর্মীরা যাতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে না পড়েন, সেজন্য আবারও মাঠে নামছে দলটির তিন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল। বিএনপি হাইকমান্ডের নির্দেশে নেতাকর্মীদের আরও জবাবদিহির আওতায় আনতে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে যৌথ কর্মিসভা শুরু করেছেন এসব সংগঠনের শীর্ষ নেতারা।
একই সঙ্গে বিএনপির দলীয় প্রতীক ধানের শীষের প্রচার-প্রচারণাও চালাচ্ছেন তারা। এর আগে গেল বছরের গত ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে তারা এই কার্যক্রম শুরু করেন। জানা গেছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর প্রথম দিনই দুর্নীতি, লুটপাট, দখল ও নির্যাতন-নিপীড়নের বিষয়ে নেতাকর্মীদের সতর্ক করে বার্তা দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ও দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর অবস্থানও নেন তিনি। বিশেষ করে সনাতন ধর্মের মানুষের নিরাপত্তার জন্য দলীয়ভাবে নির্দেশনা দেন। তার পরও দেশের বিভিন্ন স্থানে লুটপাট, দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠে বিএনপির বেশকিছু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। এসব ঘটনায় দলের নীতিনির্ধারকরা বিব্রত এবং উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। এ ক্ষেত্রে দলীয় শৃঙ্খলা ধরে রাখতে কঠোর অবস্থান নেয় বিএনপি।
ফলে যাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগের সত্যতা মিলেছে, তাদের সাংগঠনিক শাস্তি দেয়া হয়েছে। এই পর্যন্ত প্রায় তিন হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে কারণ দর্শাও নোটিশ দেয়ার পাশাপাশি বহিষ্কারও করা হয়েছে। গত ৫ আগস্টের পর কিছু বিতর্কিত অসাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের কারণে বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলসহ বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের একাধিক জেলা, উপজেলা কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। বিএনপির ৮১টি সাংগঠনিক জেলা ইউনিটের কমিটি হালনাগাদ কার্যক্রমও চলমান আছে।
জানা যায়, আগামীতে দলীয় নেতাকর্মীদের আরও বেশি সতর্ক রাখা ও জবাবদিহির আওতায় আনতে এখন সাংগঠনিক তৎপরতা চালাচ্ছেন শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। এরই প্রাথমিক অংশ হিসেবে সারা দেশে যৌথ কর্মিসভা শুরু করেছে বিএনপির তিন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রাজনীতি ও জনগণ নিয়ে তারেক রহমানের যে বার্তা, তা দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে পৌঁছে দেবেন সংগঠনের নেতারা।
যুবদলের সভাপতি আবদুল মোনায়েম মুন্না বলেন, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে যৌথ কর্মিসভা করা হচ্ছে। কেউ বিশৃঙ্খলা করলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বিষয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কঠোর বার্তা সারা দেশের নেতাকর্মীদের মধ্যে পৌঁছে দিতে চাই।
ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছির বলেন, তারা নতুন ধারার রাজনীতি গড়ার লক্ষ্যে ছাত্রসমাজের কাছে যাচ্ছেন। অভিজ্ঞতা বিনিময় করছেন। নতুন ধারার রাজনীতি নিয়ে ব্যাপক সাড়াও পাচ্ছেন।
Comments