সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা পরিপত্র পুনর্বহালসহ চার দফা দাবি আদায়ে তৃতীয় দিনের মতো “বাংলা ব্লকেড” কর্মসূচির অংশ হিসেবে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক অবরোধ করেছেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ৷
বুধবার (৮ জুলাই) সকাল ১০টা থেকে বিভিন্ন সড়কে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। ফলে রাজধানীর বেশিরভাগ সড়কে বন্ধ হয়ে গেছে যানবাহন চলাচল। ফলে ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন অফিসফেরত মানুষেরা। সড়কে যানবাহন বন্ধ থাকায় অনেকেই পায়ে হেঁটে গন্তব্যস্থলের পধ ধরেছেন।
সকাল সোয়া ১০টার দিকে ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাসে জড়ো হন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। পরবর্তীতে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তারা মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা কলেজ থেকে সায়েন্স ল্যাব মোড়ে এসে ব্লকেড কর্মসূচি পালন করে। সকালে যান চলাচল স্বাভাবিক থাকলেও সাড়ে ১০টা থেকে মিরপুর রোড স্থবির হয়ে যায়। তখন যেসব যানবাহন চলাচল করছিল সেগুলো আটকে পড়ে। পরে এসব যানবাহনের যাত্রীরা হেঁটেই রওনা করেন গন্তব্যে।
বুধবার দুপুরে দেখা যায়, নিউ মার্কেট থেকে সায়েন্স ল্যাব আসার পথে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি বাস। মিরপুর থেকে ধানমন্ডি বা ধানমন্ডি থেকে জিগাতলায় যাওয়ার রাস্তার চিত্রও এক। রাস্তায় বাস থাকলেও বাসে ড্রাইভার, হেলপার, যাত্রী কেউই নেই। যাত্রীরা কিছুটা হেঁটে কিছুটা রিকশায় করে যাচ্ছেন তাদের গন্তব্যে। আর ড্রাইভার হেলপাররা বাস থেকে নেমে বিশ্রাম নিচ্ছেন বা ঘোরাঘুরি করছেন আশপাশে। কেউ আবার ঘুম দিয়েছেন গাড়ির ভেতরেই।
সাভার বাইপাইল থেকে সকালে ডাক্তার দেখাতে এসেছিলেন জাকিয়া আক্তার। এসেছিলেন বাসেই। কিন্তু এখন ফেরার আর কোনো বাস পাচ্ছেন না। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, সকালে বাসে করে শাশুড়িকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে এসেছিলাম বঙ্গবন্ধু হাসপাতালে। কিন্তু এখন যাওয়ার কিছু পাচ্ছি না। শাহবাগ থেকে এখান (সায়েন্স ল্যাব) পর্যন্ত হেঁটে এসেছি। এখন দেখি রিকশা নিয়ে কতদূর যেতে পারি। সন্ধ্যা পর্যন্ত তো আর থাকা যাবে না, ভেঙে ভেঙেই যেতে হবে।
কুরিয়ার সার্ভিসের গাড়ি নিয়ে ধানমন্ডি ২ নম্বরে (সিটি কলেজের রোডে) বসে ছিলেন চালক আমানূর রহমান। তিনি বলেন, আমি সকাল সাড়ে ১১টা থেকে বসে আছি। সন্ধ্যার আগে যেতে পারবো না। কিছু করার তো নাই বসে থাকা ছাড়া। দেরি হচ্ছে, কেন দেরি হচ্ছে সেটা কোম্পানি জানে।
এসময় একই রাস্তায় আরেকটি গাড়ির চালক আবু বকরের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ১২টা থেকে গাড়ি থামিয়ে বসে আছি। যেতে পারছি না। কিছু করারও নেই, মোবাইলে গান শুনছি। আন্দোলন হচ্ছে, রাস্তাঘাট বন্ধ। আন্দোলন নিয়ে আবু বকর বলেন, আমি এই আন্দোলনের পক্ষে। কোটা বাতিল করা হোক। আমার এক আত্মীয় পড়াশোনা করে একটা চাকরি পায়নি। হয়তো কোটা না থাকলে সেও চাকরি পেতো।
কলাবাগান থেকে হেঁটে সায়েন্স ল্যাব এসেছেন মনির আহমেদ। তিনি যাবেন সাতক্ষীরায়, বিকাল সাড়ে ৩টায় তার বাস। তিনি বলেন, কীভাবে যাবো বুঝতে পারছি না। বাস ঠিক সময়মতো ছাড়তে পারবে বলেও মনে হচ্ছে না। সব জায়গায় একই অবস্থা। আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার মতে ছাত্রদের এই আন্দোলন যৌক্তিক। এই কারণেই এত কষ্ট করে হেঁটে এসেও বিরক্ত লাগছে না। অন্য সময়ে জ্যামে বসে থাকলেই মেজাজ গরম হয়ে যায়।
সকাল ১১টা থেকে বাস থামিয়ে বসে আছেন বিকাশ পরিবহনের চালক মো. আজিজ। তিনি বলেন, আজ হয়তো আমার রোজের টাকাটা পাবো না। কারণ আজ গাড়ি চালাতেই পারিনি। আমি তো গাড়ি নিয়ে বের হয়েছি ঠিকই, আমার তো আর কোনও দোষ নাই। কিন্তু তেলের খরচের টাকাই যদি না ওঠে তাহলে তো মালিক টাকা দিবে না। গত দুদিন তাও গাড়ি চালাতে পেরেছিলাম, আজ একেবারেই পারি নাই।
আন্দোলন নিয়ে তিনি বলেন, ছাত্রদের আন্দোলনের পুরো ব্যাপারটা আমি বুঝি না। কিন্তু সবারই দাবি থাকতে পারে, তাদেরও আছে। সরকারের উচিত তাদের দাবি মেনে নেওয়া। কারণ সরকার এর আগে গাড়িতে হাফ পাসের (অর্ধেক ভাড়া) দাবিও মেনে নিয়েছিল আন্দোলনের পর। তাহলে ওইটা মানলে এটা মানবে না কেন?
এদিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেছেন, আমরা যখন রাস্তায় গরমে ঘাম ঝরাচ্ছি তখন আপিল বিভাগ থেকে কোটার যে রায় ছিল সেটা বহাল রেখেছে। আমরা ছাত্র সমাজ আপিল বিভাগ থেকে যে রায় দিয়েছে সেই রায়কে প্রত্যাখ্যান করছি। আমরা বলতে চাই, ছাত্র সমাজের প্রাণের এক দফা দাবি হচ্ছে সরকারি চাকরির সব গ্রেডে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ সবকটি জায়গায় অযৌক্তিক কোটা বাতিল করতে হবে। সংবিধানের প্রতি আমরা সম্মান রেখে বলছি, সংবিধানে উল্লেখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করে যৌক্তিকভাবে কোটা রেখে সংসদে আইন পাস করতে হবে। যতদিন পর্যন্ত ছাত্র সমাজের এক দফা দাবি আদায় না হবে, আমরা রাজপথ থেকে ফিরে যাবো না।
Comments