Image description

দীর্ঘদিন জাতির বুকে অসহ্য যাতনার এক জগদ্দল পাথর হয়ে চেপে বসেছিল সাবেক শেখ হাসিনা সরকার। পাথরটা এতোটাই ভারি ছিল যে, যেকোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষেই সেটা সরানো ছিল প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার। তারপরেও বিরোধীপক্ষে চেষ্টা যে চলেনি এমনটা নয়, চলেছে। বছরব্যাপী দেশের নগর-মহানগরে তারা আন্দোলন সংগ্রাম করেছে। রাজপথে লক্ষ লক্ষ কর্মী-সমর্থক জমায়েত করে ব্যাঘ্র হুংকারে আন্দোলনের মাঠ সরগরম করেছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। উল্টো সবই বিফলে গেছে। কারণ প্রধানত দুটি। প্রথমত, ফ্যাসিবাদী সরকারের পেটোয়া পুলিশ বাহিনির অন্যায্য দমন-পীড়নকে তারা সাহসিকতার সাথে মোকাবিলা করতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, দেশের সকল শ্রেণিপেশার মানুষকে আন্দোলনের মাঠে নামাতে জনগণের আবেগকেও তারা ছুঁতে পারেনি। কেন পারেনি, তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিতে কোনো বিদগ্ধ রাজনৈতিক বিশ্লেষক হবার প্রয়োজন নেই। সত্যি বলতে কী, জনগণের আবেগ ছুঁতে চাইলে রাজপথে আবু সাঈদ, মুগ্ধ আর ফাইয়াজ হতে হয়। বিরোধীপক্ষ সেটা পারেনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা সেটা পেরেছে। গুলির মুখে বুক পেতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার সৎ সাহস ভাইরাসের মতো এক বুক থেকে শত সহস্র বুকে ছড়িয়ে দিয়ে ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করেছে। 

ছাত্র আন্দোলনটা শুরুই হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার ইস্যু নিয়ে। শুরুতে সরকার সেটাকে পাত্তাই দেয়নি। কেন দেবে? কারণ কোটা নীতিতে যে তাদের মনের খায়েশ মেটানোর রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি ছিল। তাই আন্দোলন দমাতে তারা শক্তি প্রয়োগ করেছে। ছাত্রলীগ লেলিয়ে দিয়ে হামলা-নির্যাতন চালিয়েছে। পুলিশ দিয়ে নির্বিচারে ছাত্র-জনতা হত্যা করেছে। কিন্তু দমাতে পারেনি। উল্টো ভাই হত্যার বদলা নিতে ছাত্ররা রাজপথে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। অন্যদিকে সুযোগের অপেক্ষায় থাকা নির্যাতিত বিএনপি-জামায়াতও তাদের সাথে যোগ দিলে আন্দোলনের প্লাবনে ঢেউ জাগে। সরকার সেটাকেও সামলে নিতে নির্মম হত্যাযজ্ঞের পথ বেছে নিলে তা সাধারণ জনতার আবেগকে চরমভাবে নাড়া দেয়। ফলে যা হবার তাই হলো। নারী-শিশুসহ সমাজের সকল শ্রেণিপেশার বিক্ষুব্ধ জনতা একসাথে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লো। যেটা ছিল নিছকই কোটা আন্দোলন, সেটাই কিনা সাধারণ জনতার অংশগ্রহণে বানের পানিতে অতিবর্ষণের মতো সরকার পতনের মহাপ্লাবনে রূপ নিলো। যারা ভেবেছিল, শেখ হাসিনা বেঁচে থাকতে পতন অসম্ভব, তারাই ১৬ জুলাই হতে ৫ আগস্টের দুর্বার আন্দোলনে শেখ হাসিনার ন্যক্কারজনক পরিণতি দেখে অবাক বিস্ময়ে চক্ষু কপালে তুললো। জাতি হাফ ছেড়ে বাঁচলো। জনমনে স্বস্তি ফিরলো।

কিন্তু স্বস্তির ক্ষণকাল পরেই অস্বস্তির পালা শুরু হলো। মুহূর্তেই গণভবনসহ সারাদেশে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট, রাহাজানি ছড়িয়ে পড়লো। ব্যাখ্যা দাঁড় করানো হলো, দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত আক্রোশ থেকেই বিক্ষুব্ধ জনতা এসব করেছে। ব্যাখ্যায় যুক্তি আছে বটে, কিন্তু খোঁড়া ও দুর্বল। নীতিনৈতিকতার সাথে তা যায় না একদমই। জুলুমের বিরুদ্ধে জয়লাভ করে জুলুমেই যারা সমাধান খোঁজেন, তারা আর যাই হোক সমাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন না। বরং পাল্টা জুলুমের পথকেই উš§ুক্ত রাখেন। ফলে দুঃখজনকভাবে একই ইতিহাস বারবার ফিরে আসে। বিগত তের-চৌদ্দ বছরে বিরোধীপক্ষের ওপর অনেক জুলুম-নির্যাতন হয়েছে, সেটা সবাই জানে। জনগণের নাগরিক অধিকার নিয়েও সরকার যাচ্ছেতাই ছিনিমিনি খেলেছে। যেটাই হোক, বিচারযোগ্য অপরাধের জন্য তো আইন আছে, আদালত আছে। আমরা বিচার চাইতে পারি, কিন্তু আইন হাতে তুলে নিতে পারি না। অথচ আদালত চত্বরে আমরা কী দেখছি? দেখছি আসামির ওপর কেউ ডিম ছুড়ছে, কেউ কিল-ঘুষি মারছে, কেউ কেউ আবার দৌড়ে এসে ফ্লাইং কিক করছে, যা একেবারেই কাম্য নয়। সুতরাং অতীতে আদালত চত্বরে আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ওপর রক্তাক্ত হামলার অভিযোগ টেনে বর্তমানকে যারা জাস্টিফাই করতে চান, তাঁদের সাথে বিনয়ের সহিত দ্বিমত পোষণ করি। 

চাঁদাবাজি-দখলদারি এদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাথে যেন আমে-দুধে মিশে গেছে। ফলে যারাই ক্ষমতায় যায়, তারাই এতে মত্ত হয়ে ওঠে। তবে এবারে যা হয়েছে, তা খুবই নাটকীয়। ক্ষমতায় যাওয়ার আগেই বিএনপির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি-দখলদারির অভিযোগ উঠেছে। জিজ্ঞাসায় জানা গেছে, বিএনপির কেউই নাকি কোনোকিছু দখলে নেয়নি, চাঁদাবাজিও করেনি। বরং দখল আর চাঁদাই বিএনপির বাড়ি বাড়ি পৌঁছে গেছে। কী আজব কথা! সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকও একই সুরে বলেছিলেন ‘ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়নি বরং নিজ থেকেই তা এমনি এমনি বন্ধ হয়ে গেছে।’ এতে কী বোঝা গেল? বোঝা গেলো, লাউ আর কদু শুধু নামেই ভিন্ন, মূলে এক। ভুলে গেলে চলবে না যে, সময়ের দাবিতে এবার ভিন্ন কিছু হাতছানি দিচ্ছে। সুতরাং বিএনপির শুভাকাক্সক্ষীরা মনে করেন, হাইকমান্ড আন্তরিকতার সাথে সতর্ক না হলে সময় তাদেরকেও ছাড় দেবে না। 

আমি একজন শিক্ষক। শিক্ষকতা আমার পেশা। এটাকে খুব গর্বের সাথেই আমি এনজয় করি। তবে মাঝেমধ্যে হতাশ হই, শরমে মুখ লুকাই। কারণ, যখন দেখি স্কুল-কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শিক্ষকোচিত আচরণের চাইতে রাজনৈতিক কর্মীর আচরণেই বেশি আগ্রহী। এমনটা তো কারোরই কাম্য হতে পারে না। যদিও আদর্শহীন রাজনৈতিক পরিবেশ তাদের এমন নিচে নামতে সহায়তা করেছে। বিষয়টা তাই ছাত্রদেরও বিবেচনায় নিতে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ছাত্রদের কাছে শিক্ষক শিক্ষকই। তাঁরা পুজনীয় এবং নমস্য। সুতরাং অনিয়ন্ত্রিত আবেগের বশবর্তী হয়ে শারীরিক হেনেস্তাসহ তাঁদেরকে জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করা খুবই অন্যায় এবং দৃষ্টিকটু। অপরাধ করে থাকলে নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই ব্যবস্থা নিতে হবে। ভেবে দেখো তো, তোমাদেরই শত শত ছাত্রবন্ধুর আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই গৌরবময় ইতিহাসকে এভাবে ছোট-খাটো ভুলের কালিমায় কলংকিত করা কি সমীচীন হচ্ছে? একজন শিক্ষক হিসেবে এই প্রশ্নটুকু তোমাদের কাছে রেখে গেলাম। 

পরিশেষে নেলসন ম্যান্ডেলার একটি লেখা উদ্ধৃত করে শেষ করতে চাই। তিনি কারামুক্তির পরের ভাবনা জানাতে গিয়ে লিখেছেন, ‘কারাকক্ষ থেকে বেরিয়ে আমি যখন তোরণের দিকে মুক্তির পথে এগোচ্ছিলাম, তখনই জানতাম তিক্ততা ও ঘৃণা যদি পেছনে ফেলে না যাই, তবে আমি কারাবন্দিই থেকে যাব।’ এ কথার মানে কী? মানে হলো, প্রকৃত বিজয়ী তিনিই, যিনি অন্তরের দিক থেকেও বিজয়ী। ভেতর-বাইরের স্বতঃস্ফূর্ত দ্বৈতমুক্তি ছাড়া মুক্তির প্রকৃত স্বাদ মেলে না। ম্যান্ডেলার রাজনৈতিক দর্শনের মুল কথাই হচ্ছে ---ক্ষমা, সমঝোতা ও ঔদার্য। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের রাজনীতিতে এসব গুণাবীির কোনো বালাই নেই। আমরা চাই, বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন ম্যান্ডেলার জš§ হোক। ক্ষমা, সমঝোতা, ঔদার্যের বারতা নিয়ে দেশ ও জাতির সেবা করুক। জাতি হিসেবে এক কাতারে দাঁড়াতে চাইলে রাজনীতিতে  ইতিবাচক মানসিক পরিবর্তন খুবই জরুরি। এই যে আমরা এতোদিনে এসেও স্বাধীনতার কথা বলছি, সেটা কীসের? একমাত্র ভৌগলিক স্বাধীনতা ছাড়া অন্যকোন নাগরিক স্বাধীনতা কি আমরা পেয়েছি? পাইনি। কেন পাইনি? কারণ আমরা একদল ক্ষমতায় এসে অন্যদলের ভোটার সমর্থকদের তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির নাগরিক বানানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত থাকি। নিকট অতীতে সেটা এতোটাই ভয়াবহ রূপ নিয়েছিলো যে, এবারের গণ-অভ্যুত্থানই তার ইতিহাস হয়ে সাক্ষ্য দেবে। আমরা চাই না, এমন গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট আবারও তৈরি হোক। আমরা চাই স্বতঃস্ফূর্ত গণতন্ত্র, চাই সত্যিকারের বৈষম্যমুক্ত সমাজ। বৈষম্যবিরোধী গণজাগরণের বাঁশিতে এবার সেই সুরই বাজছে। আমরাও সাগ্রহে কান পেতে আছি সেই সুরে মাতবো বলে।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট