Image description

একটি দেশের শিক্ষাই বলে দেবে; তার ভবিষ্যত্ ঠিকানা কোথায়। শিক্ষা একটি জাতিকে সভ্য করে আর সভ্য জাতি সমৃদ্ধির পথে দেশটিকে এগিয়ে নেয়। আফ্রিকার দেশগুলো হীরে আর স্বর্ণের মতো মহামূল্যবান খনিতে ভরা। তারপরও শিক্ষা আর সভ্যতার অভাবে বিশ্বে সবচেয়ে গরিব ও সমস্যাগ্রস্ত জীবনযাপন করে তারা। এমনকি সভ্যতা থেকে পিছিয়ে পড়া জাতি মনে করা হয় তাদেরকে। সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছেন, ‘তুমি আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি দেবো।’ শিক্ষিত মা গড়ার নেপথ্যের বড় নায়ক হলেন আদর্শবান শিক্ষকরা। যাদের শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছেন অসংখ্য জাতি গড়ার কারিগর অগণিত মা। এজন্য শিক্ষকদেরকে মর্যাদার সুমহান মর্যাদায় আসীন করা না হলে একটি শিক্ষিত দেশ গড়া সম্ভব নয়। অথচ আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত শিক্ষক সমাজ। শিক্ষা খাতে তাদের অবদানকে ন্যূনতম গুরুত্ব দেয়নি রাষ্ট্র। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মকাল থেকেই সময়ে সময়ে পদে পদে বঞ্চিত করা হচ্ছে দেশগড়ার কারিগর শিক্ষক সমাজকে। দীর্ঘকাল ধরে খুবই অসহায়ত্ব, নিরীহ ও মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। তাদের অবস্থা এখন, নোন আনতে পান্তা ফুরায়।

বিশ্বে বাংলাদেশি শিক্ষকদের বেতন: দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বেতন-ভাতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শিক্ষকরা বেশ পিছিয়ে। শুধু প্রধান শিক্ষকের পদ দ্বিতীয় শ্রেণির। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মধ্যে অনেকে জাতীয় বেতন স্কেলের শুধু মূল বেতন পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, সৌদি আরবসহ বেশ কিছু দেশের শিক্ষকরা অনেক বেশি বেতন পান। বাংলাদেশি টাকার হিসাবে তাদের মাসিক বেতন গড়ে আট লাখ থেকে ১২ লাখ টাকা, যা বাংলাদেশের একজন শিক্ষকের কয়েক বছরের বেতনের সমান।

এশিয়ায় শিক্ষকদের বেতন: এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশের মাধ্যমিক শিক্ষকদের বেতনের সঙ্গে তুলনা করে দেখা গেছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত কয়েকটি দেশ ছাড়া প্রায় সব দেশের শিক্ষকের বেতন বাংলাদেশের তুলনায় বেশি। বেতন কাঠামো বিবেচনায় এশিয়ার ৪৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৪তম।

দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষকদের বেতন: বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি তথ্যে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের প্রারম্ভিক মাসিক বেতন প্রায় ১৮ হাজার ৫০০ টাকা, ভারতে ৩৫ হাজার টাকা, পাকিস্তানে ৩০ হাজার টাকা, শ্রীলঙ্কায় ২৭ হাজার টাকা, নেপালে ৩৫ হাজার টাকা, ভুটানে ৩৩ হাজার টাকা ও মালদ্বীপে ৬৩ হাজার টাকা। অন্যদিকে মাধ্যমিকে বাংলাদেশের এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের প্রারম্ভিক বেতন ১২ হাজার ৫০০ টাকা, ভারতে ৪০ হাজার টাকা, পাকিস্তানে ৩০ হাজার টাকা, শ্রীলঙ্কায় ৩২ হাজার টাকা, নেপালে ৩৫ হাজার টাকা, ভুটানে ৩৯ হাজার টাকা ও মালদ্বীপে ৯০ হাজার টাকা।

ভারতীয় শিক্ষকদের বেতন: প্রতিবেশী দেশ ভারতের শিক্ষকরাও বাংলাদেশের শিক্ষকদের চেয়ে বেশি বেতন পান। দেশের সরকারি প্রাথমিক ও এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক শিক্ষকদের বেতন যেখানে সাড়ে ১২ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকায় শুরু, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষকদের বেতন শুরু হয় প্রায় ৩৫ হাজার টাকা থেকে। অবশ্য দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে শিক্ষকদের বেতন বেশি হলেও কয়েকটিতে জীবনযাত্রার ব্যয়ও অনেক বেশি। মালদ্বীপের শিক্ষকদের বেতন বাংলাদেশি টাকার অঙ্কে বেশি মনে হলেও সেখানে দ্রব্যমূল্য ও অন্যান্য খরচও অনেক বেশি।

বিগত আমলে যেমন ছিল শিক্ষকরা: বাংলাদেশ জন্মকাল থেকেই রাষ্ট্রীয় বঞ্চনার শিকার শিক্ষকরা। দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে উঠলেও অবহেলার সর্বোচ্চ পর্যায়ে শিক্ষকরা। ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড’ প্রবাদটি শুনিয়ে বার বার তাদের সাথে করা হয়েছে মিথ্যাচার ও প্রতারণা। ন্যূনতম দাবির জন্য মাসের পর মাস রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের বারান্দায় অবস্থান করেও পাননি যথাযথ ন্যায্য সম্মান ও অধিকার। মিথ্যা আশ্বাসের পাশাপাশি পেটুয়া পুলিশ বাহিনী দিয়ে সড়কে ফেলে পিটিয়ে আহত-নিহতের শিকার হয়েছেন নিরীহ শিক্ষক। বর্তমানে একজন পোশাক শ্রমিকের চেয়ে কম বেতনে নিজ বাড়ি থেকে শত শত মাইল দূরে শিক্ষকতা করা যে কত কঠিন বিষয়টি বিগত কোনো সরকার বোঝার সামান্যতম চেষ্টাও করেনি। শুধু তাই নয়, স্কুল-কলেজ, কারিগর ও মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় চরম বৈষম্যের জালে বেধে রাখা হয়েছে। সমাধানযোগ্য বিষয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে শিক্ষকদের মনোবল ভেঙে পরিকল্পিতভাবে অরাজকতার আধারে নিমজ্জিত করে রাখা হয়েছে সামগ্রিক শিক্ষা খাতকে।

অবহেলিত মাদ্রাসার শিক্ষকরা: এমনিতেই এমপিওভুক্ত পর্যায়ের সর্বস্তরের শিক্ষকরা চরম মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তন্মধ্যেমড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’-এর অবস্থায় রয়েছেন মাদ্রাসার শিক্ষকরা। দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানে যোগদানের সময়কাল থেকেই বেতনের সরকারি অংশ (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার) পান স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা। অন্যদিকে মাদ্রাসার শিক্ষকদেরকে তা দিচ্ছে না সরকার। এমপিও না হওয়া পর্যন্ত বিনা বেতনে চাকরি করতে হচ্ছে তাদের। এমনকি সম্প্রতি স্কুল-কলেজে ইএফটির মাধ্যমে বেতন শুরু করলেও মাদ্রাসায় এ নিয়ে কোনো আলোচনাই নেই। পাশাপাশি মাধ্যমিক স্কুল সরকারিকরণের দাবি জোরালো হলেও মাদ্রাসার বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এসব বিষয়ে বৈষম্য দূরীকরণের দাবি জানান ভুক্তভোগীরা। বাংলাদেশ মাদ্রাসা জেনারেল টিচার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি জহির উদ্দিন হাওলাদার বলেন, স্কুল-কলেজের এমপিও নীতিমালার সাথে সামঞ্জস্য রেখে মাদ্রাসার এমপিও নীতিমালা সংশোধন, সহকারী অধ্যাপক বা জ্যেষ্ঠ প্রভাষক পদে পদোন্নতি অনতিবিলম্বে কার্যকর করা ও সহকারী শিক্ষকদের উচ্চতর (৮ম) গ্রেড প্রদানসহ ইনক্রিমেন্ট বৈষম্য নিরসন করতে হবে। তিনি বলেন, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ এবং মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর পৃথক করায় পদে পদে শিক্ষক-কর্মচারীদের বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে। অধিদপ্তরের উদাসীনতায় আজও সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি বাস্তবায়ন হয়নি এবং ইনক্রিমেন্ট বৈষম্য নিরসন হয়নি। ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে সহকারী শিক্ষকদের ৮ম গ্রেড প্রদান করা হচ্ছে না।

নতুন বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে যেসব সংস্কার জরুরি: শিক্ষাবিদরা বলছেন, চাকরির শুরুর বেতন দেখলে মনে হয় শিক্ষকরা হচ্ছেন দেশের সবচেয়ে বঞ্চিত ও নিরীহ মানুষ। শিক্ষা হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় একটি খাত। কেননা একজন নতুন পোশাক শ্রমিকের বেতনেরও চেয়েও কম বেতন পান শিক্ষকরা। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, দেশে মাধ্যমিক স্কুলগুলোয় মোট শিক্ষক রয়েছেন ২ লাখ ৪৬ হাজার ৭৮৪ জন। তাদের মধ্যে সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক ১৩ হাজার ৯৮০ জন এবং বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক ২ লাখ ৩২ হাজার ৮০৪ জন। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) তথ্যানুযায়ী বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে ৮০ হাজার ৮০৬ জন এমপিওভুক্ত। একজন এমপিও শিক্ষক বাড়ি ভাড়া হিসেবে ১০০০ টাকা, চিকিত্সা ভাতা হিসেবে ৫০০ টাকা পান। সবমিলিয়ে মাধ্যমিকের একজন শিক্ষকের বেতন সাড়ে ১২ হাজার থেকে ১৩ হাজার টাকা। অনার্স-মাস্টার্স পাস করেও ১১তম গ্রেডে একজন মাধ্যমিক শিক্ষকের চাকরি শুরু হয়। অথচ মাস্টার্সের সনদকে অবমূল্যায়ন করে পদোন্নতির বিএডকে অপ্রয়োজনীয় সনদের মারপ্যাচে ১০ গ্রেড থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা উত্সব-ভাতা পান মূল বেতনের ২৫ শতাংশ। তবে স্কুলের কর্মচারীরা উত্সব-ভাতা পান মূল বেতনের ৫০ শতাংশ। এ ছাড়া তারা সরকারি কর্মচারীদের মতো বৈশাখী-ভাতা পান। তবে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যারা সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে যোগ দেন, তারা শুরুতেই দশম গ্রেডে ২৬ হাজার টাকা বেতন পান। এর বাইরে তারা সন্তানদের পড়ালেখার জন্য ভাতা পান। পূর্ণাঙ্গ উত্সব-ভাতাসহ নানা ধরনের সুবিধা পান। তবে সরকারি বা এমপিওভুক্ত উভয় ধরনের স্কুলেই শিক্ষকরা উচ্চতর গ্রেড বিএড সম্পন্ন হলে আলাদা ইনক্রিমেন্ট পান, তাদের বেতনও কিছুটা বাড়ে। কিন্তু সারা দেশে প্রায় ৩২ হাজার এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকলেও সেখানে মাধ্যমিক পর্যায়ের সরকারি স্কুলের সংখ্যা মাত্র ৭০০-র কাছাকাছি। একইভাবে কলেজ-মাদ্রাসায় প্রভাষক পদেও নানা বৈষম্যের জালে বন্দি শিক্ষকরা। ৯ম গ্রেডে চাকরি শুরু হলেও আট বছর ৭ম গ্রেডে উন্নীত হয়ে বেতন বাড়ে মাত্র ১ হাজার টাকা। একইভাবে প্রতিষ্ঠানে প্রভাষক কোটার সুযোগে আট বছর পরে অনেক শিক্ষক ৭ম গ্রেড ডিঙ্গিয়ে ৬ষ্ঠ গ্রেডে উন্নীত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে, যা প্রভাষক পদে বড় একটা বৈষম্য।

এমনকি স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসায় এনটিআরসিএ কর্তৃক শিক্ষক নিয়োগে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েও এমপিও হতে পারছেন না হবু শিক্ষকরা। ব্রিটিশ আমলের নিয়মে তাদেরকে এমপিও হতে গিয়ে ফাইলের মারপ্যাচে পড়ে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে অটো এমপিও প্রক্রিয়া চালুর জোর দাবি করা হলেও ঘুষ ও হয়রানির মধ্যে ঢেলে দিয়েছে সরকার। মোটাদাগে বলা যায়, শিক্ষা খাত এখনো ব্রিটিশ আমলের নিয়মে পরিচালিত হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে সমালোচিত হলেও কোনো সরকার তা কানে নিচ্ছে না। বর্তমান নতুন সরকার নানা খাতের সংস্কারে কমিটি গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করলেও শিক্ষা খাত সংস্কারের কোনো আলোচনাই করছে না। বিক্ষিপ্তভাবে নানা দাবি তুললে গবেষণা, অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ ছাড়াই কমিটি গঠন করে দিচ্ছে যা শিক্ষা খাতের সামগ্রিক সংস্কারকে অবহেলার নামান্তর। গোটা শিক্ষক সমাজ নতুন সরকারের প্রতি আশায় বুক বেধে আছে, দ্রুততম সময়ে শিক্ষক সুরক্ষা আইন গঠন করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ খাতকে ব্যাপক সংস্কারের আওতায় নিয়ে আসবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক এম তারিক আহসান বলেন, ‘শিক্ষার অবকাঠামোতে বরাদ্দ বাড়লেই কিন্তু গুণগত মানের উন্নয়ন হবে না। শিক্ষকদের ক্ষমতায়ন, মান-মর্যাদা ও বেতন, তিনটিই সম্মিলিতভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। আমরা যদি ভুটানের দিকে তাকাই, তারা চিকিত্সক ও শিক্ষকদের সবচেয়ে বেশি বেতন দেয়। কোরিয়া, হংকং, জাপানে শিক্ষকদের আলাদা বেতন কাঠামো। এর ফল কিন্তু তারা পাচ্ছে। আমাদেরও স্মার্ট বাংলাদেশ হতে হলে শিক্ষকদের মর্যাদা আরো বাড়াতে হবে।’ 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের অধ্যাপক ড. এম ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, শিক্ষকদের উন্নয়ন করতে না পারলে দেশের কোনো অগ্রযাত্রা টেকসই হবে না। শিক্ষকদের মনের মধ্যে যদি হীনম্মন্যতা থাকে তাহলে একটি দেশ এগিয়ে যাবে কীভাবে? শিক্ষকদের আত্মমর্যাদা, সম্মান, আত্মবিশ্বাস না থাকলে জাতি এগিয়ে যেতে পারবে না।

মানবকণ্ঠ/এসআরএস