সমতা, ন্যায্যতা ও উদার পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তিতে সম্পর্ক পুনর্গঠনের প্রত্যাশা
বিশ্বে রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে চীন। আবার যুক্তরাষ্ট্রের পরে বিশ্বে ২য় সর্বোচ্চ আমদানি করে চীন। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বিরোধী রাষ্ট্র চীন হওয়া সত্ত্বেও ভারত সবচেয়ে বেশি আমদানি করে চীন থেকে এবং যুক্তরাষ্ট্র একক দেশ হিসেবে চীনের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক। অর্থাৎ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ থাকা সত্ত্বেও দ্বিপাক্ষিক বানিজ্যের ধারা বজায় রেখেছে। এভাবে প্রতিটি রাষ্ট্রই অন্য কোন রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল।
বর্তমান বিশ্ব বিশেষায়নের এবং বিশ্বায়নের। মানুষের চাহিদা, প্রয়োজন অপরিসীম ও বৈচিত্র্যময়। এই অপরিসীম ও বৈচিত্র্যময় চাহিদা ও প্রয়োজনের জন্য সকল পণ্য ও সেবা উৎপাদন, বণ্টন কোন দেশের পক্ষে এককভাবে সম্ভব নয়। তাই প্রয়োজন হয় আমদানির। তেমনিভাবে চাহিদার অতিরিক্ত পণ্য ও সেবা রপ্তানি করে অর্জিত হয় বৈদেশিক মুদ্রা । বাংলাদেশে একজন মানুষের দিনের শুরু থেকে রাতে ঘুমানো পর্যন্ত যেসব পণ্য প্রয়োজন তার প্রায় সিংহভাগই আমদানি করতে হয়। আমাদের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য সহযোগী দেশ হলো চীন এবং পরেই রয়েছে ভারত। তবে বর্তমানে বাংলাদেশে বিনিয়োগে শীর্ষ দেশ যুক্তরাজ্য। অথচ ভারতের অধিকাংশ নাগরিকের কাছে বাংলাদেশ একটি ভারত নির্ভরশীল দেশ হিসেবে বিবেচ্য। এর বিশেষ কারণও আছে। কেননা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পুরো শাসনামলে ভারত নির্ভরশীলতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। দ্বিপাক্ষিক বানিজ্যেও ছিলো ভারসাম্যহীনতা ও ভারতের আধিপত্য। এ কারনে ভারতও তাকে দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টাই করেছে। ১৫ বছর ধরে চলা স্বৈরাচারী শাসনকে মজবুত ও দীর্ঘায়িত করতে ভারত সরকার যে নিরবচ্ছিন্ন সমর্থনে কাজ করে গেছে; সেটি ভারত সরকার কর্তৃক শেখ হাসিনা সরকারকে টিকিয়ে রাখতে বাইডেন প্রশাসনকে তদবিরে তা স্পষ্ট। যার ফলে ভারত বাংলাদেশকে ভারত নির্ভরশীল দেশ ভাবা শুরু করেছে।
কিন্তু তাদের আশায় গুড়েবালি দিয়ে ছাত্রজনতা গত ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনাকে দেশ ছাড়কে বাধ্য করে। ফলে হাসিনার ১৬ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করেন নোবেলজয়ী, আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ও সমর্থনপুষ্ট ড. মুহাম্মদ ইউনুস। এরপর থেকেই নতুনভাবে দেশ গঠন ও সংস্কারের স্বপ্ন দেখছে আপামর জনতা। এর ফলে ভারতের কপাল পুড়েছে, হারিয়েছে বন্ধুপ্রতিম হাসিনা সরকার। হয়েছে বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কের অবনতি। এমন অবস্থায় আরেক সংকট বাসা বেঁধেছে ভারতে। বর্তমানে সেভেন সিস্টার্স নিয়ে ভারতে তুমুল অস্থিরতা চলমান। মনিপুর ভারত থেকে আলাদা হওয়ার জন্য অনেকদিন ধরেই আন্দোলন চালিয়ে আসছে। বর্তমানে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৭ টি রাজ্যেই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। সম্প্রতি কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আলোচিত একটি সংবাদ- ভারতের অরুণাচল প্রদেশের সীমান্তের ভেতরে ঢুকে প্রায় ৬০ কি.মি. ভূমি চীন দখল করে নিয়েছে। ভারতের কয়েকটি অনলাইন সংবাদ মাধ্যমও এমন সংবাদ বেশ জোরেসোরে প্রকাশ করছে। বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিরণ রিজিজু`র বক্তাব্যের পর।
গত ৯ সেপ্টেম্বর তিনি বলেছেন, "ভারতের জমিতে ঢুকে যদি তারা তাদের ভূখণ্ড বলে লিখে রেখে যায়, তবে তা সত্যি হতে পারে না"। স্পষ্টত বলাই যায়, ভারত বেশ চাপেই আছে।
আমরা মূলত ভারতবিরোধী নই; বিরোধিতা রয়েছে বাংলাদেশের সাথে ভারতের যে অসম আচরণ, কর্তৃত্ববাদী মনোভাব এবং স্বার্থান্বেষী পররাষ্ট্রনীতির ওপর। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোর ওপর অতিমাত্রায় কর্তৃত্ববাদিতা, আধিপত্যবাদিতার ছড়ি ঘুরানোর জন্য তাদের সাথে সম্পর্কে এক ধরণের বিচ্ছেদ ভাব এবং টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশই ছিলো ভারতের একমাত্র অনুগত ও বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র। তবে ক্ষমতার পালাবদলে তা প্রত্যাখান করে ন্যায্যতার ভিত্তিতে সম্পর্কে ফিরে আসতে চায় বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যা ১৭ কোটি জনগনেরও দাবি।
এখন আলোচনা করা যাক বাংলাদশের সাথে ভারতের অমীমাংসিত কয়েকটি ইস্যু নিয়ে-
প্রথমত, বাংলাদেশে সীমান্ত হত্যা কোনভাবেই বন্ধ হচ্ছে না। কুড়িগ্রামের অনন্তপুর সীমান্তে ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ভোরে বিএসএফ-এর গুলিতে প্রাণ হারায় ১৫ বছর বয়সী ফেলানী খাতুন। যে হত্যাকাণ্ডের এখনও কোন বিচার হয়নি। এরমধ্যে গত ১ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলায় বিএসএফের গুলিতে নিহত হয় কিশোরী স্বর্ণা রানী দাস (১৪ বছর)। আবার শোক কাটতে না কাটতেই ৮ সেপ্টেম্বর রাতে ঠাকুরগাঁও'র বালিয়াডাঙ্গী সীমান্তে জয়ন্ত কুমার সিংহ নামে এক কিশোর নিহত ও দুজন আহত হয়। সীমান্তে ৫২ বছরে আনুমানিক ১৯৩০ জন বাংলাদেশি হত্যা করেছে, কিন্তু বিচার হয়নি একটিরও।
যদিও সীমান্ত হত্যা ভারতীয় ন্যায় সংহিতা (বিএনএস) আইনে কিংবা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। তবে আশার বানী হচ্ছে, বিগত সরকারের নতজানু আচরণ পরিহার করে বর্তমান সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, সীমান্তে বিজিবি আর পিঠ দেখাবে না এবং হত্যা বন্ধে কঠোর হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন। অপরদিকে সীমান্ত হত্যার প্রতিক্রিয়া বরাতে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, সীমান্ত হত্যা দুই দেশের ভালো সম্পর্কের পথে অন্তরায়।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ ও ভারতের ৫৪টি অভিন্ন নদীর মধ্যে তিস্তা (মোট দৈর্ঘ্য ৩১৫ কিলোমিটার) অন্যতম। তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের ইস্যুটি একটি অমীমাংসিত সমস্যা এবং দুই দেশের সম্পর্কের আলোচনায় তিস্তা একটি বৃহৎ বিষয়। কারণ ১৯৮৩ সালে স্বাক্ষরিত তিস্তা চুক্তি অনুসারে নদীর পানির ৩৬ শতাংশ পাবে বাংলাদেশ এবং ৩৯ শতাংশ পাবে ভারত, বাকি ২৫ শতাংশ নদী প্রবাহের জন্য ব্যবহৃত হবে। বাস্তবিক অর্থে মূল পানি প্রবাহের এক–তৃতীয়াংশ পানিও পাচ্ছে না ভাঁটিতে থাকা বাংলাদেশ। এরপর ২০১১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে চাইলেও পশ্চিমবঙ্গের আপত্তিতে সেটি আর আলোর মুখ দেখেনি। ২০১৯ সাল থেকে তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চীন আগ্রহ প্রকাশ করে আসলেও ভারত শিলিগুড়ি করিডরের ‘চিকেন নেক’ এবং উত্তর- পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা বিপজ্জনক হওয়ার আশঙ্কায় বাংলাদেশের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। ফলে এখন অব্দিও বাস্তবায়ন হয়নি বাংলাদেশ-চীনের তিস্তা প্রকল্প চুক্তি । যার ক্ষতি পোহাতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। অথচ চীনের অর্থায়নে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে নদীতে ১২ মাস পানি থাকবে এবং উত্তরাঞ্চলের তিস্তা পাড়ের মানুষ টেকসই সমাধানও পাবে।
তৃতীয়ত, ভারতের প্রতি এককেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতি। দেশের স্বাধীনতা , সার্বভৌমত্ব , রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা বজায় রাখাই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য । বাংলাদেশ সকল প্রকার সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, বর্ণবাদ ইত্যাদির বিপক্ষে এবং বিশ্বের সকল স্বাধীনতাকামী নির্যাতিত ও নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামের পক্ষে। শান্তিপূর্ণ সহবস্থানে থেকে যেকোন বিরোধের শান্তিপূর্ণ মীমাংসা এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। কিন্তু বিগত দিনগুলোতে বাংলাদেশের এ উদার ও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি নতজানু অবস্থানে ছিলো ভারতের প্রতি। বর্তমানে বাংলাদেশ স্বাধীন ও বহুমাত্রিক পররাষ্ট্রনীতি পুনঃস্থাপনের দিকে হাঁটছে।
পরস্পরের ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমিকতার প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধা , আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, সাম্য, পারস্পরিক সুবিধা ও শান্তিপূর্ণ সহবস্থান এই পঞ্চশীলনীতি মূলত ভারতের বিদেশনীতি। ভারত আঞ্চলিক সুপার পাওয়ার থেকে গ্লোবাল পাওয়ারে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। কিন্তু অতিমাত্রায় নিজের স্বার্থ , আভ্যন্তরীণ ও সার্বভৌমত্বের প্রতি অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। মালদ্বীপ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা , আফগানিস্তান ও সর্বশেষ বাংলাদেশ থেকে দেশটির সমর্থিত সরকারের পতন এবং এই দেশগুলোতে ভারত-বিদ্বেষী তীব্র মনোভাব ভেসে উঠেছে। সাউথ ব্লক ও আঞ্চলিক রাজনীতিতে ভারত অত্যন্ত শক্তিশালী ও মোড়লতা অর্জন করতে পারলেও বর্তমানে দেশটিকে স্ট্র্যাটেজিক্যাল প্যাশেন্ট বা কৌশলগত ধৈর্যের নীতি অনুসরণ করার বিষয়টি ভাবতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে চীন-ভারত প্রতিযোগিতায় ভারতকে টিকে থাকতে হলে আরো সহনশীল আচরণ করতে হবে। নিজের স্বার্থের পাশাপাশি প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোরও স্বার্থ বিবেচনাধীন নীতি গ্রহণ করা সময়ের উপযুক্ত দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ব্রিটিশ রাজনৈতিক লর্ড পালমারস্টন বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কেউ কারো চিরন্তন বন্ধু অথবা শত্রু নয়। তবে পররাষ্ট্রনীতির সাথে জাতীয় স্বার্থ ও লক্ষ্যের বিষয়টি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে দেখা যায় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে সহযোগিতা প্রচ্ছন্ন হলেও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারত অনেক বেশি সরব । হাসিনা সরকারের গত ১৫ বছরের শাসনকে ভারত নিজ স্বার্থে বাঁচিয়ে রাখতে গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারী, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, বিরোধী মত দমন ও বাকস্বাধীনতা রোধে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল এবং বাংলাদেশকে একনায়কতন্ত্রে প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে গেছে। ভারতের এই ধরনের নগ্ন হস্তক্ষেপ প্রত্যাখ্যান করেছে বাংলাদেশের জনগণ।
এছাড়াও পররাষ্ট্রনীতি স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা ও সাম্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠায় বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চোখে চোখ রেখে কথা বলার ইঙ্গিত প্রকাশ করেছে।
লেখক: কর্মকর্তা, জনতা ব্যাংক (পিএলসি)
মানবকণ্ঠ/এসআরএস
Comments