দেশের প্রধান কয়েকটি সমস্যার মধ্যে অন্যতম সমস্যা হলো দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। দুর্বল অর্থনীতির দেশে এক বড় সমস্যা। কিন্তু কোনোভাবেই বাজার নিয়ন্ত্রণে আসছে না। নিত্যপণ্যের অসহনীয় দামে ক্রেতারা দিশাহারা। বিগত সরকারের আমলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে সমালোচনা কম হয়নি। সরকার পতনের পর সাধারণ মানুষ অনেকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল কিন্তু যে লাউ সেই কদু। বাজারে পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে সরকার নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু কোনো ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। নিত্যপণ্যের বাজার পরিস্থিতি এবং সরবরাহ তদারকি ও পর্যালোচনার জন্য জেলা পর্যায়ে ‘বিশেষ টাস্কফোর্স’ও গঠন করেও কোন কাজে আসছে না।
জনগণ প্রত্যাশাও করেছিলেন- বাজার নিয়ন্ত্রণে আসবে। কিন্তু সেই আশার প্রদীপ জ্বলছে না। পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে সব উদ্যোগ। অন্তর্বর্তী সরকারের দুই মাস পার হলেও বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়নি। হঠাৎ বেড়ে গেছে মুরগির দাম। আলু, পেঁয়াজসহ প্রতিটি তরিতরকারির দাম সাধারণ ভোক্তার নাগালের বাইরে। চালের দামও ক্রমাগত বাড়ছে। এই অবস্থায় মানুষ রীতিমতো দিশাহারা। সরকার ১৯টি পণ্যে শুল্ক কমিয়েছে, কিন্তু শুল্ক কমানোর সুবিধা ভোক্তারা পাচ্ছে না।
জানা যায়, চিনির দাম কমাতে গত ৯ অক্টোবর অপরিশোধিত ও পরিশোধিত চিনির ওপর বিদ্যমান নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়। এতে আমদানি পর্যায়ে প্রতি কেজি অপরিশোধিত চিনির শুল্ক কর ১১ টাকা ১৮ পয়সা এবং পরিশোধিত চিনির শুল্ককর ১৪ টাকা ২৬ পয়সা কমার কথা। কিন্তু বাজারে আগের দামেই চিনি বিক্রি হচ্ছে। ভারত থেকে ডিম আমদানি করা হচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, আমদানি করা প্রতিটি ডিমে সর্বসাকুল্যে খরচ হচ্ছে সাত টাকার মতো। কিন্তু বাজারে প্রতিটি ডিমের দাম এখনো কমেনি।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, এক সপ্তাহে, অর্থাৎ ৭ থেকে ১৪ অক্টোবরের মধ্যে ১২টি নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। এ তালিকায় রয়েছে সয়াবিন তেল, পাম তেল, চালের কুঁড়ার তেল বা রাইস ব্র্যান অয়েল, আলু, ছোলা, পেঁয়াজ, রসুন, জিরা, দারুচিনি, ধনে, গরুর মাংস ও ডিম। ডিমের দাম নতুন করে বেড়েছে ডজনপ্রতি ১২ টাকা। দাম উঠেছে ডজনপ্রতি ১৮০-২০০ টাকায়। দর কমাতে বাজারে অভিযান শুরুর পর ডিম বিক্রিই বন্ধ রেখেছে কিছু কিছু আড়ত। এতে সরবরাহ সংকট তৈরি হয়েছে। অনেক বাজারে ডিমই পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে নিম্ন আয়সম্পন্ন মানুষ ছাড়াও মধ্যবিত্তরাও তাদের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। নিত্যপণ্যের বাজারে মানুষের হাঁসফাঁস অবস্থা। প্রায় দুই বছর ধরে ভোগ্যপণ্যের বাজারে বেসামাল পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম, আমদানিনির্ভরতা, বাজারে সিন্ডিকেট, মজুতদারির কারণে বেড়েই চলছে নিত্যপণ্যের দাম। যার ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে সাধারণ মানুষের ওপর। ফলে বাড়ছে জনদুর্ভোগ। সর্বোপরি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি জনজীবনে বয়ে আনছে অমানিশার ঘোর অন্ধকার। জনসাধারণের স্বস্তির জায়গা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। টিসিবির হিসাবে, এক সপ্তাহে মসুর ডাল, মুগ ডাল, আদা, এলাচি, খাসির মাংস, দেশি মুরগি ও চিনি এ সাতটি নিত্যপণ্যের দাম কিছুটা কমেছে। এসব পণ্যের দাম আগেই অনেক চড়া ছিল। ফলে সামান্য কমলেও তাতে স্বস্তি ফেরেনি। সংশ্লিষ্টদের দাবি, ‘করপোরেট ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণেই’ বেড়েছে ডিমের দাম। প্রতিশ্রুতির দিনের তালিকায় দিন যোগ হয় কিন্তু পণ্যের দাম কমে না। আরও বাড়তি টাকা গুনতে হয় ভোক্তাদের। কিন্তু বাড়ছে না মানুষের আয়।
ফলে দরিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির, বিশেষ করে স্থির আয়ের মানুষের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। সরকার পরিবর্তনের ফলে মানুষের মধ্যে যে প্রত্যাশা জন্ম নিয়েছিল, ক্রমেই তা হতাশায় রূপ নিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এটি যদি সত্য হয় তাহলে ব্যর্থতা কাদের? বাজার কেন নিয়ন্ত্রণে আসছে না-এমন প্রশ্ন আরও জোরালো হচ্ছে। একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না- বাজার নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে ছাত্র-জনতার অর্জন অনেকটা ম্লান হয়ে যাবে। বিগত সরকার রাজনৈতিকভাবে যতটা শক্তিশালী ছিল-ঠিক ততটাই ব্যর্থ হয়েছে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে। আমাদের দেশের সমস্যা বহুমাত্রিক।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের মুদ্রানীতি, সিস্টেম পলিসি, সুদনীতি, বিদেশি মুদ্রার ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য পলিসি জড়িত। আমাদের প্রত্যাশা বিগত সরকার যা ১৬ বছরে পারেননি সেই কঠিন কাজটি এ যুগের তরুণদের দ্বারা অসম্ভব নয়। জনগণের কাছে এখন তারা আস্থার প্রতীক। সবকিছু বিবেচনা করে বাজার সিন্ডিকেট ভাঙাসহ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই। আমরা মনে করি, বাজারে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে গঠিত টাস্কফোর্স, ভোক্তা অধিকার, প্রতিযোগিতা কমিশন, ট্যারিফ কমিশন-প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে। ভোক্তার স্বার্থ দেখার দায়িত্ব সরকারের। বস্তুত অসাধু ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে সব ধরনের নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির করে তোলে। বাজারে সরকারের হস্তক্ষেপ আরো বাড়াতে হবে। বাজারে যারা কারসাজি করে তাদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনা জরুরি।
Comments