Image description

জুলাই-আগস্ট ২০২৪ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার প্রধান শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিলে আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের অপশাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে। দেশের মানুষ নতুন করে আশায় বুক বাঁধে। বিগত বছরগুলোতে শিক্ষা খাতে যে অরাজকতা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ, শিক্ষার হার বাড়ানোর অসম প্রতিযোগিতায় শতভাগ পাস দেখানো, অটোপাস, গেস্টরুম কালচার, র‌্যাগ কালচার, টর্চার সেলের পাশাপাশি আমলা, রাজনীতিবীদ ও সুযোগ সন্ধানীদের ভুয়া ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনসহ অনেক অজানা কারণে শিক্ষা খাতকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। 

সেই শিক্ষা খাতকে নিয়ে যারা স্বপ্ন দেখতো কিন্তু নিরুপায় হয়ে নীরব দর্শকের মতো চেয়ে থাকত আর নীরবে নিজের বিবেকটাকে ধিক্কার দিতো, তারা আশায় বুক বাঁধতে শুরু করেছে ধ্বংস প্রাপ্ত শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর। যেহেতু সরকার পতনের মুখ্য ভূমিকায় ছিল আমাদের ছাত্র বা শিক্ষার্থীরা। তাই শিক্ষা খাতকে নিয়ে একটু বেশি আশা ছিল শিক্ষাবিদদের। 

সেই সাথে গত ১৬ আগস্ট ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং শিক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান। আমাদের মতো মানুষদের মনটা ভরে গিয়েছিল আশায়। কিন্তু গত সেপ্টেম্বর মাসের ১১ তারিখে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে সংস্কারের জন্য ৬টি কমিশন গঠনের ঘোষণা করলেও শিক্ষা সংস্কারের জন্য কোনো কমিশনের ঘোষণা না থাকায় শিক্ষানুরাগীরা খুব ব্যথিত হয়েছেন। অনেকের সাথেই ব্যক্তিগত কথা হয়েছে। 

তারা জানিয়েছেন, সুযোগ সব সময় আসে না। দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য তথা বৈষম্যদূরীকরণের জন্য ছাত্রদের যে আত্মত্যাগ সেটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। খুব দ্রুত শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভঙ্গুর শিক্ষা ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে হবে।

জাতিকে ৫ম শিল্প বিপ্লবের উপযোগী মানব সম্পদ তৈরির সুব্যবস্থা করতে না পারলে আমাদের বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। যা পুষিয়ে ওঠা খুব কঠিন হবে। কিন্তু পরে জানানো হলো পর্যায়ক্রমে আরোও কমিশন গঠন করা হবে। একটু স্বস্তি পাওয়া গেল। কিন্তু গত ১৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ এক অফিস আদেশে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক প্রণীত ও মুদ্রিত পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনের লক্ষ্যে ১০ সদস্যের সমন্বয় কমিটি গঠন করে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে গত ২৮ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের এক অফিস আদেশে পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনের লক্ষ্যে গঠিত কমিটি বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। এতে হতাশ হয়ে পরেছে শিক্ষানুরাগীরা।

আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার মূল নিহিত রয়েছে ব্রিটিশ শাসনামলে। তারপর পাকিস্তান আমল হয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর হতে এ পর্যন্ত মোট ৭টি শিক্ষা কমিশন গঠন হয়েছে। তার মধ্যে ১৯৭৪ সালে ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনই ছিল সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য। বাকি সবগুলো নিয়ে রয়েছে ব্যাপক সমালোচনা। 

তবে সম্ভবত সবচেয়ে গোপনীয়, রাজনৈতিক ও দলীয় প্রভাব ছিল ২০১০ সালের শিক্ষা কমিশন নিয়ে। যেখানে পছন্দের কয়েকজন ব্যক্তি ছাড়া প্রকৃত শিক্ষাবিদরা তাদের মতামত ব্যক্ত করতে পারেন নাই। অভিভাবক, শিক্ষার্থীসহ অংশীজনদের অংশগ্রহণ বা মতামতের কোন মূল্য ছিল না। এমনকি শিক্ষা নীতি-২০১০ এর উপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের একটা সেমিনার পর্যন্ত করতে দেয়নি তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। 

তবে বর্তমান শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ প্রথমেই বর্তমান শিক্ষানীতিকে স্থগিত করেছেন। শিক্ষার্থীদের বার্ষিক মূল্যায়ন পদ্ধতি বাতিল করেছেন। এতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাঝে একটা সাময়িক স্বস্তি ফিরেছে। তবে এটা সত্য একটা দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য অবশ্যই যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রয়োজন। সেটা আমরা কোনোভাবেই তৈরি এবং বাস্তবায়ন করতে পারছি না। এটা আমাদের বিরাট বড় ব্যর্থতা। 

একটা সুষ্ঠু, সুন্দর সময়োপযোগী শিক্ষানীতিই একটা জাতিকে সঠিক দিকনির্দেশনা দেখাতে পারে। এখন সেই সময় এসেছে। বাংলাদেশ আগামী ৫০ বছর কোনো নোবেলজয়ী ব্যক্তিকে সরকার প্রধান পাবে কিনা জানি না। কিন্ত বর্তমানে আমরা সেটা পেয়েছি। আমাদের এই সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সকল শিক্ষানুরাগীদের প্রাণের দাবি। 

উপযুক্ত ব্যক্তিদের নিয়ে দ্রুত একটা শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করা হোক। যে কমিশন জাতিকে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদানের জন্য প্রয়োজনে সকল রাজনৈতিক দল, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, দাতা প্রতিষ্ঠান এবং দেশের  ভেতর ও বাইরের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গবেষকদের মতামতের ভিত্তিতে অধিক গ্রহণযোগ্য একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করবে।

যে শিক্ষানীতিতে আমাদের শিক্ষা বৈষম্য দূর হবে, শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করা হবে। শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়াতে হবে না, নোট বুক, গাইড বুক নিয়ে কোনো কমিশনের ব্যবসার বলি হবে না কোনো শিক্ষার্থী। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে র‌্যাগের নামে লাঞ্ছিত হবে না কোনো শিক্ষার্থী। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরবে না কোনো শিক্ষার্থী। ফিরে আসবে সমাজে শিক্ষকদের সর্বোচ্চ মর্যাদা। জাতি বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে বলতে পারবে আমরা পেরেছি।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট