Image description

পৃথিবীতে সবচেয়ে আলোচিত ও আগ্রহের বিষয় হচ্ছে রাজনীতি। সম্প্রতি সময়ে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রাজনীতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তারমধ্যে রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক এই নিয়ে আলাপ হচ্ছে। রাজনীতি বিজ্ঞানের জনক এরিস্টটলের মতে, ‘মানুষ সামাজিক ও  রাজনৈতিক জীব’। এটা সহজেই বুঝা যায় যে মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতির মধ্যে রাজনীতি রয়েছে। আবার মানুষের যেসব প্রবৃত্তি আছে ক্ষমতা অর্জন করা তার মধ্যে অন্যতম। তাই কম বেশি সবাই ক্ষমতার পূজারী। আর ক্ষমতার মূল চাবিকাঠি হচ্ছে রাজনীতি। তাই সবারই কম-বেশি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করার ইচ্ছা থাকে। অনেক রাজনৈতিক পরিবার থেকে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ দেখা যায়। সেই হিসাবে আমাদের এশিয়ায় পাশাপাশি বিশ্বে বংশ-পরম্পরায় রাজনীতিতে যোগদান করেছে এমন নজির ভূরি ভূরি। 

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বংশ-পরম্পরায় রাজনীতিতে প্রবেশ করা নীতি প্রণয়নের চালক হওয়া দেশ ও জনগণের জন্য মঙ্গলজনক কি না? আর তাদের প্রবেশ কতটা যুক্তিশীল? এসব প্রশ্নের উত্তর কেউ খুঁজে, কেউ না খুঁজে রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র মেনে নিতে চায় না। এটা নেতিবাচকভাবে দেখে। কিন্তু এটা কি আদৌ পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য? উত্তর হবে, না। পৃথিবীর প্রায় সব দেশে পরিবারতন্ত্র আছে, আমেরিকার বুশ পরিবারে জর্জ বুশ সিনিয়র ও জর্জ বুশ জুনিয়র দুজনেই আমেরিকার সর্বোচ্চ পদ তথা রাষ্ট্রপতির পদ অলংকরণ করেছিল। এছাড়াও বিল ক্লিনটন যুক্তরাষ্ট্রে দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তার স্ত্রী হিলারি ক্লিনটন নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্য থেকে নির্বাচিত সিনেটর ছিলেন। আর ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। এগুলোর বাইরে মার্কিন রাজনীতিতে কেনেডি পরিবারের রয়েছে প্রভাব। কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর পিতা পিয়ার ট্রু–ডোও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ইন্দোনেশিয়ার রাজনীতিতে ইন্দোনেশিয়ার জনক সুকার্ণো ও তার মেয়ে মেঘবতী প্রভাব বিস্তার করেন। মিয়ানমারের অং সান পরিবার, ফিলিপাইনের মার্কোস পরিবার, শ্রীলঙ্কার বন্দের নায়েক পরিবার ও উত্তর কোরিয়ার কিম পরিবার ইত্যাদি। পরিবারতন্ত্রের পথিকৃৎ হিসাবে পরচিত ভারতের কংগ্রেসের গান্ধী পরিবার। 

জওহর লাল নেহেরু ছিলেন ভারতের সাবেক সফল প্রধানমন্ত্রী ও কংগ্রেস সভাপতি। তার বাবা মতিলাল নেহেরু ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম সারির  নেতা। মেয়ে ইন্ধিরা গান্ধী কংগ্রেসের সভাপতি ও পরবর্তীতে ভারতের ৪ মেয়াদের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ইন্ধিরা গান্ধীর  মৃত্যুর পর ছেলে রাজীব গান্ধী দেশটির প্রধানমন্ত্রী হয়েছিল। রাজিব গান্ধীর মৃত্যুর পর রাজনীতিতে আসেন তার স্ত্রী সোনিয়া গান্ধী। সোনিয়া গান্ধী ১৯৯৮ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। তিনি সভাপতির পদ থেকে সরে যাওয়ার পর তার ছেলে রাহুল গান্ধী কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। যদিও তিনি ২০১৯ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের দায় নিয়ে সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। বর্তমানে কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন রাজীব ও সোনিয়া গান্ধীর মেয়ে প্রিয়াঙ্কা ভদ্র গান্ধী। 

এছাড়াও ভারতের উল্লেখ্যযোগ্য রাজনৈতিক ক্ষমতাবান পরিবারের মধ্যে রয়েছে হরিয়ানার দেবীলাল পরিবার, মহারাষ্ট্রের ঠাকরে ও পাওয়ার পরিবার, পাঞ্জাবের বাদল পরিবার, তামিলনাড়ুর করুণানিধি পরিবার, উত্তর প্রদেশে মুলায়াম সিং যাদব পরিবার, উড়িষ্যার পট্টনায়েক পরিবার, বিহারের লালু পরিবার এবং মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়া পরিবার। পাকিস্তানের  রাজনীতিতেও দীর্ঘকাল ধরে ভুট্টো ও শরিফ পরিবার মূল চালিকা শক্তির ভ‚মিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বাধীনতার পর থেকে ক্ষমতা ঘুরে-ফিরে শেখ, জিয়া ও এরশাদ এই তিন পরিবারের হাতে স্থায়ী হয়ে আছে। মূল ক্ষমতার বাইরেও আরও অনেক মন্ত্রীর, এমপি ও প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের পরিবার থেকে অনেক রাজনীতিবিদের আগমন হয়েছে ও হচ্ছে। 

বিশ্লেষকদের মতে, রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র দোষের কিছু নয় যদি না তারা উড়ে এসে জুড়ে না বসে। যদি রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অর্জন ও গণতান্ত্রিক বা নিয়মের মধ্য দিয়ে আসে তা কোনো মতেই নিন্দনীয় নয়। বিশ্বের ইতিহাসে পরিবারতন্ত্রের রাজনীতিতে সফলতার অধ্যায় যেমন আছে ঠিক তেমনি আছে ব্যর্থতার চিত্র। ইন্ধিরা গান্ধী ও জাস্টিন ট্র–ডোর মতো সফল রাজনীতিবিদ যেমন আছে। তেমনি পরিবারতন্ত্রের নেতিবাচক প্রভাবে অনেক দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমনও আছে। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার নাজুক অবস্থার জন্য অনেকেই পরিবারতন্ত্র কে দায়ী মনে করছে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই বর্তমান যারা পরিবারতন্ত্র থেকে উঠে আসছে পূর্বপুরুষ রাজনীতিবিদের মতো করে রাজনৈতিক দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ দেখাতে পারতেছে না। 

তাছাড়া, মাঠ পর্যায়ের রাজনীতি বুঝে উঠতে পারে না। এজন্য তাঁদের কে ঘিরে অনেক স্বার্থপর মানুষ তাঁদের স্বার্থ আদায় করতে সুবিধা লুটে নিচ্ছে। সেই সাথে দক্ষ ও যোগ্যতা সম্পর্ণ ও ত্যাগী রাজনীতিবীদরা অবহেলার স্বীকার হচ্ছে। অন্য দিকে নীতি প্রণয়নে ব্যবসায়ী ও এলিট শ্রেণির হাতে আবদ্ধ হয়ে যায় পুরো দেশের রাজনীতি। তাই বলা যায় যে, রাজনীতিতে কে কোন পরিবার থেকে উঠে আসছে সেটা বড় কথা নই বরং গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তারা কোন প্রক্রিয়ায় রাজনীতিতে এসেছে ও তাদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা ও দক্ষতা কতটুকু। যোগ্যতাবিহীন রাজনীতিবিদ যেই পরিবার থেকে উঠে আসুক না কেন। তাদের থেকে ইতিবাচক কিছু কি আশা করা যায় না। তারা হয়তো নেতা হবে জননেতা নই। সঠিক নেতৃত্ব কি তারা দিতে পারবে? তাদের মাধ্যমে অমঙ্গল বৈ মঙ্গল আসবে না। আর যোগ্য নেতৃত্ব রাজনীতি পরিবার থেকে আসুক কিংবা অন্য কোন পরিবার থেকে তিনি দেশ কে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। যোগ্য নেতৃত্ব ও রাজনীতিবিদ ছাড়া দেশকে এগিয়ে নেয়া প্রায় অসম্ভব। তাই সঠিক প্রক্রিয়ার মধ্যে আসলে পরিবারতন্ত্র অভিশাপ হওয়ার কোনো কারণ নেই। অন্যথায় পরিবারতন্ত্র অভিশাপ হয়ে উঠবেই। 

লেখক: শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়