পারিপার্শ্বিক পরিবেশের প্রভাব ও জিনগত বৈশিষ্ট্যের প্রভাব এ দুটির মিথস্ক্রিয়া দ্বারা ব্যক্তির আচরণিক বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রিত হয়। তবে ব্যক্তির আচরণের উপর জিনগত বৈশিষ্ট্যের প্রভাব পারিপার্শ্বিক পরিবেশের প্রভাবের তুলনায় প্রচ্ছন্ন। এমনকি দীর্ঘ দিনের একই পরিবেশগত প্রভাব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে জিনগত বৈশিষ্ট্যে স্থায়ী পরিবর্তন আসে যা বংশ পরম্পরায় আরো প্রকট হয়ে উঠে। অর্থাৎ পরিবেশগত প্রভাব নেতিবাচক হলে জিনগত বৈশিষ্ট্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, আর পরিবেশগত প্রভাব ইতিবাচক হলে জিনগত বৈশিষ্ট্যে ইতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
আর এভাবেই ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী এই জিনের প্রভাবে একটি মানুষ ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক আচরণ প্রকাশ করে থাকে। আমাদের দেশে জনসংখ্যার অধিক ঘনত্বের ফলে সম্পদের ক্রমহ্রাসমান প্রাপ্যতা, মানুষের চাহিদার তুলনায় প্রাপ্তির বিস্তর ফারাক ও সামাজিক প্রতিপত্তির ভারসাম্যহীনতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে সমাজে টিকে থাকার জন্য মানুষকে জন্ম থেকেই প্রতিনিয়ত পারস্পরিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে হয়। এই প্রতিযোগিতায় জয় লাভ করে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছা সুদূর পরাহত মনে হয় বলে ব্যক্তি হতাশার সাগরে নিমজ্জিত হয়। আর এই হতাশা থেকেই মনোবৃত্তিতে অপরাধ প্রবণতা জাগ্রত হতে থাকে। এমনকি প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে বা জয় লাভ করতে মানুষ অন্যের পথ রুদ্ধ করে এগুতে চায়, এতে মানুষ সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের তোয়াক্কা না করেই নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে।
পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কিংবা বংশানুক্রমিক এই নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যের কারণে মানুষের বিবেকবোধ সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের বিপক্ষে চলে যাচ্ছে। আর নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন মানুষের আধিক্য ও তাদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের ফলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র দিন দিন বিশৃঙ্খল হয়ে উঠছে। লক্ষ্য করে দেখবেন প্রতিটি ব্যক্তির পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু বান্ধবের মধ্যে ইতিবাচক আচরণ দিন দিন কমে আসছে, অনেকের ক্ষেত্রে ইতিবাচক আচরণ নেই বললেই চলে। ব্যক্তি নিজে কতটা ইতিবাচক তা তার কাছে বোধগম্য নয়। ব্যক্তির মনের অজান্তেই সে দিন দিন নেতিবাচক হয়ে উঠছে।
আর এসব নেতিবাচক মানুষ দ্বারা পরিচালিত হয়ে পুরো সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাই নেতিবাচক হয়ে উঠেছে। ইলেক্ট্রনিকস কিংবা প্রিন্ট মিডিয়াতে সিংগভাগই নেতিবাচক ঘটনা প্রবাহ নিয়ে আবর্তিত হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আজ মিথ্যা, গুজব ও রুচিহীনতায় ভরপুর। চতুর্পাশে এরকম অসঙ্গতিপূর্ণ পরিবেশ, রুচিহীনতা ও বীভৎসতা আপনাকে আর ইতিবাচক থাকতে দিচ্ছে না। এমনকি মানুষের মধ্যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান থাকায় অনেক অপরাধকে আর অপরাধই মনে হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে মানুষ মনুষ্যত্ব হারিয়ে নিষ্ঠুর ও হিংস্র হয়ে উঠছে। এই হিংস্র ও নিষ্ঠুরতার বিষবাষ্প সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ছে।
অর্থাৎ একটি নেতিবাচক কর্ম অন্য আরেকটি নেতিবাচক কর্মের জন্ম দিচ্ছে। আমি ছাত্র থাকাকালীন মেসে আমার সাথে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ুয়া একটি ছেলে থাকতো। কথায় কথায় একদিন সে বললো কুকুরের ফুটফুটে বাচ্চাকে ধরে আগুনে মুখ পোড়ালে বাচ্চাটির কিচিরমিচির নাকি তার খুব ভালো লাগে। তার এই বিকৃতমনা আচরণ নিশ্চয়ই জিনগত কারণে। এরকম হিংস্র, পাশবিক ও বিকৃতমনা মানুষ সমাজের স্তরে স্তরেই বিদ্যমান রয়েছে। আমি শিক্ষক থাকাকালীন সময়ে প্রতিষ্ঠানের জন্য কিছু নতুন চেয়ার কিনে আনা হয়। পরদিন সপ্তম শ্রেণির কিছু বাচ্চা স্টিলের স্কেল দিয়ে সবগুলো চেয়ারের রেক্সিনের কভারগুলো কেটে ক্ষতবিক্ষত করে রাখে। তাদের এমন কুৎসিত মনোবৃত্তিক আচরণ কেন? পারিপার্শ্বিক নেতিবাচক প্রভাবে কিংবা জিনগত বৈশিষ্ট্যের কারণে তাদের অন্তরে সৌন্দর্যবোধ ও বিনির্মাণের স্পৃহা জন্ম নেয়নি।
জীবনযুদ্ধে আরো কঠিন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলে তারা আরো নিস্পৃহ ও ভয়ংকর হয়ে উঠবে নিশ্চই। আমাদের দেশের প্রচলিত সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা মানুষের মনুষ্যত্বকে ইতিবাচক করে তোলার জন্য উপযোগী নয় বলে মনে হয়। সাম্প্রতিক সময়ে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বুয়েটের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও ছাত্ররা তাদের সহপাঠী আবরার ফাহাদের উপর যে পাশবিকতা চালিয়েছে এটিই তার প্রমাণ। আবরার হত্যার কঠোর এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তোফাজ্জলের উপর যে নিষ্ঠুর আচরণের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছে, তা প্রমাণ করে আমাদের দেশের আইন এবং আইনের প্রয়োগ পদ্ধতি এসব নৃশংস আচরণকে দমাতে কোনো প্রভাব ফেলে না।
সম্প্রতি বায়তুল মোকাররম মসজিদের ভেতর আধিপত্যবাদ নিয়ে মৌলভী সাহেবগণ যে বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি করেছিলেন, তা মুসলিম জাতিকে লজ্জায় ফেলেছে। ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া সত্তে¡ও ন্যায়পরায়ণতা তাদের অন্তর স্পর্শ করেনি। এক্ষেত্রে ধর্মীয় শিক্ষার প্রভাব পারিপার্শ্বিক নেতিবাচক প্রভাবের তুলনায় খুবই প্রচ্ছন্ন মনে হয়েছে। সমাজে এরকম বর্বরোচিত আচরণ, নৃশংসতা, নির্মমতা ও হীন স্বার্থ কায়েমের দ্ব›দ্ব বেড়েই চলছে। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ ও আইনের প্রয়োগ সবকিছুকে উপেক্ষা করে এ সমস্ত বর্বর আচরণ নেতিবাচক পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত এবং পরিচালিত হচ্ছে। আর এই নেতিবাচক আচরণ দমাতে হলে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে রাষ্ট্রকে জোরালো ভ‚মিকা নিতে হবে।
পারিপার্শ্বিক পরিবেশ যত বেশি ইতিবাচক করে তোলা যাবে ব্যক্তির নেতিবাচক আচরণ ততই কমে আসবে। সম্পদের সুষম বণ্টন, চাহিদা ও প্রাপ্তির মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, সমাজে বা রাষ্ট্রে ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা, চাহিদা পূরণ সহজীকরণ ও সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে না পারলে সমাজে স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও অসম প্রতিযোগিতা দূর হবে না। ফলে সুস্থির ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ে তোলা দুরূহ হবে। স্বাধীনতার পর এই চুয়ান্ন বছরে শুধু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অভ্যুত্থানের জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দল, গোষ্ঠী ও শ্রেণির বহু মানুষের রক্ত ঝরাতে হয়েছে।
কেবল ক্ষমতার পালাবদলে স্থিতিশীল একটা ব্যবস্থাই আজো প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি আমরা। ফলে সমতা ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আমরা একদমই সময় পাইনি। এখন আমরা বহুমুখী সমস্যার জালে আটকে আছি। সমতা ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে বিপ্লব সাধন করতে হবে। আর এই বৈপ্লবিক সংগ্রামে আমাদের সবাইকে শামিল হতে হবে। এবারের রাষ্ট্র সংস্কার কার্যক্রমকে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ধারায় রূপান্তরিত করতে পারলে সমতা ও ন্যায়ভিত্তিক ইতিবাচক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। এতে প্রতিষ্ঠিত হবে সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব। আর রাষ্ট্রের নাগরিকগণ হয়ে উঠবে ইতিবাচক।
লেখক: সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার, সোনালী ব্যাংক পিএলসি
Comments