অবশেষে সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে দীর্ঘ ২২ বছর পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রকাশ্যে পলিথিন নিষিদ্ধের কার্যকারিতার বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে আজ ১ নভেম্বর শুক্রবার থেকে। বাজার থেকে উঠিয়ে নেয়া হচ্ছে পলিথিন। বিকল্প হিসেবে পাটের তৈরি ব্যাগ ব্যবহারের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু সেখানেও নানা সংকটের কথা আসছে। পলিথিন যেমন সহজলভ্য, পাটজাত পণ্য তেমন সহজলভ্য নয়। আবার ব্যবহারে জটিলতার কথাও বলছেন কেউ কেউ। এর বাইরে নতুন পণ্যে অভ্যস্ততার একটি বিষয় রয়েছে।
পরিবেশ উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান দায়িত্ব নেয়ার পর পলিথিন ব্যবহার বন্ধে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন। এরমধ্যে গত ১ অক্টোবর থেকে সুপারশপে পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় ১ নভেম্বর থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বাজারে পলিথিনের ব্যবহার। পলিথিন বন্ধের পর বিকল্প কি হতে পারে তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতামত দিয়েছেন সরকারের সংশ্লিষ্টমহল, পরিবেশবিদ, ব্যবসায়ী ও পলিথিন ব্যবহারকারী সাধারণ মানুষ ও প্লাস্টিক কারখানার মালিকরা।
পলিথিন বন্ধে এক ব্যবসায়ী বলেন, আমরা পলিথিন বন্ধের সিদ্ধান্তে খুশি। পলিথিনের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ হলে আমাদের ঝামেলা কমে যাবে। এখন ক্রেতারা বাজারের সময় ব্যাগ নিয়ে আসেন না। এতে প্রত্যেকটি জিনিসের জন্য আমাদের আলাদা পলিথিন ব্যবহার করতে হয়। এতে আমাদের খরচ বাড়ে। তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পলিথিন বন্ধের সিদ্ধান্তকে আমি সাধুবাদ জানাই। কিন্তু এর বিকল্প কী? বুধবার রাজধানীর হাতিরপুল কাঁচাবাজারের দোকানদার নিয়ামুল হকের কাছে ১ নভেম্বর থেকে পলিথিন রাখা যাবে না বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি মানবকণ্ঠকে এসব কথা বলেছেন।
তিনি আরও বলেছেন, ‘আমি বিষয়টি জানার পর থেকে নতুন করে পলিথিন ক্রয় করিনি। আগের যা ছিল তা দিয়েই চলছে। আজ থেকে ক্রেতাদের সঙ্গে করে ব্যাগ নিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। পাশাপাশি তিনিও দোকানে ব্যাগ না রাখার কথা জানিয়েছেন। এ সময় তার দোকানে বাজার করেছিলেন মো. জুয়েল। দোকানের কর্মচারী প্রত্যেকটি বাজারের বিনিময়ে একটি করে পলিথিন ব্যবহার করেছেন।
আজ শুক্রবার পলিথিন নিষিদ্ধ বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা নিঃসন্দেহে ভালো খবর। কিন্তু এর বাস্তবায়ন কতটা টেকসই হবে সেই বিষয়টি দেখার বিষয়। কারণ পলিথিন নিষিদ্ধ করে আইন হয়েছে ২০০২ সালে। কিন্তু সেই আইন আলোর মুখ দেখেনি। তাই আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন দৃশ্যমান হোক এটাই প্রত্যাশা আমাদের।
পলিথিন বন্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদেরকে প্রনোদনা দেয়ার দাবি জানিয়ে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, প্রায় ২২ বছর আগে ২০০২ সালে নিষিদ্ধ হয়েছিল পলিথিন। বিভিন্ন জনসচেতনার অভাবে তা বন্ধ করতে পারেনি। পলিথিন বন্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদেরকে প্রণোদনা দিতে হবে। বাজারে সোনালি কাপড়ের ব্যাগ তৈরি করতে হবে। তিনি বলেন, রাতারাতি সবকিছু পরিবর্তন করা যায় না। যেসব ব্যবসায়ীরা পলিথিন তৈরি করে আসছে তাদেরকে বিকল্প মোড়কের ব্যাগ তৈরিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে হবে। তিনি বলেন, মোট কথা হচ্ছে যারা দীর্ঘদিন এই পলিথিন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তাদেরকে সোনালি বা কাপড়ের ব্যাগ তৈরিতে কাজে লাগাতে হবে। তাহলে আমাদের এই উদ্যোগের সফলতা আসবে। এদিকে গত ৯ সেপ্টেম্বর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, ১ অক্টোবর থেকে সুপারশপে কোনো ধরনের পলিথিন বা পলিপ্রপিলিনের ব্যাগ রাখা যাবে না এবং ক্রেতাদের দেয়া যাবে না। বিকল্প হিসেবে সব সুপারশপে বা শপের সামনে পাট ও কাপড়ের ব্যাগ ক্রেতাদের জন্য রাখা হবে। আর আজ ১ নভেম্বর থেকে ঢাকার ১০টি কাঁচাবাজারে পলিথিন বন্ধে কার্যক্রম শুরু হবে। এছাড়াও দেশব্যাপী পলিথিন উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হবে। এদিকে সুপারশপে পলিথিন বন্ধে ব্যবস্থা নিতে দেশের সব বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশের ডিআইজি, পুলিশ কমিশনার, জেলা প্রশাসক এবং এসপিদের পলিথিন ও পলিপ্রোপাইলিন ব্যাগ বন্ধে নির্দেশনা দিয়েছেন উপদেষ্টা। এ সময় উপদেষ্টা পলিথিনের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে বলেন, প্লাস্টিক পলিথিনের অপ্রতিরোধ্য ব্যবহার পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি মাটির উর্বরতা কমিয়ে দিচ্ছে, নদী-নালা ও জলাশয় দূষিত করছে এবং জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এসব কারণে প্লাস্টিক পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার বন্ধে সব পর্যায়ে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।
নিষিদ্ধ পলিথিন বন্ধে অভিযান মনিটরিং কমিটি গঠন: মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের বিশেষ উদ্যোগে গৃহীত কর্মসূচি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে আছেন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও আইন অনুবিভাগ)। সদস্য হিসেবে থাকছেন যুগ্ম-সচিব (পরিবেশ-১ অধিশাখা), উপ-সচিব (পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ-১ ও ২) এবং সিনিয়র সহকারী সচিব (পরিবেশ-৩)। কমিটি ১ নভেম্বর থেকে দেশব্যাপী পরিচালিত পলিথিন বন্ধে অভিযানের মনিটরিং করবে। মাঠ পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা ও প্রয়োজনে মাঠ কার্যক্রম পরিদর্শন করবে। এছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তরও একটি আলাদা কমিটি গঠন করবে। অধিদপ্তরের কমিটি প্রতিদিন বিকাল ৫টার পর পরিচালিত অভিযানের তথ্য মন্ত্রণালয়ের কমিটিকে পাঠাবেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর প্রধান কারণ সহজলভ্যতা এবং ব্যবহারে সুবিধা। সাধারণত একটি চটের ব্যাগের দাম পড়ে ৫০ থেকে ৭০ টাকা। সেখানে ৫০ থেকে ৭০ পয়সার একটি পলিথিনে সমপরিমাণ পণ্য পরিবহন করা যায়। পলিথিন সিঙ্গেল ইউজ পণ্য। একবার ব্যবহার করেই মানুষ এটি ফেলে দেয়। এছাড়া দাম কম হওয়ায় বাজারে বিক্রেতাই পলিথিন সরবরাহ করে। অন্যদিকে বাজারে পাটের ব্যাগ ক্রেতাকে নিয়ে যেতে হয়। একটি ব্যাগ অন্তত ৮ থেকে ১০ বার ব্যবহার করা গেলেও এটি পরিবহন এবং সংরক্ষণের যে অভ্যস্ততা ৮০ বা ৯০-এর দশকে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছিল, তা ফিরিয়ে আনাই সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ। যদিও পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছেন পরিবেশ উপদেষ্টা। এজন্য পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে টানা বেশ কয়েকটি সভাও করেছেন তিনি। এরপর চলতি সপ্তাহের শুরুতে পলিথিনের বিকল্প পণ্য নিয়ে একটি মেলা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। এতে মূলত পাটজাত পণ্যের নানা ধরনের ব্যাগের প্রদর্শনী করা হয়। এ প্রদর্শনীতে অংশ নেয় গ্রিন আর্থ কটেজ।
প্রতিষ্ঠানটির সিইও ড. মো. তারেক হোসেইন জানান, পলিথিনের বিকল্প পাটের ব্যাগ দিতে হলে প্রতিদিন ৫০ লাখের মতো জুট ব্যাগ প্রয়োজন। যার কাঁচামাল এই মুহূর্তে কারো হাতে নেই। আসলে আমরা তো আগে থেকে জানতাম না এত দ্রুত এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করবে সরকার। এজন্য আমরা কাঁচামাল আনার চেষ্টা শুরু করেছি। পাশাপাশি উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টাও করছি।
পলিথিন নিষিদ্ধে ২০৩০ সাল পর্যন্ত সময় চান ব্যবসায়ীরা: জাতিসংঘের এনভায়রনমেন্ট অ্যাসেম্বলির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী ২০৩০ সাল পর্যন্ত একবার ব্যবহার্য পলিথিন ও প্লাস্টিক নিষিদ্ধে সময় চান ব্যবসায়ীরা। সম্প্রতি বাংলাদেশ প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ প্লাস্টিক প্যাকেজিং, রোল ম্যানুফ্যাকচারিং ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের ডাকা যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তারা এ দাবি জানান। এ সময় খাদ্য নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী আয়োডিনযুক্ত লবণ প্লাস্টিক ছাড়া মোড়কীকরণ সম্ভব নয় উল্লেখ করে সামিম আহমেদ বলেন, অন্য কোনো পণ্য দিয়ে মোড়কীকরণ করা হলে তার গুণগত মান থাকবে না। এছাড়া বর্তমান সরকার ভোজ্য তেলের সঙ্গে ভিটামিন এ যুক্ত করতে চায়, যা প্লাস্টিক কন্টেইনার ছাড়া সম্ভব নয়। তরল দুধ প্লাস্টিক প্যাকেজিং ছাড়া বাজারজাত সম্ভব নয়। কারণ ইউভি লাইট সুরক্ষা না থাকলে দুধ নষ্ট হয়ে যায়। ওষুধের গুণগত মান রক্ষায়ও প্লাস্টিক প্যাকেজিং ছাড়া কোনো বিকল্প নেই বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
সামিম আহমেদ বলেন, ইউএনইএ রেজ্যুলেশনে প্লাস্টিককে বর্তমান আধুনিক মানব সভ্যতায় তার ভূমিকা এবং অবদান লিপিবদ্ধ করেছেন এবং স্বীকৃতি দিয়েছেন। আইএনসি প্লাস্টিক দুষণ প্রতিরোধে চলমান আলোচনায়ও প্লাস্টিক বন্ধ করার কথা বলা হয়নি। ২০০২ সালের পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধের আইন বাস্তবায়নযোগ্য করার জন্য বিকল্প ব্যাগসমূহের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে নেয়ার ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেন সামিম আহমেদ। প্লাস্টিক বন্ধে অর্থনৈতিক প্রভাব কী হবে তা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, বিডা, এফবিসিসিআই এবং অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়ারও অনুরোধ জানান তিনি। এ সময় জাতিসংঘের ইনভায়রনমেন্ট এসেম্বলির একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০৩০ সাল পর্যন্ত পণ্যটি বন্ধে সময় নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান সামিম আহাম্মেদ। এছাড়া একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক ব্যবহারের তালিকায় এমন কিছু পণ্য আছে, যার সঙ্গে জড়িত লাখো লোকের কর্মসংস্থান উল্লেখ করে তিনি বলেন, ১৩ লাখ ক্ষুদ্র বিক্রেতার কর্মসংস্থানের সঙ্গে জড়িত। যেখান থেকে সরকারের কোষাগারে প্রতিবছর প্রায় ৪০,০০০ কোটি টাকা জমা হয় বলে তিনি জানান।
মানবকণ্ঠ/এসআরএস
Comments