কোথাও ঝুলছে তালা। পরিষ্কার, পরিচ্ছন্নতা ও সংস্কারের অভাবে কোনোটি আবার ব্যবহারের সম্পূর্ণ অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এমন চিত্র কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলা শহরের পাবলিক টয়লেটগুলোর। শহরটি কুমারখালী পৌরসভার হলবাজার-বাসস্ট্যান্ড-উপজেলা সড়ক, হলবাজার-কাজীপাড়া মোড় সড়ক এবং হলবাজার-পায়রামোড় সড়ক ঘেঁষে অবস্থিত।
শহরটিতে গার্মেন্টস, কসমেটিকস, মুদি, জুতা-স্যান্ডেল, সুতা, ফার্মেসি, ফল, কাঁচামালসহ হরেক রকমের ছোট বড় অন্তত তিন হাজার দোকান রয়েছে। এখানে প্রতিদিন অন্তত ৫০ হাজার নানা বয়সী মানুষের আনো গোনা হয়। তবে পাবলিক টয়লেট না থাকায় চরম ভোগান্তি ও বিড়ম্বনায় পড়তে হয় তাদের।
প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে পুরুষরা স্থানীয় মসজিদের টয়লেট ও উন্মুক্ত স্থানে মলমূত্র ত্যাগ করলেও নারীদের বেলায় সে সুযোগ নেই। ফলে তাদের কিডনিজনিত অসুখসহ নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আবার যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ করায় দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। বাড়ছে নানা রোগ বালাইয়ের ঝুঁকি। সেজন্য শহরে আগতরা দ্রুত স্বাস্থ্য সম্মত পাবলিক টয়লেটের ব্যবস্থা নিশ্চিতের দাবি জানান।
কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জন ডা. মো. আকুল উদ্দিন বলেন, সুস্থ থাকার জন্য সময়মতো মলমূত্র ত্যাগ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দীর্ঘক্ষণ মলমূত্র চেপে রাখলে গ্যাস্ট্রিক, কিডনি-লিভারের সমস্যাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পাবলিক টয়লেট স্থাপনের জন্য জনস্বার্থ প্রকৌশলী ও পৌর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করবেন বলে তিনি জানান।
জানা গেছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে কুমারখালী বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন হানিফ কাউন্টারের পিছনে একটি পাবলিক টয়লেট স্থাপন করে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অধিদপ্তর। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১১ লাখ টাকা। তবে টয়লেটটির ট্যাংকি আকারে ছোট হওয়ায় ব্যবহারের কয়েক মাসের মধ্যেই তা ভরে যায়। তবুও ব্যবহারের ফলে মলমূত্র আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে এবং পরিবেশ দূষিত হয়। ফলে এলাকাবাসীর নানা অভিযোগে টয়লেটটিতে ওই অর্থবছরেই তালা লাগিয়ে দেয় পৌর কর্তৃপক্ষ।
বৃহস্পতিবার (৭ নভেম্বর) দুপুরে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, পাবলিক টয়লেটের কেচিগেটে ঝুলছে তালা। আশপাশজুড়ে চলছে ব্যবসা বাণিজ্য।
এসময় স্থানীয় বাসিন্দা তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ট্যাংকি ছোট হওয়ায় টয়লেটটি চালুর কয়েকমাসের মধ্যেই তা ভরে যায়। সেসময় মলমূত্র আশপাশে ছড়িয়ে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছিল। তাই পৌরসভা ট্যাংকি সংস্কার না করেই তালা লাগিয়েছে। এতে মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই।
২০১৭ সাল থেকে ওই টয়লেটটির সামনে চায়ের দোকান বসিয়ে ব্যবসা করছেন আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, বাসস্ট্যান্ড এলাকায় একটি পাবলিক টয়লেট অতি জরুরি। প্রতিদিন কয়েকশ মানুষ এখানে এসে ফিরে যান। মলমূত্র ত্যাগের জন্য তারা এদিক সেদিক ছোটাছুটি করে বেড়ান। আর মেয়েদের কষ্টের কথা তো বলাই বাহুল্য।
একই অর্থবছরে সমপরিমাণ ব্যয়ে পৌরসভার কাজীপাড়া মোড় এবং শেরকান্দি এলাকার কাপুড়িয়া হাট এলাকায় একটি করে পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করা হয়। সেগুলোরও চাহিদার তুলনায় ট্যাংকি ছোট। ব্যবহারের কয়েকমাসের মধ্যেই তা পূর্ণ হয়ে আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে এবং পরিবেশ নষ্ট হয়। তাই কাজীপাড়া মোড়ের পাবলিক টয়লেটটিতেও তালা লাগানো হয়েছে। আর সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ অবস্থায় ব্যবহৃত হচ্ছে কাপুড়িয়া হাটের টয়লেটটি। সরেজমিন গিয়ে এমন চিত্র দেখা যায়।
কুমারখালী বণিক সমিতির সভাপতি কে আলম টম বলেন, বণিক সমিতিতে প্রায় ৩৫০টি দোকান রয়েছে। তারা পৌরসভাকে নিয়মিত ট্যাক্স (কর) প্রদান করে। তবে সমিতির আশপাশে একটি পাবলিক টয়লেটও নেই। প্রয়োজন মেটাতে ছেলেরা পাশের মসজিদে যায়। সেখানেও সিরিয়াল ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। আর মেয়েরা তো লজ্জা শরমে চেপে রাখে। তার ভাষ্য, পাবলিক টয়লেট না থাকায় মানুষের ভোগান্তি ও বিড়ম্বনার শেষ নেই। তিনি দ্রুত পর্যাপ্ত পরিমাণ পাবলিক টয়লেট স্থাপনের দাবি জানান।
উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও জুয়েলারি ব্যবসায়ী সাইদুর রহমান বলেন, শহরে অন্তত ছোট বড় তিন হাজার দোকান রয়েছে। নিত্যপ্রয়োজন মেটাতে বাজারে অন্তত ৫০ হাজার নানা বয়সী মানুষ ছুটে আসেন। এসব মানুষের মলমূত্র ত্যাগের জন্য দ্রুত পাবলিক টয়লেট স্থাপনের দাবি তার।
আরো জানা যায়, ২০১৮ সালে সোনাবন্ধু মার্কেটে আরও একটি পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। সেটিরও ট্যাংকি ছোট হওয়ায় পরিবেশ নষ্ট হচ্ছিল। সেখানকার ব্যবসায়ীদের এমন অভিযোগে টয়লেটটি স্থানান্তরের জন্য গতবছরের ডিসেম্বরে তা ভেঙে ফেলে পৌর কর্তৃপক্ষ। তবে ওই এলাকায় নতুন করে আর কোনো টয়লেট নির্মাণ না হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছেন ব্যবসায়ী ও ক্রেতারা।
এবিষয়ে সোনাবন্ধু সড়কের চা ও বেকারি ব্যবসায়ী প্রহলদার সেন বলেন, শৌচাগার নেই। মানুষ যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ করছে। এতে পরিবেশ আরো দূষিত হচ্ছে।
শহরে শৌচাগার না থাকায় বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগেই প্রস্তুতি নিতে হয় বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী। তিনি বলেন, এতবড় শহরে স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার না থাকাটা অত্যন্ত দুঃখজনক।
জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্মাণ ত্রুটির কারণে ট্যাংকির আকার ছোট হওয়ায় পাবলিক টয়লেটগুলো অকেজো রয়েছে বলে জানিয়েছেন কুমারখালী পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী মো. আকরামুজ্জামান। এ নিয়ে কয়েক বছর ধরে বিড়ম্বনা পোহাচ্ছেন মানুষ।
পৌরসভার পাবলিক টয়লেট অকেজো এবং ভাঙার বিষয়টি জানেন না উপজেলা জনস্বাস্থ্য কার্যালয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. আলামিন। তিনি বলেন, নকশা অনুযায়ী স্থাপনাদি নির্মাণ করা হয়েছে। তদারকি ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পৌর কর্তৃপক্ষের।
টয়লেটে তালা লাগানোর বিষয়টি জানেন না উপজেলা নির্বাহী নির্বাহী কর্মকর্তা ও পৌরসভার প্রশাসক এস এম মিকাইল ইসলাম। তিনি দুঃখপ্রকাশ করে বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে তালা খুলে দেওয়া হবে। সরকারিভাবে বরাদ্দ পেলে অকেজোগুলো সংস্কার এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পাবলিক টয়লেট স্থাপন করা হবে।
Comments