বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. ফাওজুল কবির খান বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে মোট ৫২ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, মাথাপিছু ভর্তুকির পরিমান ৩ হাজার টাকা। শনিবার ডিসিসিআই অডিটরিয়ামে জ্বালানির দাম ও সরবরাহ নিশ্চয়তা শীর্ষক সেমিনারে তিনি এ মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, বিদ্যুতে ৩২ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া সম্ভব না, পুরনো ধারনা আইপিপি বিদ্যুৎ কেন্দ্র আর করা হবে না। আমরা মার্চেন্ট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দিকে যাচ্ছি, আপনারা নিজেরা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করবেন, নিজেরা গ্রাহক ও দাম ঠিক করবেন, বিইআরসিকে শুধু অবহিত করতে হবে। দশ-বিশ শতাংশ সরকার কেনার অপশন থাকবে, যাতে আর্থিক ঝুঁকি না থাকে।
তিনি আরও বলেন, প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ গড়ে বিক্রি করছি ৮.৯৫ টাকা দরে, আর কিনছি ১২ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত। কেন বেশি দামে কেনা হলো, কারা চুক্তি করেছেন, কেন করেছেন! বাংলাদেশে ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করেছেন, তারা কি মনে করেন নি, এত বেশিদাম কেন নিচ্ছি, তারা কি জাতিকে ক্ষতিপূরণ দিবেন।
প্রতিযোগিতা নির্বাসিত হয়েছে, ওমুকের সঙ্গে পরিচয় ছিল আপনি বিদ্যুৎ কেন্দ্র পেয়ে গেলেন। এখন আর সেই সুযোগ নেই, উন্মুক্ত ছাড়া কোন কেনাকাটা হবে না। ইতোমধ্যেই এর সুফল পেতে শুরু করেছি। আগে বিপিসির আমদানি করতো মাত্র চার-পাঁচটি কোম্পানি অংশ নিতো, আগে শর্ত ছিল রিফাইনারি থাকতে হবে, শর্ত শিথিল করে বলা হয়েছে বড় সরবরাহকারি হলেই হবে। চার-পাঁচ জনের জায়গায় ১২ জন পাচ্ছি এতে ৩২ শতাংশ সাশ্রয় হয়েছে। এলএনজি উন্মুক্ত করে দিয়েছি। জানালা-দরজা বন্ধ করে দমবন্ধ অবস্থায় ফেলা হয়েছিল, আমরা সব খুলে দিয়েছি, আপনি ভালো ব্যবসায়ী হলে ব্যবসা করতে পারবেন। এখানে কোন পরিচয়ের দরকার হবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি বলেন, বর্তমানে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট, সরবরাহ দিচ্ছি ৩ হাজারের কম। এখানে ১ হাজারের মতো ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। ভোলাতে উদ্বৃত্ত গ্যাস রয়েছে একটি মাত্র কোম্পানিকে দেওয়া হলো সিএনজি করে আনতে। আমরা এটি উন্মুক্ত করে দেবো, সেখান থেকে সিএনজি কিংবা এলএনজি করে আনতে পারেন। সৌরি বিদ্যুতের ৪০ টি প্রজেক্টের পর্যায়ক্রমে দরপত্র হবে। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার প্রচুর পরিমাণে পতিত জমি রয়েছে। আমরা জমি দেবো, লাইন করে দেবো, আপনারা এসে শুধু প্রকল্প করবেন।
তেল-গ্যাস অনুসন্ধান জোরদার করা প্রসঙ্গে বলেন, ৪৮ কূপ খনন প্রকল্প চলমান রয়েছে। আগামী ২ বছরে আরও ১০০ টি করা হবে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় কিছু আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, আমি এক সময় আমলা ছিলাম, এখন নিজের ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। একটি নির্দিষ্ট অংকের বেশি হলে থার্ডপার্টি কনসালটেন্ট নিয়োগ দিতে হবে, সময় লাগবে ১ বছর। অথচ থার্ডপার্টির কাছে কোন তথ্য নেই। আমি আধা সরকারি পত্র দিয়েছি, পেট্রোবাংলা নিজে করবে। তাতে আমাদের অর্থ ও সময় সাশ্রয় হয়। এখানে ব্যবসায়ীদেরকেও আওয়াজ তোলার আহ্বান জানান।
উপদেষ্টা বলেন, মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনছেন, আপনাদের অভিযোগ সত্য মন্ত্রণালয় কাজগুলো করতে ব্যর্থ হয়েছে। আবার যখন দেখা হবে আমাদের তখন যেনো এই কথাগুলো বলতে না পারেন, সে ব্যবস্থা করতে হবে।
ডিসিসিআই প্রেসিডেন্ট আশরাফ আহমেদ বলেন, জ্বালানির প্রয়োজন হয়, তাহলে আমদানির বিকল্প নেই, দামের নির্ভরতা, আমার সাশ্রয়ী ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারি। আমদানির পাশাপাশি নিজস্ব সম্পদের ব্যবহার বাড়াতে হবে। কয়লা সম্পদ, সৌর বিদ্যুতের যে সম্ভাবনা রয়েছে তার সামান্য পরিমাণে ব্যবহার করতে পারছি। সার উৎপাদন গ্যাস ব্যবহার কতটা উপযুক্ত সেটা ভেবে দেখা দরকার, সার উৎপাদনে গ্যাসের অনেক বিকল্প রয়েছে, সেদিকে যাওয়া উচিৎ।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ম. তামিম বলেন, জ্বালানির দাম কোনভাবেই পেডিক্ট করার সম্ভব না, দীর্ঘ মেয়াদে জ্বালানির দাম কখনই সঠিক হয় নি। বিদ্যুৎ প্রতি ইউনিট উৎপাদনে খরচ পড়ছে (২০২৩-২৪) ১১.৫১ টাকা, আর বিক্রি (পাইকারি) করা হচ্ছে ৭.০২ টাকা দরে। আবার গ্যাসের দরেও ঘাটতি রয়েছে। এভাবে ঘাটতি রেখে একটি সেক্টর চলতে পারে না। শুধুমাত্র ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় কয়লা ভিত্তিক প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৬.৫ টাকা থেকে বেড়ে ৯.১৭ টাকা হয়েছে।
ম. তামিম তার সুপারিশে বলেন, আদানি ছাড়া ভারত থেকে অন্য যে বিদ্যুৎ আসছে সেগুলোর দাম অনেক কম। বাংলাদেশে উৎপাদিত কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গড় খরচ পড়ছে ১২.৪৬ টাকা, আর একই সময়ে আদানিকে দিতে হয়েছে ১৪.৮৩ টাকা করে। এটার দাম বেশি হবে কেনো, ওই চুক্তিটি রিভিউ করা উচিত। সৌর বিদ্যুতের গড় দর পড়ছে ১৬.৪৮ টাকা, ওই চুক্তিগুলোও রিভিউ হওয়া দরকার।
বিদ্যুতের লোডশেডিং কমাতে, অফিস টাইম পরিবর্তন এবং গরমের সময় সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে মার্কেট বন্ধ, প্রয়োজন হলে শুক্র ও শনিবার অনেকরাত পর্যন্ত চালানো। শীতে উদ্বুত্ব বিদ্যুৎ নেপালে রপ্তানি। গ্যাসের সংকট মেটাতে স্থলভাবে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করা, গ্যাসের সিস্টেম লস কমানো।
তিনি বলেন, গ্যাস সংকট আরও প্রকট হতে পারে। বিবিয়ানার উৎপাদন আরও কমে যেতে পারে, তারজন্য প্রস্তুতি রাখা উচিত। এফএসআরইউ আরও লাগবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড বদরুল ইমাম বলেন, এখানে গ্যাসের কোন অভাব নেই, যদি যথাযথভাবে অনুসন্ধান হলে আজকে গ্যাস সংকট নিয়ে কথা বলতে হতো না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য কোন সরকারেই অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদারভাবে করে নি। আমরা সবসময় আমদানির দিকে নজর দিয়েছি। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, সেভাবে কাজ করলে আমরা গ্যাস রপ্তানির দিকে যেতে পারতাম।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত সেমিনারে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন, বাংলাদেশ সোলার এন্ড রিনিউয়েবল এনার্জি এসোসিয়েশনের সভাপতি প্রকৌশলী নুরুল আক্তার, কনফিডেন্স গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ইমরান করিম।
মানবকণ্ঠ/এসআর
Comments