ব্যাংকিং খাতে বিশৃঙ্খলার খবর নতুন নয়- চরম অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়ায় সংকট তৈরি হয়েছে। অনেকটা ‘সর্ষের মধ্যে ভূত’ এই প্রবাদটি সত্য প্রমাণ করেছে বিগত সরকার। তাদের শাসনামলে কমবেশি সব খাতেই অনিয়ম-দুঃশাসন ছিল। তবে একটি রাষ্ট্রের মূল চালিকা শক্তি অর্থনৈতিক খাত, খাতটি একেবারে নাজুক অবস্থায় ফেলে দিয়েছে।
লুটপাটের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ। বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের তালিকায় থাকা প্রতিষ্ঠান একেবারে কম নয়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর দেশের ব্যাংক খাতে ঘটে যাওয়া অনিয়মের খবরে বিচলিত হয় গ্রাহকরা। চরম তারল্য সংকটে আছে দেশের কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার পেয়েও সংকট কাটাতে পারছে না ব্যাংকগুলো। ইসলামী ব্যাংকসহ আরও পাঁচটি ব্যাংক নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে ইচ্ছেমতো লুট করে ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে সদ্য বিদায়ী আওয়ামী সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ। ফলে গ্রাহকের চাহিদামতো টাকা দিতে পারছে না এসব ব্যাংক।
গত কয়েক মাসে তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা ধার দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ছেপে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর বাকি সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন ব্যাংক থেকে গ্যারান্টির মাধ্যমে ধার দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিভিন্ন ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, ব্যাংকে নিজের টাকা তুলতে গ্রাহক হয়রানির শিকার হচ্ছেন। নিজেদের জমানো টাকা তুলতে জুতা ক্ষয় করতে হচ্ছে তাদের। মূলত ঋণের টাকা ফেরত না পাওয়ায় তারল্যসংকটে ভুগছে কিছু ব্যাংক। যেহেতু ব্যাংকিং খাতের টাকা জনগণের কষ্টার্জিত অর্থের আমানত, তাই এ খাতের দুর্বৃত্তদের কোনো ধরনের ছাড় দেয়ার অবকাশ নেই।
রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় খেলাপি ঋণ সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের দেড় দশকের ক্ষমতার প্রভাবে সংকট বেড়েই চলেছে। দলীয় প্রভাবের কারণে কয়েকটি ব্যাংকের আর্থিক কার্যক্রম মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়েছে। ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ দেশের ব্যাংক খাতের কোমর ভেঙে দিয়েছে। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, ডলারের দামের অস্থিতিশীলতা, রিজার্ভের ঘাটতি, দেশি-বিদেশি পর্যায়ে ঋণের দায় বৃদ্ধি, প্রবাসী ও রপ্তানি আয়ের প্রবাহ হ্রাস; সর্বোপরি ব্যাংকগুলো থেকে ঋণের নামে অর্থ লুট হওয়ায় এ খাতে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
মূলত, দুর্বল করপোরেট শাসন ব্যবস্থা, আইনের দুর্বল প্রয়োগ এবং স্বচ্ছতার অভাব বাংলাদেশের ব্যাংক খাতকে ঝুঁকির মধ্যে রেখেছে। এখানে ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রণ করে এমন সব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, যাদের আসল আগ্রহ অন্যত্র। বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ বা ব্যবসায়ী গ্রুপের মালিকরা ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করেছে। এ চিত্র একটি দেশের জন্য মোটেও ভালো সংবাদ নয়।
দ্রুত এ অবস্থার উত্তরণ সম্ভব না হলে আরও ভয়াবহতা দেখা দেবে, এতে আমাদের দেশের তরুণ সমাজের স্বপ্ন ভেস্তে যাবে। ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনতে হলে প্রথমেই ঋণখেলাপিসহ প্রতিটি অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তা-পরিচালকদের সাজা নিশ্চিত করতে হবে।
ব্যাংকিং খাতে দুষ্ট চক্র ভেঙে ফেলতে এবং স্বচ্ছতা আনতে তাই একটি সুনির্দিষ্ট, সময়োপযোগী, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, জবাবদিহিমূলক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠন এখন সময়ের দাবি। প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের মধ্য দিয়ে আর্থিক খাতের সংস্কার করতে হবে। তাই ঋণখেলাপিসহ প্রতিটি অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তা-পরিচালকদের সাজা নিশ্চিত করতে হবে। এ খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে পারলেই গ্রাহক হয়রানি বন্ধ হবে বলে- সবার প্রত্যাশা।
Comments