Image description

বাংলাদেশে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ঘটে যাওয়া ধর্মীয় সহিংসতার কিছু ঘটনা দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতাকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। এসব সহিংসতার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছাড়াও ধর্মীয় বিদ্বেষ বা ধর্ম অবমাননার অভিযোগ উঠে এসেছে। তবে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো বাংলাদেশের ধর্মীয় সম্প্রীতি এবং সহাবস্থানের ঐতিহ্যের বিপরীত নয়। 

বরং, দেশের জনগণের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রয়েছে, যা সংকটের মধ্যেও টিকে আছে। বাংলাদেশ একটি বহু ধর্ম ও সংস্কৃতির সমন্বয়ে গঠিত সমাজ। এই বৈচিত্র্য দেশের শক্তি হলেও, বিভিন্ন সময়ে ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়। 

১৯৭৫ সালের পর সামরিক শাসনামলে ধর্মীয় রাজনীতির প্রসার এবং রাষ্ট্রধর্মের সংযোজনের মাধ্যমে ধর্মীয় ইস্যু রাজনীতিতে প্রবেশ করানো হয়। পরবর্তীকালে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ধর্মকে ক্ষমতার জন্য ব্যবহার করেছে, যার ফলে সমাজে বিভাজন ও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। ধর্মীয় সহিংসতার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

গণমাধ্যমের মূল কাজ হলো সঠিক ও নিরপেক্ষ তথ্য সরবরাহ করা, যাতে জনগণ গুজব থেকে প্রকৃত পরিস্থিতি বুঝতে পারে। অতীতে, বিভিন্ন সময় এবং সাম্প্রতিক উত্তেজনার পেছনে গুজব ছড়িয়ে পড়া এবং সঠিক তথ্যের অভাব দায়ী হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি গুজবের ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িক হামলা ঘটে, যা অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে। 

এজন্য গণমাধ্যমকে প্রতিটি ঘটনার অনুসন্ধান করে নিরপেক্ষ ও দায়িত্বশীল সংবাদ পরিবেশন করতে হবে, যাতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি না হয়। ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক ঘটনা নিয়ে উত্তেজনা বাড়ানোর পরিবর্তে, গুজবের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরির মাধ্যমে গণমাধ্যম শান্তি এবং ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এদিকে, ভারতীয় গণমাধ্যমের অতিরঞ্জিত প্রতিবেদনও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। 

সাম্প্রতিক সহিংসতার ক্ষেত্রে কিছু ভারতীয় মিডিয়া বাংলাদেশের ঘটনাগুলোকে অতিরঞ্জিতভাবে উপস্থাপন করে এমন ধারণা দেয় যে বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। তবে বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। বাংলাদেশে প্রতিটি ধর্মের মানুষের সহাবস্থানের দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণেও এ প্রবণতা দেখা যায়। 

ধর্মীয় মেরুকরণ ব্যবহার করে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের কৌশল ভারতের বাস্তবতায় একটি পুরোনো বিষয়। তবে এটি যখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে প্রভাব ফেলে, তখন তা শুধু দুই দেশের সম্পর্কেই প্রভাব ফেলে না, বরং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিও জটিল হয়ে ওঠে।

এ সংকট সমাধানে প্রয়োজন বাংলাদেশের জনগণের সচেতনতা। বিশেষত, দেশের সব সম্প্রদায়ের মানুষের সতর্ক এবং সচেতন থাকতে হবে, যাতে তারা রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত না হয়। অতীতে আমরা দেখেছি, ধর্মীয় বিদ্বেষ বা ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে আইন নিজের হাতে নেওয়ার প্রবণতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। তাই জনগণের উচিত শান্ত থাকা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আস্থা রাখা। 

এছাড়া, ধর্মীয় অবমাননার শাস্তি যেনো দেশের প্রতিটি ধর্মের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হয়, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কোনো একটি ধর্ম বা সম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে নষ্ট করতে পারে। এমতাবস্থায় বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা এবং কার্যকারিতা রক্ষা করতে পারলেই আইনের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়বে। 

এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশ সরকার, গণমাধ্যম এবং জনগণ সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে। সরকারকে প্রতিটি ঘটনার দ্রুত এবং নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে। গণমাধ্যমের উচিত সত্য উদ্ঘাটন এবং বিভ্রান্তিকর বা উত্তেজনাকর সংবাদ পরিবেশন এড়িয়ে চলা। অন্যদিকে, ভারতীয় গণমাধ্যমের অতিরঞ্জিত প্রচারণার বিরুদ্ধে কূটনৈতিক আলোচনা জরুরি।

ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষা এবং বিভ্রান্তি দূর করার মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্ববাসীকে দেখাতে পারে যে এটি সহাবস্থানের এক অনন্য উদাহরণ। শান্তি, সততা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে সংকট সমাধান সম্ভব এবং সেটিই দেশের ঐতিহ্য ধরে রাখার পথ। এভাবেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও শান্তির পথে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারে।

লেখক: শিক্ষার্থী