মাদারীপুরের শীত মানেই খেজুরের রসের মিষ্টি স্বাদ। একসময় গ্রামীণ মেঠো পথে সকালবেলায় দেখা যেত, দুধারে খেজুর গাছ এবং তার নিচে রসের হাঁড়ি নামাতে ব্যস্ত গাছির দল। শীতের সকালের কুয়াশা ছিটকে পড়া পথে রসের হাঁড়ি কিনে বাড়ি ফেরার পথে চললে মনটা ভরে উঠত। কিন্তু আজকাল এই ছবি আর দেখা যায় না। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে গ্রামীণ জীবনেও। মেঠো পথের জায়গায় এসেছে পাকা রাস্তা, খেজুর গাছ কেটে ফেলা হয়েছে অনেক। যে-সব গাছ রয়েছে, তাতেও রস আগের মতো হয় না। প্রকৃতির পরিবর্তনের কারণে রসের পরিমাণ কমে গেছে। এখন তিন-চারটি গাছ থেকে এক হাঁড়ি রসও পাওয়া যায় না। ফলে খাঁটি খেজুরের গুড় বাজারে দুর্লভ হয়ে পড়েছে। মাদারীপুরের এই বিখ্যাত খাবার ধীরে ধীরে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম।
জানা গেছে, মাদারীপুর জেলার সদর উপজেলা, রাজৈর, শিবচর ও কালকিনির প্রত্যন্ত এলাকায় শীতের শুরু থেকেই খেজুর গাছ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে গাছিরা। নতুন হাঁড়ি পেতে রস সংগ্রহ করে থাকেন তারা। খেজুর রস তৈরি করে বাজারে বিক্রিই মূলত এসব গাছির মূল পেশা। এখন আর বাজারে রস খুব একটা বিক্রি হয় না। রসের পরিমাণ কম হওয়ায় প্রতি হাঁড়ি রসের বাজার দর তিন/পাঁচ শত টাকা। দুই/তিন দিন আগে অর্ডার করলে এক হাঁড়ি রস পাওয়া যায়। তবে গাছিরা কাঁচা রস এখন আর বিক্রি করতে চান না। গাছ কেটে যে রস বের হয়, তাতে খেজুর গুড় তৈরি করেন তারা। তবে বেশি দামে খাঁটি গুড়ের ব্যবস্থা করতে পারেন গাছিরা। এছাড়া খোলা বাজারে বিক্রি হওয়া গুড় খাঁটি হওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারেন না বিক্রেতারা।
হানিফ চৌকিদার নামের ঝাউদি এলাকার এক গাছি জানান, দিন দিন খেজুর গাছ কমে যাচ্ছে। তাছাড়া গাছে রসও কম পড়ে। তিন থেকে চার গাছের রস নিয়ে এক হাঁড়ি হয়।
তিনি আরও জানান, কাঁচা রস এখন তেমন কেউ কিনে না। রস যা পাই তা দিয়েই গুড় তৈরি করা হয়। খাঁটি গুড়ের দাম তুলনামূলক বেশি। অনেকেই অগ্রিম অর্ডার করে গুড় নেয়।
স্থানীয়রা জানান, খেজুর রসে নিপা ভাইরাস থাকতে পারে এমন আশঙ্কায় কাঁচা রসের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে অনেকেই। তাছাড়া এক হাঁড়ি রস বর্তমানে ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা করে বিক্রি হয়। তাও আগেভাগে অর্ডার দিয়ে রাখতে হয়। তাছাড়া বাজারে খাঁটি খেজুর গুড় মান ভেদে ৪০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হয়। এবং সাধারণ খেজুর গুড় ২০০ থেকে ৩০০।
মাদারীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ বছর আগে মাদারীপুর জেলায় প্রায় ৭৫ হেক্টর জমিতে ৮৪ হাজার ৯৮৫টি খেজুর গাছ ছিল। বর্তমানে সেখানে ৪৫ হেক্টর জমিতে ৪৭ হাজার ৭৩১টি খেজুর গাছ রয়েছে। দিন দিন খেজুর গাছ কমে যাচ্ছে। তবে কৃষকদের খেজুর গাছ চাষের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
গত কয়েকদিন ধরেই গ্রামে বেড়েছে শীতের প্রকোপ। আর শীতের মাত্রা বেশি হলেই নাকি খেজুর রস আরও বেশি সুমিষ্ট হয়। গাছ কমে যাওয়া, গাছ কাটা পেশায় যারা আছেন, তাদের সংখ্যাও দিন দিন কমে গেছে। গাছ কম থাকায় এখন আর গাছ কেটে রস নামিয়ে গুড় তৈরি করে আর্থিকভাবে খুব একটা লাভবান হন না বলে জানান এই এলাকার গাছিরা। তারপরও শীত মৌসুমে এলেই ব্যস্ততা শুরু হয় গ্রামের প্রান্তিক এই গাছিদের।
মাদারীপুর প্রতিনিধি
Comments