দেশের বিশিষ্ট লেখক, দার্শনিক, গবেষক ও বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহার বলেছেন, ঘোষণাপত্র (Proclamation) জনগণের ক্ষমতা জনগণের কাছেই ফিরিয়ে দেওয়ার গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক এবং আইনি অনুষ্ঠান। গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের অনুপস্থিতিতে সেনাসমর্থিত উপদেষ্টা সরকার বেআইনি ও অবৈধ।
বুধবার (১৫ জানুয়ারি) দুপুরে সামাজিক যোগযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের ভেরিফাইড পেজে দেওয়া এক পোস্টে তিনি এসব কথা বলেন।
ওই পোস্টে তিনি বলেন, শুরু থেকেই আমি কয়েকটি স্পষ্ট কথা বলে এসেছি।
শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে একটি সেনা সমর্থিত উপদেষ্টা সরকার গঠন করা হয়েছে অথচ এ ধরনের সরকারের কোনো সাংবিধানিক বা আইনি ভিত্তি নাই। অর্থাৎ জনগণের অভিপ্রায়ের বিপরীতে একটা অবৈধ সরকার জবরদস্তি কায়েম রাখা হয়েছে। আইন কিংবা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া উভয় দিক থেকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ফলে এ ধরনের সেনা সমর্থিত উপদেষ্টা সরকার গঠন সম্পূর্ণ অবৈধ, অযৌক্তিক এবং কাণ্ডজ্ঞান বিবর্জিত সিদ্ধান্ত। সতেরো কোটির অধিক জনগণ অধ্যুষিত বাংলাদেশের জন্য এটা ভয়ানক দায়িত্বহীন ও বিপজ্জনক।
ইতোমধ্যেই বৈরী ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় এই অবৈধ সরকার প্রকট বিপদ তৈরি করে রেখেছে। সীমান্তে ভারতীয় সেনাবাহিনীর দাপট ও দম্ভ তার প্রমাণ।
ফরহাদ মজহার বলেন, ঘোষণাপত্রের গুরুত্ব হচ্ছে ঘোষণাপত্র এযাবৎকালে যে সকল ফ্যাসিস্ট আইন ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা জবরদস্তি কায়েম রাখা হয়েছে তাদের বৈধতা অস্বীকার করে এবং সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে নতুনভাবে রাষ্ট্র ও সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতির দেয়। ঘোষণাপত্র সেই দিক থেকে এক প্রকার গণ-অঙ্গীকারপত্র বা গণপ্রতিশ্রুতি।
যার মধ্য দিয়ে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত সরকার পূর্ণ ক্ষমতা লাভ করে এবং দেশের জনগণ এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজেদের বৈধতা অর্জন করে। একইভাবে ঘোষণাপত্র জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ায় মধ্য দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের আইনি ভিত্তি স্থাপন করে।
গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র এমন একটি দলিল উল্লেখ করে এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, এটা পরিষ্কার গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র (Proclamation) গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার আইনি ও নৈতিক ভিত্তি স্থাপন করে। এটি জনগণের ইচ্ছার সার্বভৌম প্রকাশ এবং শাসনব্যবস্থার পুনর্গঠন ও সংস্কারের পথ দেখায়। গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র এমন একটি দলিল, যা জনগণের অধিকার, মর্যাদা এবং গণতান্ত্রিক ক্ষমতার রূপ নির্দেশ করে।
এটি নিছকই শাসনতান্ত্রিক বা সাংবিধানিক দলিল নয়, বরং নিজেদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পুনরায় গিঁট বেঁধে স্বাধীনতা, সাম্য, এবং মানবাধিকারকে মূর্ত ও বর্তমান করে তোলার প্রক্রিয়া। তাই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মুহূর্ত বাংলাদেশের জনগণের ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন এবং বিশ্বসভায় শক্তিশালী স্থান অর্জন করবার ভিত্তি।
গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রছাত্রী তরুণদের দাবি মানা হচ্ছে না দাবি করে ফরহাদ মজহার বলেন, এই সকল কারণে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রছাত্রী তরুণেরা বারবার গণঅভ্যুত্থানের মর্ম ধারণ করে এমন একটি ‘ঘোষণা’ (Proclamation)-র দেওয়ার দাবি করে আসছেন। যদিও তাদেরকে এখন ব্যাখ্যা করতে হবে কোন পরিস্থিতির শিকার হয়ে এবং কাদের পরামর্শে এ ধরনের ঘোষণা গণঅভ্যুত্থানের পরপরই তারা দেননি, কিংবা দেওয়া হয় নি। কেন গণ-অভিপ্রায় বিরোধী এবং সংবিধান বহির্ভূত সরকার গঠন করা হলো। এই ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী প্রশংসার দাবিদার, কারণ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তারা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ভূমিকা বজায় রাখছেন। কিন্তু আফসোস গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রছাত্রী তরুণদের দাবি মানা হচ্ছে না। যা গভীর রাজনৈতিক সংকট তৈরি করে রেখেছে। এই সংকট এড়িয়ে যাবার কোন উপায় নাই।
গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র কেন জরুরি সেই বলতে গিয়ে ওই পোস্টে তিনি লিখেন, ‘‘বর্তমান বিপজ্জনক পরিস্থিতির একটি কারণ হতে পারে বাংলাদেশের আইনি বা সাংবিধানিক পর্যালোচনায় এবং সামগ্রিক বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণসার্বভৌমত্ব (Popular Sovereignty) প্রতিষ্ঠার বিষয়টি– বিশেষত ‘ঘোষণা’ (proclamation) কেন জরুরি সে সম্পর্কে প্রকট অজ্ঞতা রয়েছে। অথচ গণঅভ্যুত্থানের পরে গণঅভিপ্রায় ব্যক্ত করে দেওয়া ‘ঘোষণা’ গভীর আইনি এবং রাজনৈতিক তাৎপর্য বহন করে। গণঅভ্যুত্থানের মুহূর্ত বা সময় শুধুমাত্র একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত নয়, বরং চূড়ান্ত ক্ষমতার উৎস হিসেবে জনগণের সার্বভৌম ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিয়ে ‘ঘোষণা’একটি নতুন গঠনতন্ত্র এবং সমাজ বিনির্মাণের ভিত্তি রচনা করে’’।
‘‘গণঅভ্যুত্থান সে কারণে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক সাহিত্যে অভূতপূর্ব বিপ্লবী মুহূর্ত বা রুহানি ওয়াক্ত হিসেবে স্বীকৃত। গণঅভ্যুত্থান এমন একটি বিপ্লবী মুহূর্ত, যা জনগণের ঐক্য এবং সংগ্রামের চূড়ান্ত প্রকাশ। এটি জনগণের চেতনার পুনর্জাগরণ ঘটায় এবং জীবাবস্থা থেকে জনগণ নিজেদের সামষ্টিক রুহানি সত্তার স্বাদ আস্বাদন করে। এই সেই মুহূর্ত যখন ব্যক্তি সমষ্টির স্বার্থে শহিদী জীবন কবুল করে নিতে দ্বিধা করে না’’।
সবশেষ ওই পোস্টে তিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের বেশকিছু আইনি এবং রাজনৈতিক তাৎপর্য তুলে ধরেন। নিচের তার বিশ্লেষণগুলো তুলে ধরা হল।
১. আইনি তাৎপর্য
সার্বভৌমত্বের ঘোষণাপত্র (Proclamation) হিসেবে স্বীকৃতি গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র একটি গঠনতান্ত্রিক দলিল হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় ‘ঘোষণাপত্র’ শেখ হাসিনার ও অন্যান্য গণবিরোধী রাজনীতির বিপরীতে গণরাজনৈতিক ধারাকে প্রতিষ্ঠিত করে এবং শেখ হাসিনা প্রবর্তিত ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং তার আগের বিভিন্ন গণবিরোধী আইন বা সংবিধানের ব্যর্থতাকে চ্যালেঞ্জ করে নতুন গঠনতন্ত্র প্রবর্তনের ভিত্তি স্থাপন করে।
আইনের দিক গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী ঘোষণা জনগণের ইচ্ছার চূড়ান্ত প্রকাশ, যা গণঅভ্যুত্থানের আগে বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট আইন, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং সকল প্রকার ফ্যাসিস্ট ক্ষমতা ও ফ্যাসিস্ট প্রতিষ্ঠানের বৈধতাকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে একটি নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ণের জন্য অবিলম্বে নতুন গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করে; অর্থাৎ নতুন গঠনতন্ত্রের জন্য নৈতিক ও আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠা করে।
প্রাক-গঠনতান্ত্রিক (বা প্রাক-সাংবিধানিক) দলিলের ভূমিকা
গণঅভ্যুত্থানের পর ঘোষণাপত্র একটি প্রাক-গঠনতান্ত্রিক– অর্থাৎ নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়নের ভিত্তি ও দিক-নির্দেশনা হিসাবে কাজ করে। যা ভবিষ্যৎ গঠনতন্ত্রের নীতিগত ও আদর্শিক ভিত্তি প্রদান করে। এটি নতুন গঠনতন্ত্রের উপাদান- যেমন সাম্য, স্বাধীনতা, মানবিক মর্যাদা, এবং সামাজিক ন্যায়বিচারকে স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করে।
শাসনক্ষমতার পুনর্বণ্টন
ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে জনগণের কাছে শাসনক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া হয়। ঘোষণাপত্রের গুরুত্ব হচ্ছে ঘোষণাপত্র পূর্ববর্তী শাসনব্যবস্থার বৈধতা অস্বীকার করে এবং জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ায় মধ্য দিয়ে ক্ষমতার হস্তান্তরের আইনি ভিত্তি স্থাপন করে।
আন্তর্জাতিক আইনি স্বীকৃতি
গণ অভ্যুত্থানের ভিত্তিতে ঘোষণাপত্র আন্তর্জাতিক আইনের আলোকে স্বীকৃতি পেতে পারে। গণঅভ্যুত্থানের পরে ঘোষিত ঘোষণাপত্র আদতে জাতিসংঘে গৃহীত জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকেই প্রতিষ্ঠিত করে। জাতিসংঘ সনদ (UN Charter) এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক নীতিমালা, বিশেষত আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার নীতিকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র শক্তিশালী করে।
২. রাজনৈতিক তাৎপর্য
গণসার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা
গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণ নিজেরাই নিজেদের আইনদাতা, শাসক এবং বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নির্মাণকর্তা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে। আগের ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও সাংবিধানিক একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পতন ঘটিয়ে জনগণের অভিপ্রায় বা ইচ্ছার ভিত্তিতে নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসাবে জনগণ নিজেরা নিজেদের রাজনৈতিক কর্তা সত্তা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে। এবং নিজেদের নতুনভাবে ‘গঠন’ করার আইনি ও রাজনৈতিক স্বীকৃতি লাভ করে। আন্তর্জাতিকভাবে এই স্বীকৃতি ছাড়া বিশ্ব রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বাংলাদেশ কখনই শক্তিশালী স্থান দখল করতে পারবে না।
নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সূচনা
ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং নাগরিকদের পরস্পরের মধ্যে নতুন সম্পর্ক নির্মাণের সূত্র বা নীতি হাজির করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, মানবাধিকারের সুরক্ষা, এবং জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণমূলক প্রশাসনিক ব্যবস্থা বা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠার মতো গুরুতর ও মৌলিক বিষয়গুলো এতে অন্তর্ভুক্ত থাকে।
অনেকে একে নতুন ‘রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’ বলে থাকেন, কিন্তু এই বন্দোবস্ত মানে রাজনৈতিক দল বা বিভিন্ন গণবিরোধী ও ফ্যাসিস্ট শক্তির সঙ্গে আপোষ-মীমাংসার ‘বন্দোবস্ত নয়। ‘রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’ ধারণা হিসাবে ভুল বিভ্রান্তিকর রাজনৈতিক বর্গ।
অন্তর্বর্তীকালীন শাসনের ভিত্তি বা রাজনৈতিক বৈধতার প্রশ্ন (Political Legitimacy)
ঘোষণাপত্র রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত এবং নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়নের পথ প্রস্তুত করবার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনার একটি আইনি ও প্রশাসনিক ফরমান প্রদান করে। এই ফরমান বা আদেশ গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ব্যক্ত জনগণের রাজনৈতিক অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি হিসেবে কাজ করে। এটি শুধু বর্তমান পরিস্থিতির সমাধান করে তা নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি ন্যায়সংগত ও টেকসই শাসনব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে।
মানবকণ্ঠ/আরএইচটি
Comments